খিলাফত আন্দোলন বা খেলাফত আন্দোলন বা ভারতীয় মুসলিম আন্দোলন (ইংরেজি: Khilafat Movement) ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের ফলে ভারতীয় মুসলিমদের ভীতি থেকে উদ্ভূত ইসলামি জাগরণপন্থী আন্দোলন।[১] এ আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন আলী ভ্রাতৃদ্বয়-মুহাম্মাদ আলী (১৮৭৮-১৯৩১) এবং শওকত আলী (১৮৭৩-১৯৩৮)। নামে ধর্মীয় হলেও তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান প্রতিষ্ঠান ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনপুষ্ট হয়ে একটি জাতীয় আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে এবং মূলত একটি অসহযোগ আন্দোলন বলে অভিহিত হয়। এই আন্দোলনের মূলে ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে তুরস্কের সুলতান তথা খলিফার উপর আক্রমণাত্মক আচরণ। ভারতের মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন থাকলেও ১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্ক এর সমর্থনহীনতার কারণে এবং খেলাফতের অপসারণে ভারতে খেলাফত আন্দোলন বাতিল হয়ে যায়।[২]
খিলাফত শব্দটি খলিফা শব্দ থেকে উৎপন্ন। শব্দটির অর্থ উত্তরাধিকারী; হজরত মহম্মদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার যে-সংস্থার প্রতিভূর উপর বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে বর্তিয়েছিল সেই সংস্থার নাম খিলাফত। মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজের প্রধান হিসাবে খলিফার নানান কর্তব্যের মধ্যে ধর্মরক্ষা, আইন নির্দেশ ও বিচার, শান্তিরক্ষা, শাস্তিবিধান, রাষ্ট্র রক্ষা, জিহাদ, লুণ্ঠিত দ্রব্য বিতরণ, সৈন্যদের বেতন ও পুরস্কার প্রদান, রাজকর্মে নিয়ােগ ও রাষ্ট্রকার্যে অংশগ্রহণ ছিল প্রধান। পােপের মতাে খলিফার কোনও আধ্যাত্মিক অধিকার ছিল না। বিভিন্ন সময় ও স্থানে উন্মৈয়দ, আব্বাসিদ, অটোম্যান প্রভৃতি রাজবংশের অধিকারে খিলাফত পরিচালিত হয়।
প্রথম বিশ্ব-মহাযুদ্ধের কালে খিলাফত আন্দোলন সবচেয়ে বড় ধর্মীয় পুনর্জাগরণের জোয়ার সৃষ্টি করে ও ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন যােগায়। এই আন্দোলনের পশ্চাৎপট ছিলো তুরস্কের অটোম্যান বংশের সুলতান যিনি খলিফা হিসেবে ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগের উৎস ছিলেন, তাঁর ধারাবাহিক অবমাননা ও অবলুপ্তি।
১৯১১-১২ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের সঙ্গে ইতালির যুদ্ধ এবং ১৯১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের বিরুদ্ধে দুটি বলকান যুদ্ধের সময় ভারতীয় মুসলিম সমাজে বিরাট চাঞ্চল্য দেখা দেয়। ১৯১৪-১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্ব-মহাযুদ্ধে তুরস্ক ইংরেজদের বিরুদ্ধে জার্মানির পক্ষে ছিল। তুরস্ক ও জার্মানির পক্ষকে সমর্থনের জন্য যুদ্ধের সময় সৌকত আলি ও মহম্মদ আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে ভারত সরকার অন্তরিন করে। যুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর মিত্রপক্ষ যখন অটোম্যান তুরস্কের ক্ষমতা খর্ব করে, তখন ভারতীয় মুসলিম সমাজে প্রবল অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় মুসলিম সমাজ ও সেনানীদের সমর্থন অর্জনের জন্য ইংরেজ সরকার তুরস্ক সাম্রাজ্য সম্পর্কে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয় সেগুলি যুদ্ধের পর রক্ষা করা হয়নি বলে মুসলিম নেতৃবৃন্দ অভিযােগ করেন।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে জাতীয় স্তরে একটি খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। ২৭ অক্টোবর তারিখটি সারা দেশে খিলাফত দিবস হিসেবে পালিত হয়। আবুল কালাম আজাদ, ফজলুল হক, আক্রাম খাঁ, লখনৌ-এর উলেমারা ও দেওবন্দ বিদ্যায়তনের শিক্ষকেরা দিবসের তাৎপর্য প্রচার করেন। ২২ নভেম্বর দিল্লিতে ‘ অনুষ্ঠিত খিলাফতিদের প্রথম সম্মেলনে গান্ধী, শ্রদ্ধানন্দ, মালব্য এবং মুসলিম নেতৃবর্গের মধ্যে মৌলানা আবদুল বারি, হযরত মােহানি, হাকিম আজমল খাঁ ও আসফ আলি উপস্থিত ছিলেন। এই খিলাফত সম্মেলনেই গান্ধীর মনে অসহযোগের চিন্তা প্রথম দানা বাঁধে।
আলি ভ্রাতৃদ্বয় অন্তরিন থেকে মুক্তি পান। ৩১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় খিলাফত সম্মেলন বসে। পরে জানুয়ারিতে এম এ আনসারি বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিষয়টি আন্তর্জাতিক ছিল বলে কোনও ফয়সালা হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে সৌকত আলি ঘােষণা করেন যে যুদ্ধের পরে শান্তি চুক্তিতে মুসলিম ধর্মীয় আবেগে আঘাত লাগায় মুসলমানের অতঃপর ইংরেজ সরকারের প্রতি অনুরক্ত থাকবে না। ১০ মার্চ ১৯২০ তারিখে গান্ধী বিবৃতি দেন যে মুসলমানদের খিলাফতি দাবি না মিটলে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হবে। ১৭ মার্চ ভারত থেকে একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তাঁরা নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন।
তুরস্কের সঙ্গে মিত্রপক্ষের সম্পাদিত চুক্তিতে তুরস্কের অখণ্ডতা বিনষ্ট হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে চতুর্মুখী অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসুচি গৃহীত হয়। মে মাসে বেনারসে এ আই সি সি এবং জুন মাসে এলাহাবাদে কেন্দ্রীয় খিলাফত সম্মেলনে গান্ধী তাঁর অসহযােগ আন্দোলনের প্রস্তাবে অনড় থাকেন। বিষয়টি মূলত ধর্মীয় এবং দ্বিতীয়ত ইসলামের একজন ধর্মগুরুর পূর্বতন মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে ইংরেজ সরকারের উচ্ছেদকল্পে আফগানিস্তানকে ভারত অভিযানে আমন্ত্রণ জানানাের অভিপ্রায় থাকায় অ্যানি বেসান্ত, মােতিলাল নেহরু, লাজপত রায়, টিলক ও মালব্য অসহযােগ আন্দোলন অবাস্তব বলে মনে করেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের আবেগের তাড়নায় বহিভারতীয় কোনও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে ভারতের জাতীয় দাবিকে যুক্ত করার কুফল সম্পর্কে বিপিনচন্দ্র পাল দেশবাসীকে সাবধান করে দেন। অধিকাংশ কংগ্রেস কমিটি গান্ধীর এই প্রস্তাবে সায় দিতে পারেনি। সেপ্টেম্বরে কলকাতায় এক বিশেষ অধিবেশনে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ভােটে গান্ধীর অসহযোগ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই অধিবেশনে কংগ্রেস ভারতে জাতীয় দাবি সমূহের সঙ্গে খিলাফতকে যুক্ত করে এবং চতুর্মুখী অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত করা হয়।
এরপর ডিসেম্বরে নাগপুরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে মূল প্রস্তাবের সঙ্গে স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যও যুক্ত হয়। নাগপুর অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন ও লাজপত রায় বিরােধিতা ছেড়ে গান্ধীর প্রস্তাব সমর্থন করেন। মালব্য ও জিন্নার বিরােধিতা ছিল নগণ্য।
অসহযােগ আন্দোলনের সঙ্গে যৌথভাবে খিলাফত আন্দোলন বৎসরাধিককাল চলে। নেতৃবৃন্দের অনেকেই কারারুদ্ধ হন। আন্দোলন ক্রমে হিংসাত্মক হয়ে পড়ে, যেটা সুবিধাবাদী গান্ধীর আদর্শের বিরােধী ছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে গােরখপুর জেলায় চৌরিচৌরা থানা অঞ্চলে হত্যাকাণ্ডসূত্রে তিনি অসহযােগ ও আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে মুস্তাফা কামাল পাশা ক্ষমতাসীন হয়ে খিলাফতের বিলােপ সাধন করেন। একই দেশে দুটি সমান্তরাল রাষ্ট্রশক্তির অবসান ঘটিয়ে তিনি তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ করায় ১২৯০ বছরের প্রাচীন খিলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে। তুরস্কের শেষ সুলতান ও খলিফা সুইজারল্যান্ডে জীবন অতিবাহিত করেন। ভারতের জাতীয় আন্দোলনে মুসলমানদের সম্পর্ক ও সমর্থন কালক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮৮-৯০।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৫২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।