প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব রণাঙ্গন ছিল মধ্য ও পূর্ব ইউরােপের দিকে বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্র

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব রণাঙ্গন (Eastern Front বা Eastern Theater of First World War) ছিল মধ্য ও পূর্ব ইউরােপের দিকে বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্র। পূর্ব রণাঙ্গন পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে আলাদা ছিল। এখানকার ভৌগােলিক অবস্থান যুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পশ্চিম রণাঙ্গনের লড়াইয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে পরিখার লড়াই বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। তবে পূর্ব রণাঙ্গনের দীর্ঘ বিস্তৃত ও এবড়াে থেবড়াে ভূ-প্রকৃতির কারণে এখানে কোনাে নির্দিষ্ট সীমারেখা গড়ে ওঠেনি। পাশাপাশি এখানকার দীর্ঘ বিস্তৃতি হেতু প্রতিরক্ষা রেখা বরাবর সৈন্য মােতায়েনের ঘনত্বও ছিল বেশ কম। এক্ষেত্রে একবার কোনােক্রমে প্রতিরক্ষাব্যুহে ফাটল দেখা দিলে তা পুষিয়ে নেয়া বেশ কঠিন ছিল। পাশাপাশি যােগাযােগ ব্যবস্থা তেমন সুগঠিত না হওয়ায় একবার সৈন্যবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হলে নতুন করে সৈন্য এনে ক্ষতিপূরণ করটাও ছিল বেশ কঠিন একটা কাজ। এখানে প্রতিরােধ লড়াই যতটা সহজ ছিল বাইরে থেকে আক্রমণ করে সুবিধা অর্জন ছিল ঠিক ততটাই কঠিন। বলতে গেলে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত এখানে জার্মান বাহিনীই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। রুশ সেনাবাহিনী প্রথম পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ করে। তারা প্রশিয়ার একটি প্রদেশ এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরির গ্যালিসিয়া প্রদেশে হামলা করার চেষ্টা চালালে পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ বাধে। তবে ১৯১৪ সালের আগস্টে টানেনবার্গের লড়াইয়ে তাদের বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে। একই বছরের শরৎ আসতে না আসতেই তারা হানা দেয় গ্যালিসিয়ায়। এক্ষেত্রে তাদের দ্বিতীয় অভিযানকে অনেকাংশেই সফল বলা যেতে পারে। তারপর সেপ্টেম্বরে লাম্বার্গ যুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্রাকো ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সীমান্ত দুর্গ পারমিজাইলে অবরােধ শুরু করে। 

টানেনবার্গের সংঘাত 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একেবারে সূচনাপর্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা টানেনবার্গের যুদ্ধ। জার্মানির টানেনবার্গে অনুষ্ঠিত এ লড়াইয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রুশরা। রাশিয়ার পক্ষে আলেকজান্ডার সামসােনভ তার ১ লক্ষ ৫০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে জেনারেল পল ফন হিন্দেনবার্গের ২ লাখ ১০ হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য রুশ বাহিনীকে ছত্রখান করে দেয়। জার্মান পক্ষে ২০ হাজার নিহত হলেও তারা ৩০ হাজার রুশ সৈন্যকে হত্যার পাশাপাশি ৯৫ হাজার সৈন্যকে বন্দি করে। রুশ সাম্রাজ্য ও জার্মান রাইখের এ লড়াই অনেকাংশে যুদ্ধে জার্মানদের আরাে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখানে অষ্টম জার্মান আর্মির সঙ্গে রুশদের ফাস্ট ও সেকেন্ড আর্মির সংঘাত বাধলে রুশ সেকেন্ড আর্মি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসে। ১৯১৫ সালের বসন্তকাল আসা পর্যন্ত এ লড়াইয়ে রুশরা আর কিছুতেই ঘুরে দাড়াতে পারেনি। বিশেষ করে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই জার্মানরা রাশিয়াকে তাদের জন্য হুমকি মনে করত। এ লড়াইয়ের মাধ্যমে তারা রণাঙ্গনে তাদের প্রথম শত্রুকে চাপে রাখতে চেয়েছিল। আর যুদ্ধের প্রাথমিক ফলাফল হিসাব করা হলে এ এক্ষেত্রে জার্মানিকেই পুরােপুরি সফল বলাটা কোনােদিক থেকেই দোষের হবে না। 

আরো পড়ুন:  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব, সামরিকবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশ

পারমিজাইল দুর্গ অবরােধ

১৯১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে পারমিজাইল দুর্গ অবরােধ শুরু করে রুশ বাহিনী। এ অবরােধে রুশদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন তৃতীয় আর্মির কমান্ডার জেনারেল রাডকো দিমিত্রভ। অবরােধের শুরুতে পর্যাপ্ত সংখ্যক কামান না থাকায় তিনি একদফা হোঁচট খান। ১১ অক্টোবর পাল্টা হামলা চালিয়ে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বাহিনী। এদিকে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে ৯ নভেম্বর থেকে দুর্গ অবরােধ শুরু করে রুশরা। তখন দিমিত্রভের বাহিনীর কাছে পর্যান্ত কামান এসে না পৌছলেও তিনি বাহিনীকে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এদিকে পারমিজাইল দুর্গে রুশ অবরােধ দেখে জার্মানরাও থেমে থাকেনি। এসময় জেনারেল ফন ফন হিন্দেনবার্গ উত্তর দিকে ওয়ারশতে হামলা চালান। আর এর সাথে। মিল রেখে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির জেনারেল বারােয়িভিক ফন বােজনা দুর্গকে সহায়তা করতে পারমিজাইলের দিকে অগ্রসর হন। মূলত তিনি এগিয়ে আসাতেই দিমিত্রভ অবরােধ প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিলেন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সমর নেতা জেনারেল কাউন্ট ফন কনরাড ভেবেছিলেন ফন বােজনার আক্রমণেই কুপােকাত হয়ে যাবে রুশ বাহিনী। তবে ৩১ অক্টোবরে ভিক্ষুলা নদীতীরের লড়াইয়ে রুশ বাহিনী হিন্দেনবার্গের চৌকস সেনাদলকে একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ে। এতে ফন কডরাডের সব চিন্তা ধূলিসাত হয়ে যায়। তবে দুই পক্ষ থেকে তেমন কোনাে ছাড় দেয়ার মানসিকতা লক্ষ করা যায়নি। তাই ১৯১৫ সালের ২২ মার্চ দুর্গ পতন পর্যন্ত প্রায় ১৯৪ দিনের লড়াই চলে দু’পক্ষে।

ব্রাসিলভের লড়াই

১৯১৬ সালের গ্রীষ্মকাল মিত্রবাহিনীর জন্য এক নাজুক সময়। তখন পশ্চিম রণাঙ্গনে ব্রিটিশ হামলার ধার অনেকটাই কমে যায়। বিশেষ করে জার্মান বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণে ছত্রখান হওয়ার দশা হয় তাদের। এসময় উপায় না দেখে রুশদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে মিত্রবাহিনী। বিশেষ করে ভার্দুনে অবস্থানরত ফরাসি বাহিনী জার্মান আক্রমণে প্রায় দিশেহারা অবস্থায় পড়ে। তারা মনে করে এসময় রুশরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলে অন্তত এ যাত্রা রক্ষা পাবে তারা। এ ধরনের নানা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রুশ জেনারেল অ্যালেক্সি ব্রাসিলভের নেতৃত্বে পূর্ব রণাঙ্গনে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে শুরু হয় রুশ অভিযান। ব্রাসিলভের নামানুসারে এ অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘ব্রাসিলভ অফেনসিভ। রুশ জেনারেল স্টাফ স্টাভকার সামনে ব্রাসিলভ একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। সেখানে তার অভিযানের লক্ষ ছিল ফ্রান্সে ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনীর পাশাপাশি আইসনজো ফ্রন্টে ইতালীয় বাহিনীর ওপর থেকে চাপ কমিয়ে আনা। অন্যদিকে যেভাবেই হােক অস্ট্রো-হাঙ্গেরিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে জার্মানরা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পূর্ব রণাঙ্গনেও সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। এ হামলায় রুশদের পক্ষে প্রচুর হতাহত হলেও ফলাফল মিত্রবাহিনীর পক্ষে নিয়ে আসে। বিশেষ করে এ হামলার মধ্য দিয়েই টনক নড়ে জার্মানদের, তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে সব সৈন্যের সমাবেশ না করে তাদের অনেকগুলাে ইউনিটকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মােতায়েন করে পূর্ব রণাঙ্গনেও।। এতে আর যাই হােক তাদের হামলার ধার কমে যায় অনেকাংশে।

আরো পড়ুন:  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণক্ষেত্র এবং প্রচারণাগুলো হচ্ছে যুদ্ধের ধরন, রণক্ষেত্র এবং প্রচারণার রূপ

তথ্যসূত্র:

১. মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, [Pdf]. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি ২০১৯. সানজিদা মুস্তাফিজ ও সুমা কর্মকার. সম্পা. পৃষ্ঠা ৪২-৪৩; Retrieved from http://www.ebookbou.edu.bd/wp/OS/hsc4_2.php#hsc2855

Leave a Comment

error: Content is protected !!