কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ-এর ইতিহাস

উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে কার্ল মার্কসফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিজম শব্দটি ব্যবহার করেন। একটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন হিসেবে কমিউনিস্ট লিগ গঠনসুত্রে তাঁরা কমিউনিস্ট ইশতেহার (১৮৪৮) গ্রন্থে একটি দল অর্থে কমিউনিস্ট শব্দটির সূত্রপাত করেন। কার্যত কমিউনিস্ট শব্দটি ব্যাপক প্রচলন লাভ করে ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে বলশেভিকদের সঙ্গে অন্যান্য সােসাল ডেমােক্র্যাটদের শব্দটি নিয়ে তীব্র মতবিরােধের ফলে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে রাশিয়ান সােসাল ডেমােক্রেটিক লেবার পার্টির নামের শেষে বলশেভিক কথাটি যুক্ত হয়েছিল। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ থেকে পার্টির নামকরণ হয় রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক) এবং ১৯২৫ খ্রি ডিসেম্বর থেকে অল ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)। ১৯৫২ খ্রি যখন পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সােভিয়েত ইউনিয়ন নামে পরিবর্তিত হয় তখন বলশেভিক শব্দটি বাদ পড়ে।

১৯১৯ খ্রি মার্চ মাসে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠিত হয়। সেই সময় থেকেই পশ্চিম ইউরােপের সােসাল ডেমােক্রেটিক দলগুলি ক্রমে কমিউনিস্ট নাম পরিগ্রহ করে। অন্যান্য দেশেও কমিন্টার্নের বিশ্ববিপ্লবের আন্দোলনের কর্মসূচির ভিত্তিতে ক্রমে ক্রমে কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ গড়ে ওঠে।

১৯১৯ খ্রি অক্টোবর মাসে রাশিয়ার বাইরে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ গঠিত হয়েছিল মেক্সিকোয় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে। ওই বছর ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠার পক্ষকালের মধ্যে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির দুই প্রধান নেতা রােজা লুক্সেমবুর্গ ও কার্ল লিবনেট সরকারি বাহিনীর হাতে নিহত হন। হাঙ্গেরিতে বেলা কুন-এর নেতৃত্বে পার্টি গঠিত হয়, একটি গুপ্ত দল হিসেবে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বুলগেরিয়া, যুগােস্লাভিয়া, ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্স এবং তাসখন্দে মানবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে প্রবাসী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইতালিতে আন্তোনিও গ্রামশির উদ্যোগে পার্টি গঠিত হয় ১৯২১ সালে। একই বছরে চীনে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক চেন তু-সিউ এবং লি তা-চাও পার্টি-প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে পূর্ব ইউরােপের সব দেশেই প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি বেআইনি ঘােষিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর সেগুলি আইনগত অধিকার পায়। কমিন্টার্নের ২১ দফা শর্ত পূরণ সাপেক্ষ বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি তার সঙ্গে যুক্ত হবার অধিকার লাভ করত। লেনিনের পার্টি-সংক্রান্ত থিসিসের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার উপর গুরুত্ব আরােপ করা হত। শর্তপূরণে সমর্থ না হওয়ায় কোনও কোনও দেশের পার্টির সদস্যপদ চলে যায়। কমিন্টার্নের অধিকাংশ দেশের সদস্য-পার্টিই ছিল সেদিন বেআইনি গুপ্তদল।

আরো পড়ুন:  মঙ্গোলিয়া গণপ্রজাতন্ত্রের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা

কমিটার্ন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন অল্পবিস্তর তাৎপর্যপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়। ইতালিতে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের শ্রমিক আন্দোলনেও কমিউনিস্টদের ছিল প্রবল প্রভাব। কিন্তু ব্রিটেনে কমিউনিস্ট পার্টি একটি নগণ্য দল হিসেবে পরিগণিত হয়। ব্রিটিশ পার্টির নির্দেশে ভারতীয় কমিউনিস্টদের চিরকাল নীতি নির্ধারিত হত।

দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে চেকোস্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি খুবই শক্তিসম্পন্ন হয়ে ওঠে। ওই সময়ে বুলগেরিয়ায় কমিউনিস্টদের এক বিপ্লব-প্রয়াস ব্যর্থ হয়। স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু কমিউনিস্টরা সােভিয়েতের সাহায্যে বামপন্থী সরকারের সঙ্গে সবিশেষ সহায়তা করে। হাঙ্গেরিতে কুড়ির দশকে কমিউনিস্টরা কিছুকাল ক্ষমতাসীন হয়েছিল। 

১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর কমিন্টার্নে স্তালিন ও ত্রৎস্কির বিরােধ এবং পরে স্তালিনের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও উগ্র কর্মপন্থা বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও সঞ্চারিত হয়। সােসাল ডেমােক্র্যাটদের সঙ্গে বিরােধসূত্রে জার্মান কমিউনিস্টরা কুড়ির দশকে নাৎসিদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। কমিন্টার্নের যষ্ঠ কংগ্রেসে (১৯২৮) লেনিনের যুক্তফ্রন্ট নীতি পরিত্যক্ত হয়।

ভারতে জাতীয় কংগ্রেস সহ নেহরু-বসু-আয়েঙ্গারের নেতৃত্বে উদীয়মান বামপন্থী আন্দোলনকে নিন্দা জানানাে এবং ওয়াকার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টি ভেঙে দেবার নির্দেশ দেওয়া হয় ভারতীয় কমিউনিস্টদের। ত্রিশের দশকের গােড়ায় ইউরােপে ফ্যাসিবাদী শক্তি উত্তরােত্তর প্রবল হয়ে ওঠে ও কমিউনিস্ট নিধন শুরু করে। সপ্তম কংগ্রেসে (১৯৩৫) সচকিত কমিন্টার্ন তার পরিত্যক্ত যুক্তফ্রন্ট নীতি পুনগ্রহণ করে; সােসাল ডেমােক্র্যাট ও অন্যান্য গণতন্ত্রীদের সঙ্গে বিরােধ মিটিয়ে ফেলা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির তাৎপর্য অনুধাবনে বার্থতার ফলে, জার্মানি কর্তৃক রুশদেশে অভিযানের পূর্বে ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে অগ্রগামী নাৎসিদের সঙ্গে কমিউনিস্টরা সখ্যতা স্থাপন করেছিল; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে জাপানি বাহিনীকে স্বাগত জানানাে হয়। অচিরেই ইউরােপে কমিউনিস্টদের উপর খাঁড়া নেমে আসে। যুগােস্লাভিয়া প্রভৃতি দেশে কমিউনিস্টরা তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তােলে। যুদ্ধের পর সােভিয়েত সরকারের সহায়তায় পূর্ব ইউরােপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টরা ক্রমে ক্ষমতাসীন হয়। চীন, কোরিয়া, ইন্দোচীনেও কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হয়।

আরো পড়ুন:  নিকারাগুয়া দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস এবং বিপ্লবের পরাজয়

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট শাসন কায়েম হয়। ক্রমে মার্কসীয় তত্ত্ব ও কমিউনিস্ট প্রশাসনের নানাবিধ অসঙ্গতি নিয়ে সারা দুনিয়ার সুবিধাবাদী বুর্জোয়া অধ্যাপক লেখকদের ভেতরে বিতর্ক ও বিভেদ দেখা দেয়। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি যে সব দেশে পার্টি ছিল প্রবল, সেগুলিতে মতাদর্শের পরিবর্তন ও কমিউনিস্ট শব্দটিরও বর্জন দেখা দেয়। নব্বইয়ের দশকের গােড়ায় পূর্ব ইউরােপ ও সােভিয়েত দেশে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান এবং চীনে ব্যক্তিগত মালিকানায় বাজার অর্থনীতির প্রবর্তন বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে।

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭০-৭২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!