মোগল সাম্রাজ্যের সমাজ চিন্তা ও গণ আন্দোলন

আকবরের শাসনামলে গণ-আন্দোলন:

আবুল ফজলের বাবা শেখ মুবারক ‘মাহদি’বাদী আন্দোলনের অনুসারক ছিলেন এবং এই আন্দোলন আবুল ফজলের চিন্তাধারাকে বহুলাংশে প্রাভাবিত করেছিল। শহরের মুসলিম ব্যবসায়ী ও কারুশিল্পীদের মধ্যে প্রসারলাভ করে এই আন্দোলনটি। পঞ্চদশ শতকে গুজরাটে মীর সয়ীদ মুহম্মদ (১৪৪৩ থেকে ১৫০৫ খ্রীস্টাব্দ) নামে এক প্রখ্যাত পণ্ডিত নিজেকে ‘মাহদি’ (অর্থাৎ, মানবজাতির ত্রাণকর্তা বলে ঘোষণা করেন। তিনি সমধর্মীদের কাছে আহবান জানান ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক যুগের গণতান্ত্রিক নীতিগুলি পুনর্বার অঙ্গীকার করতে ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পত্তির সমানাধিকারের অবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে। গুজরাটের ‘মাহদি’-সম্প্রদায়ের মধ্যে এই শেষোক্ত নীতিটি কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হতো; সম্প্রদায়ভুক্ত প্রতিটি মানুষের অর্জিত অর্থ জমা পড়ত সাধারণ একটি তহবিলে এবং তারপর সমানভাবে তা সকলের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হতো। ‘মাহদি’বাদী আন্দোলনের অনুসারীরা অবশ্য ‘ভক্তিবাদী আন্দোলনের সমর্থকদের মতো হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে প্রচার চালাতেন না, তাঁদের আবেদন সীমাবদ্ধ থাকত কেবলমাত্র মুসলমানদের মধ্যে। ‘মাহদি’বাদীরা আশা করতেন কোনো একদিন এক যথার্থ ন্যায়পরায়ণ শাসক সিংহাসনে বসবেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রথম যুগের নীতিগুলি তিনি অনুসরণ করবেন ও মুসলমান সমাজের মধ্যে সমানাধিকার সম্পর্কিত নীতিগুলিকে করে তুলবেন কার্যকর।

শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহের রাজত্বকালে ‘মাহদি’বাদীরা আক্ষরিক অর্থেই দোয়াবের বিয়ানা ও হিন্দিয়া এলাকাদুটি দখল করেন এবং বলপ্রয়োগে তাঁদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন বিয়ানা শহরে। অতঃপর সম্পত্তি ও সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয় সমভাবে বণ্টনের নীতিটি ‘মাহদি’-সম্প্রদায়ের মধ্যে আবার একবার প্রবর্তিত হল। শহরের বাসিন্দারা ছাড়াও ‘মাহদি’বাদীদের সঙ্গে যোগ দিলেন ‘রায়ত’রা, গ্রামীণ কারুশিল্পীরা এবং পুর্বোক্তি শেখ মুবারকসহ ইসলাম শাহের শাসনের বিরোধী কিছু কিছু সামন্ত-ভূস্বামীও। ইসলাম শাহ, এর প্রত্যুত্তর দিলেন দমননীতি কায়েমের মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের একজন নেতাকে তিনি হত্যা করলেন লাঠিপেটা করে, অপর একজনকে শাস্তি দিলেন এবং বাকিদের ওপর উৎপীড়ন চালালেন। ১৫৪৯ খৃস্টাব্দ নাগাদ শেষপর্যন্ত আন্দোলনটিকে দমন করা হলো। ফের একবার ১৫৭৩ খ্রীস্টাব্দে দিল্লীতে ও পাঞ্জাবে পুনরুজ্জীবিত হয় এই ধর্ম আন্দোলনটি, তবে এবার আর কোনোরকম বিদ্রোহ কিংবা অভ্যুত্থান ঘটে নি।

ওই যুগের অপর একটি অরক্ষণশীল ধর্মমত (পরবর্তী যুগের ‘ভক্তিবাদী মতাদর্শের সঙ্গে যা ছিল সম্পর্কিত হলো শিখবাদ, যে-মতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘গুরু’ (অর্থাৎ শিক্ষাদাতা ও নেতা) নানক। আকবরের রাজত্বকালে শিখরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন পাঞ্জাবের মধ্যে এবং এই সম্প্রদায়টি তখন গঠিত ছিল বণিক ও কারুশিল্পীদের নিয়ে। শিখ-সম্প্রদায়ের চতুর্থ গুরু, রামদাসের আমলে (১৫৭৪ থেকে ১৫৮১ খ্রীস্টাব্দ) তিনি অমৃতসরের কাছে কিছু জমি লাভ করেন এবং সেখানে শিখরা একটি মন্দির (বা ‘গুরুদ্বার) নির্মাণ ও একটি পুত জলের পুষ্করিণী খনন করেন। বিশেষভাবে নিযুক্ত ও ভারপ্রাপ্ত কর্মীদের সাহায্যে রামদাস ব্যবস্থা করেন পুজার উপচার হিসেবে নিয়মিত অর্থ ইত্যাদি সংগ্রহের এবং তাঁর পরবতী গুরু অর্জনদেব (১৫৮১ থেকে ১৬০৬ খ্রীস্টাব্দ) একদা যা ছিল ঐচ্ছিক দান তাকে পরিণত করেন নিয়মিত দানে। শিখদের প্রভুত্বের অধীন জেলায় যত লোক বাস করতেন তাঁদের সকলের কাছ থেকে, অর্থাৎ পরিবার-পিছু, এই কর আদায় করা হতে লাগল। আকবর শিখধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং একটি শিখ-উপাখ্যান অনুযায়ী কথিত আছে যে তিনি গুরু রামদাসের সঙ্গে ধর্মালোচনা করেছিলেন।

আরো পড়ুন:  ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ ছিলো তিন গণশত্রুর পারস্পরিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত

রাজপুতানায় ওই সময়ে ‘ভক্ত’ দাদু, (১৫৪৪ থেকে ১৬০৩ খ্রীস্টাব্দ) রাজপুতদের রাজ্যগুলিতে পরিভ্রমণ করে মানুষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছিলেন আত্মসমর্পিত ভাব, বিনয় ও প্রেমের চর্চা করতে। তৎকালীন এক উপাখ্যান অনুযায়ী দাদুও নাকি আকবরের সঙ্গে আলাপ করার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তবে আকবর হিন্দি ভক্তকবি তুলসিদাসকে জানতেন বলে মনে হয় না। তুলসিদাসের সুদীর্ঘ কাব্য রামচরিতমানস’ (রামায়ণ) (১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দ) দুত ভারতের হিন্দিভাষী জনসাধারণের মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই কাব্যে তুলসিদাস কলম ধরেন জাতিভেদ-প্রথা ও সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে; চারপাশের জগতে ভণ্ডামিরও সমালোচনা করেন তিনি, তবে তাঁর মতে এ-থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হল রামচন্দ্রের অবতার-মতিতে আবির্ভূত ঈশ্বরের সঙ্গে অতীন্দ্রিয় মিলনের মধ্য দিয়ে।

তবে মোগল শাসনাধিন ক্ষমতার বিরুদ্ধে পরিচালিত ধর্ম-সম্প্রদায়ের আন্দোলনগুলিকে দৃঢ় হস্তে দমন করার প্রয়াস পান আকবর। মুসলিম রোশনিয়া ধর্মসম্প্রদায়কে দমন করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন তিনি। বেশ কয়েকটি আফগান উপজাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে ইউসুফজাইরা, রোশনিয়া ধর্ম-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই ধর্ম-আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বায়াজিদ আনসারি (১৫২৪ থেকে ১৫৮৫ খ্রীস্টাব্দ)। সে-সময়ে যে-সমস্ত আফগান অভিজাত-বংশীয় তাঁদের ভূ-সম্পত্তিগুলি সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচে পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে এবং মোগল-সাম্রাজ্যেও জনসাধারণকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালাতেন আনসারি। ১৫৮৫ থেকে ১৬০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে আকবর রোশনিয়া-সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পিটুনি-অভিযান পাঠান। রোশনিয়ার ওই সময়ে ভারত ও কাবুলের মধ্যে সংযোগ-রক্ষাকারী গিরিবর্ত্মগুলি দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছরব্যাপী যুদ্ধে আকবরের সেনাবাহিনী গুরুতরভাবে পরাস্ত হয় কয়েকবার। পরিশেষে অবশ্য আকবর আফগান বোশনিয়াদের অভ্যুত্থানগুলি দমন করতে সমর্থ হন, তবে তাঁর মত্যুর পর ফের অস্ত্রধারণ করেন রোশনিয়া-সম্প্রদায়।

জাহাঙ্গীরের শাসনামলে রোশনিয়া ও শিখদের গণ-আন্দোলন:

সপ্তদশ শতকের শুরুতে ইউসুফজাই-উপজাতিগোষ্ঠী রোশনিয়া ধর্মান্দোলন থেকে বেরিয়ে যায়, তবে অনান্য আফগান উপজাতিরা ও বিশেষ করে বাঙ্গাশি-উপজাতিগোষ্ঠীটি তখনও এই আন্দোলনের সমর্থক থেকে যায়। রোশনিয়াগোষ্ঠী এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন মোগল-শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কৃষকের মূলত সামন্ততন্ত্র-বিরোধী সাম্য অর্জনের স্বপ্ন দেখার ফলে। এই সময়ে রোশনিয়া-গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন পূর্বোক্ত বায়াজিদ আনসারির পৌত্র আহদাদ। ১৬১৯ খ্রীস্টাব্দে আহদাদ কাবুল দখল করতে সমর্থ হন, কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই শহর থেকে বিতাড়িত হন তিনি। মোগলদের পিটুনি অভিযানগুলিকে প্রায়ই রোশনিয়াদের অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে পাঠানো হতো, আগ্রাসক সৈন্যদলের ওপর নির্দেশ থাকত রোশনিয়া-সম্প্রদায়ের কোনো লোককে দেখতে পেলেই তাঁকে হত্যা করতে । রোশনিয়া:গোষ্ঠীরই ভেতরকার বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্যে মোগলরা শেষ পর্যন্ত রোশনিয়াদের সদর-ঘাঁটি ধ্বংস করে দিতে সমর্থ হন। বিদ্রোহীদের মধ্যে যাঁরা প্রাণে বেচে যান তাঁর পালিয়ে যান দুর্গম পার্বত্য-অঞ্চলে। বহু বছর ধরে পশ্চাদ্ধাবন করার পর ১৬২৬ খীস্টাব্দে আহদাদকে হত্যা করা সম্ভব হয়। অতঃপর অন্যান্য নেতা সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর স্থান নেন এবং একমাত্র ১৬৩০’এর দশকের শেষদিকে রোশনিয়া আন্দোলন নেতৃহীন হয়ে পড়ায় তা দুর্বল হয়ে পড়ে।

আরো পড়ুন:  ভারতে বৃটিশ শাসন

ইতিমধ্যে শিখরা গোপনে পরিকল্পনা আঁটছিলেন মোগলদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার। গুরু হরগোবিন্দ (১৬০৬ থেকে ১৬৩৮ বা ১৬৪৫ ধীস্টাব্দ) নির্দেশ দেন প্রতিজন শিখকে অস্ত্রধারণ করতে ও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে। বেশ কয়েক হাজার শিখের কয়েকটি বাহিনী তাঁর ডাকে সাড়া দেন। এই বাহিনীগুলির আয়ত্তে কামান পর্যন্ত ছিল। ১৬১২ খ্রীস্টাব্দে গুরু হরগোবিন্দকে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসতে আহ্বান জানানো হয়। তাঁর বাহিনীগুলিকে অটুট রাখার বাসনায় মোগলদের অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন হরগোবিন্দ তবে সেইসঙ্গে তাঁর যোদ্ধাদেরও গোপনে অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু তাঁর আচার-আচরণে এত বেশি স্বাধীনচেতার ভাব প্রকাশ পায় যে শেষপর্যন্ত কারারুদ্ধ করা হয় তাঁকে। বারো বছর তিনি এইভাবে কারারুদ্ধ অবস্থায় থাকেন।

১৬২৮ থেকে ১৬৩৪ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে পঞ্জাবের মোগল-নিয়োজিত শাসনকর্তারা বেশ কয়েকবার পিটুনি-সৈন্যদল পাঠান শিখদের বিরুদ্ধে। তবু সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের সময়কালের মধ্যে তাঁদের দমন করা অসম্ভব বলে প্রতিপন্ন হয়।

শাহ জাহানের আমলে গণ-আন্দোলনসমূহ

যদিও এই সময়কার ইতিবৃত্তগুলিতে বড়রকমের কোনো গণ-আন্দোলনের উল্লেখ নেই, তবু মোগল-শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অবসান ঘটে নি এযুগে। পঞ্জাবে শিখ-সম্প্রদায় বারেবারে দাঁড়িয়েছেন মাথা তুলে, তাঁদের বিরুদ্ধে শাহ জাহান তিন-তিনটি পিটুনি-অভিষান (১৬২৯, ১৬৩০ ও ১৬৩১ খীস্টাব্দে) প্রেরণ করা সত্ত্বেও বাংলায় তথাকথিত ‘দস্যু’দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চলেছে অবিচ্ছিন্নভাবে। দোয়াবে কৃষক-অভ্যুত্থান ঘটলে ১৬২৯ খ্রীস্টাব্দে ‘রায়ত’দের শায়েস্তা করার জন্যে সৈনাদল পাঠানো হয়। ১৬৫০ খ্রীস্টাব্দে এই একই অঞ্চলে মেওয়াতি-উপজাতি বিদ্রোহ করে ও পরে পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, ওদিকে দশ হাজার মোগল-সৈন্য গোটা জঙ্গল-এলাকা চষে ফেলে, মেওয়াতিদের গ্রামগুলি দেয় পুড়িয়ে আর মেওয়াতিদের মধ্যে যাঁরা প্রাণে বেঁচে যান তাঁদের বন্দী করে নিয়ে যায়।

তথ্যসূত্র:

১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩৩১-৩৩৩,৩৩৭,৩৪৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!