খাকসার ছিলো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ ও প্রাণীর সেবাকারী আন্দোলন

অমৃতসরের অধিবাসী ইনায়াতুল্লাহ খাঁ (১৮৮৮-১৯৬৩) ইসলাম ধর্ম ও তার আদি ঐতিহ্যের আদর্শে ১৯৩১ সালে খাকসার দল (ইংরেজি: Khaksar Movement) গঠন করেন। খাকসার কথাটি পারসি ভাষা থেকে গৃহীত। শব্দটির অর্থ (খাক + সার) মাটির ধূলা । খাক’-এর অর্থ ধূলা এবং ‘সার’ মানে জীবন। যিনি খাকসার হবেন তাঁকে মাটির ধুলার মতাে বিনয়ন হতে হবে। আন্দোলনের মূল আদর্শ হলো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ ও প্রাণীর সেবা এবং ব্যক্তিপূজার বিরােধিতা। ভারতে ইসলামের প্রাধান্য স্থাপনই ছিল দলের উদ্দেশ্য। আধ্যাত্মিক আদর্শের সঙ্গে সামরিক ভাবভঙ্গি থাকলেও সেবা ও ভ্রাতৃত্বের উপর গুরুত্ব আরােপের দরুন এই মতবাদে ধর্মান্ধতা ও জাতিবিদ্বেষ স্থান পায়নি।

গণশত্রু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কিংবা ব্রিটিশ অনুগত মুসলিম লিগের প্রতি অথবা হিজরত ও খিলাফত আন্দোলনের দিকে ইনায়াতুল্লাহ আকৃষ্ট হননি। ইসলাম ধর্ম আরবদেশে প্রবর্তিত হবার পর সেখানকার প্রথম আমলের মুসলমান সমাজজীবন তাঁকে প্রভাবিত করে। অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি ইসলাম যথােচিত উদার, এই মনােভাব নিয়ে তিনি ভারতে মুসলমান শাসন ও কোরান ব্যাখ্যা করেন। বিপুল বিদ্যাবত্তা ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইনায়াতুল্লাহ কোরানের মূল বিষয়কে নিয়ে উর্দু ভাষায় ১৯২৪ সালে গদ্যে ‘তাজকেরা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার জন্য কায়রাের জামেউল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘আল্লামা মশরেকি অর্থাৎ প্রাচ্যের বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রদান করেন।

ইনায়াতুল্লাহ খাঁ মনে করতেন যে ভারতবর্ষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও গোঁড়া মােল্লা ও মৌলবীরা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের উপর গুরুত্ব আরােপ করে মুসলমান সমাজকে অকর্মণ্য করে রেখেছে। ফলে ভারতের মৌলবীরা ফতােয়া জারি করে তাঁকে কাফের বলে নিন্দা করেন। তাঁর মতে ইসলাম ধর্ম হলো সৈনিকের ধর্ম এবং মুসলমানেরা যদি ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে প্রমাণিত করতে চায় তা হলে তাদের কর্তব্য হবে সৈনিকের জীবন যাপন করা; তা হলে হজরত মহম্মদের নির্দেশ সামনে রেখে ভারত তথা সারা পৃথিবীতে মুসলমানেরা পুনরায় আধিপত্য স্থাপন করতে পারবে।

আরো পড়ুন:  বঙ্গ দেশের পশ্চিমদিকের ভূখণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গ যা বর্তমানে দিল্লির অধীন একটি অঙ্গরাজ্য

ইনায়াতুল্লাহ একথা উপলব্ধি করেন যে, ভারতের মতাে দেশে খাকসার আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে কতকগুলি কর্মপন্থার উপর, যেমন ১. অমুসলমানদের ধর্ম ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি যথােচিত মর্যাদা প্রদর্শন, ২. তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা এবং ৩. বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহনশীলতা রক্ষা করা। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইনায়াতুল্লাহ চোদ্দ দফার এক কর্মসূচি প্রচার করেন। সেগুলির বিভিন্ন নির্দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল মৌলবীতন্ত্রের পরিবর্তে ইসলামের বিধিবিধানের প্রবর্তন, প্রতি ধর্মের অধিকার বজায় রাখা, জাতীয় ধনভাণ্ডার স্থাপন, ব্যবসায়ীদের পারস্পরিক সহযােগিতা, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও মুসলমান সমাজের ভিতর ভেদাভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী নেতা, সম্পাদক, সাংবাদিক ও অনুরূপ অন্যান্য ব্যক্তিদের প্রতিরােধ করা ইত্যাদি।

ইংরেজদের তিনি ভারতের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকরূপে দেখেননি, সেজন্যে জাতীয় স্বাধীনতার কোনও আন্দোলনে যােগ দেননি। অবশ্য তিনি একথা মনে করতেন যে খাকসারদের বিশ্বে আধিপত্য স্থাপনের অন্তরায় হলো ব্রিটেন। সে হিসেবে ইংরেজরা খাকসারদের রাজনৈতিক শত্রু। তিনি কমিউনিজমের সমর্থক না হলেও বিরােধী ছিলেন না। তবে সাধারণ খাকসাররা নাৎসিদের গুণগ্রাহী ছিল।

ইনায়াতুল্লাহ ছিলেন খাকসার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক; প্রদেশগুলিতে কেন্দ্রের অধীনে প্রাদেশিক নেতারা ছিলেন কর্তা। তদধীনে থাকত জেলা শাখা। খাকসারদের শ্রেণীবিভাগ ও কর্মবিভাগ ছিল। পরিধানে সামরিক পােষাক, মাথায় রঙিন রুমাল এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে সবাইকে বেলচা বহন করতে হত। মুসলমান খাকসারদের নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক এবং হিন্দু খাকসারদের মন্দিরে গীতাপাঠ ও উপাসনা হতো। লাহােরে ছিল সদর দপ্তর।

খাকসার দল ক্রমে ২৫০০ শাখায় শক্তিসম্পন্ন হয়ে ওঠে এবং সারা ভারতে বিস্তৃত হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ বৃদ্ধি পায়। সরকারের কাছে স্বীকৃতি হিসেবে নানারকম দাবিদাওয়া উত্থাপন করা হয়। উত্তর প্রদেশ, সিন্ধু ও পঞ্জাবে খাকসারদের প্রতাপ বেশি থাকায় প্রাদেশিক সরকারগুলিও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ত্রিশের দশকের শেষদিকে উত্তর প্রদেশ কংগ্রেস সরকার সেবামূলক কাজের জন্য খাকসারদের প্রতি নমনীয় মনােভাব গ্রহণ করে। উত্তরপ্রদেশে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালের বিরােধ ও হিংসাত্মক সংঘর্ষ নিবারণের জন্য খাকসারেরা হস্তক্ষেপ করায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। সরকারের সঙ্গেও খাকসারদের বিরােধ শুরু হয়। লখনৌতে ইনায়াতুল্লাহ গ্রেপ্তার হন। সারা দেশে খাকসারদের সরকার-বিরােধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম লিগ খাকসার সমস্যা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। ইনায়াতুল্লাহ লিগকে প্রশ্রয় দেননি। নিঃশর্তে মুক্তির পর তিনি দিল্লি চলে যান। অচিরে পাঞ্জাবে খাকসাররা লিগ সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রাদেশিক সরকার খাকসার দলকে নিষিদ্ধ করে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুতেও খাকসার দলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বহু খাকসার নিহত ও কারারুদ্ধ হন।

আরো পড়ুন:  মোগল সাম্রাজ্যের সমাজ চিন্তা ও গণ আন্দোলন

১৯৪১ খ্রি খাকসারেরা গােপন বিদ্রোহের আয়ােজন করে। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বেআইনী ঘােষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময় ইনায়াতুল্লাহ ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সহযােগিতার প্রস্তাব করেন। তখন তিনি পুনরায় কারাগারে আবদ্ধ হন। তিনি অনশন শুরু করেন, পরে বেলচাসহ সামরিক কুচকাওয়াজের রীতি পরিহারের শর্তে তিনি মুক্তি পান (১৯৪২)। কংগ্রেস ও লিগ ইনায়াতুল্লাহকে তাদের দলে যােগ দেবার আহ্বান জানায়। কিন্তু তিনি গান্ধী নীতির প্রতি যেমন বিরূপ ছিলেন, তেমনি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে সমর্থন করতেন না। যুদ্ধের সময়ে তিনি কোনওভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিব্রত করার বিরােধী ছিলেন; সাম্প্রদায়িক বিভেদমুক্ত ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভারত গঠনে সচেষ্ট হন। গান্ধী ও জিন্নাহর কাছে তিনি ঐক্যের আবেদন জানান। বঙ্গদেশের দুর্ভিক্ষে (১৯৪৩) খাকসারেরা সেবামূলক কাজে অংশ নেয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে মুসলমান আসনে কোনও প্রদেশেই খাকসার দল সফল হয়নি। মুসলিম লিগ প্রার্থীরা জয়ী হন। খাকসার দল মুসলমান সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দল ক্রমে অবলুপ্ত হয়ে যায়। দেশবিভাগের পর ইনায়াতুল্লাহ ও অন্যান্য খাকসার নেতারা পাকিস্তানে থেকে যান। কিন্তু শাসকদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল না। তিনি পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতির বিরােধী ছিলেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহুসংখ্যক সমর্থক নিয়ে কাশ্মীরের মুক্তির জন্য এক অভিযানে যুক্ত হন; পরে অভিযানের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮৬-৮৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!