যুদ্ধ ও সামন্ত-ভূস্বামীদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ
মোগল আমলের সমস্ত গণ-আন্দোলনের ফলে মোগল-রাজকোষে রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস পায়। ওদিকে গোলকোণ্ডা-রাজ্য ১৬৩৬ খ্রীস্টাব্দে মোগলদের যেবার্ষিক সেলামি দেবে বলে চুক্তি করেছিল তা দেয় বন্ধ করে। ইতিমধ্যে মোগল রাজকোষে অর্থের টানাটানি পড়ায় এই সেলামি পাওয়ার প্রয়োজন ছিল মোগলদের, তদুপরি আবার গোলকোল্ডা ছিল ধনী দেশ। গোলকোল্ডা রাজ্যের অর্থনীতির একটি উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে প্রায় সবটা ভূমি-রাজস্ব ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর সেখানে আদায় হতো মধ্যবর্তী পত্তনদার মারফত। এই প্রথা অবশ্য গ্রামের কৃষক ও শহরের জনসাধারণ উভয়ের পক্ষেই ছিল মারাত্মক ক্ষতিকারক। কিন্তু এ-ব্যবস্থা বিত্তবান সম্প্রদায়ের মানুষদের পক্ষে অনেক বেশি সুযোগের সৃষ্টি করেছিল সরকারি কর্মচারির পদ কেনার ব্যাপারে এবং রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারি বনে যাওয়ায়। যেমন, উদাহরণস্বরপ বলা যায়, ধনী ফারসি বণিক মুহম্মদ সয়ীদ আদিস্তানী গোলকোণ্ডায় নিজস্ব এক বিরাট সেনাবাহিনী পোষণ করতেন এবং তিনি বিজয়নগর-রাজ্যের কাছ থেকে কর্ণাটকের একটি অংশ কেড়ে নিয়ে সেখানকার হীরক-খনিগুলি থেকে হীরা তুলতে শুরু করে দেন। অতঃপর তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও অগ্রসর হয় এবং গোলকোল্ডার ভূমি-রাজস্ব বিভাগের প্রধান বা ‘মীর জুমলা’ বনে যান তিনি। ইতিহাসেও তিনি এই উপাধি দিয়েই পরিচিত এবং পরে তিনি এই উপাধিকেই নিজের নাম হিসেবে গ্রহণ করেন। ক্রমশ গোলকোণ্ডা-রাজ্যের সমস্ত বড়-বড় পদ নিজের কুক্ষিগত করে মীর জুমলা কার্যত শাসক হয়ে বসলেন গোলকোণ্ডার। এই পর্যায়ে গোলকোণ্ডার শাহ ও তাঁর এই প্রবল প্রতাপ উজিরের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হলে মীর জুমলা গোপনে মোগলের সঙ্গে চুক্তি করে তাঁদের পক্ষে চলে গেলেন ও চাকুরি গ্রহণ করলেন।
এ-খবর জানতে পেরে গোলকোল্ডার শাহ মীর জুমলার ছেলেকে কারারুদ্ধ করলেন (১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দ)। ফলে আওরঙ্গজেবের একটা অজুহাত জুটে গেল গোলকোণ্ড আক্রমণ করার পক্ষে। মোগল-সেনাবাহিনী রাজ্যের মধ্যে ঢুকে পড়ে গোলকোল্ডার রাজধানী ভাগনগরে (বর্তমানে হায়দরাবাদে) প্রবেশ করল এবং শাহ যে-দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন তা অবরোধ করল। এই অবরোধ স্থায়ী হয় দু’মাস। অতঃপর যে-শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় তাতে গোলকোণ্ডা-রাজ্যের একাংশ মোগলদের ছেড়ে দিতে হয় ও যুদ্ধের ক্ষতিপূরণবাবদ গোলকোণ্ডার জনসাধারণকে দিতে হয় মোটা অর্থের খেসারত। রাজধানী লণ্ঠিত হওয়ায় এবং সেলামিবাবদ মোটা টাকার দায় ঘাড়ে চাপায় রাজ্যে করের হার বাড়াতে হয় প্রচুর পরিমাণে। এই পরাজয় থেকেই গোলকোণ্ডার অর্থনৈতিক অবনতির সূচনা ঘটে।
গোলকোল্ডাকে পদানত করার পর মীর জুমলার সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে আওরঙ্গজেব বিজাপুর আক্রমণ করলেন। কিন্তু ঠিক এই সময়ে (১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে) গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন সম্রাট শাহ জাহান। ভারতে যেহেতু জ্যেষ্ঠপুত্রের উত্তরাধিকারী হওয়ার বিধি প্রচলিত ছিল না এবং ‘পাতশাহে’র প্রতিটি পুত্রই সমানভাবে সিংহাসন দাবি করতে পারতেন, তাই এখন শাহ জাহানের চার ছেলের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে সংঘর্ষ বেধে উঠল। শাহ জাহানের প্রিয় ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দারা শুকোহ। দারা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং তাঁর মানসিক প্রবণতা ছিল অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি। তিনি হিন্দু সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, সুফী-মতবাদ বিষয়ক গ্রন্থরচনা করতেন এবং স্বপ্ন দেখতেন ইসলাম ধর্ম ও হিন্দু ধর্মকে একত্রে মেলাবার। কিন্তু তাঁর যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, কারণ শাহ জাহান তাঁকে সারাজীবন দরবারেই ধরে রেখেছিলেন। দারা শুকোহকে সমর্থন করছিলেন হিন্দু রাজপুতরা তাঁদের আশা ছিল যে দারা দিল্লীর সিংহাসনে বসলে আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতার রাষ্ট্রনীতির পুনরাবির্ভাব ঘটবে।
শাহ জাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ শুজা দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। শাহ জাহান মারা গেছেন এই ভুল খবর পেয়ে শুজা সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ‘পাতশাহ’ বলে ঘোষণা করে সসৈন্যে আগ্রা-অভিমুখে যাত্রা করলেন। দারা শুকোহ শুজার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাস্ত করলেন বটে, কিন্তু দারার সেনাবাহিনী বঙ্গদেশে ব্যস্ত থাকার সময় শাহ জাহানের অন্য দুই ছেলে — গুজরাটের শাসনকর্তা মুরাদ ও দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা আওরঙজেব রাজত্ব আমলে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হলেন। শাহ জাহানের চার ছেলের মধ্যে এই রেষারেষি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলে দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে এবং তার পরিণামে বিজয়ী হন আওরঙজেব। আওরঙজেব ছিলেন অসহিষ্ণু গোঁড়া মুসলিম এবং তিনি রাজত্ব করে যান যতটা নিজ শক্তি সামর্থ্যের জোরে তার চেয়ে অনেক বেশি করে চক্রান্ত ও নিষ্ঠুর আচরণের ওপর নির্ভর করে।
বিজাপুর ও গোলকোন্ডা-বিজয়
গণ-অভ্যুত্থানগুলিকে দমন করার জন্যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়ছিল বলে আওরঙজেব রাজত্ব আমলে রাজকোষ পূর্ণ করতে মনস্থ করলেন এবং এ-উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে বসলেন বিজাপুর-রাজ্য। বিজাপুরের রাজধানী অবরুদ্ধ হলো এবং আশপাশের এলাকা গেল বিধস্ত হয়ে। দুর্গকেন্দ্রিত রাজধানী প্রতিরোধ করে চলল দীর্ঘ আঠারো মাস ধরে, অবশেষে ১৬৮৬ খ্রীস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর কবলিত প্রতিরোধকারীদের মনোবল গেল নষ্ট হয়ে। বিজাপুরে আত্মসমর্পণ করার পর মোগল-বাহিনী গোটা শহর লুণ্ঠন করে শহরের জল-সরবরাহের ব্যবস্থা সহ সবকিছু ধ্বংস করে দিল। একদার ঐশ্বর্যশালী জমকালো রাজধানী বিজাপুর পরিণত হলো ধ্বংসস্তুপে ও কালক্রমে তা গ্রাস করে নিল অরণ্য। অতঃপর পালা এলো গোলকোণ্ডার। মোগলরা শুধুমাত্র গোলকোণ্ডার সেনাধ্যক্ষদের উৎকোচ দিয়েই দুর্গ-রাজধানী দখল করে ফেললেন (১৬৮৬ খ্রীস্টাব্দ)। খোদ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল গোলকোল্ডা। ফলে আওরঙ্গজেবের রাজকোষে লুণ্ঠিত ঐশ্বর্যের আর অবধি রইল না।
এটা ছিল সেই সময় যখন মোগল সাম্রাজ্য তার ইতিহাসে বৃহত্তম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ-সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তখন প্রায় সমগ্র ভারত-উপমহাদেশ এবং তা দক্ষিণে বিস্তৃত হয়েছিল সদর পেন্নের ও তুঙ্গভদ্রা নদী পর্যন্ত আর উত্তরে তার অন্তর্ভুক্ত ছিল কাশ্মীর এবং কাবুল ও গজনি-শহর সহ আফগান প্রদেশগুলি। একমাত্র কান্দাহার তখনও পর্যন্ত পারস্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তথ্যসূত্র:
১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩৪৬-৩৪৭, ৩৫৮।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।