বাঙালির যুদ্ধচিন্তা হচ্ছে বঙ্গ অঞ্চলের জনগণের নিজ সম্পদ রক্ষার সাধারণ লড়াই

বাঙালির যুদ্ধ সংক্রান্ত চিন্তা হচ্ছে বঙ্গ অঞ্চলের জনগণের নিজ সম্পদ রক্ষার সাধারণ লড়াই এবং এই লড়াইয়ের সংগে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের যোগ সামান্যই ঘটেছে। বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ মূলত দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ বা দীর্ঘ দশ বছর যুদ্ধ করেছিলেন ১৫৭৫ থেকে ১৫৮৫ অবধি। সেই যুদ্ধটিই মনে হয় এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং মোঘলদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধটিই এই অঞ্চলের জনগণের শ্রেষ্ঠতম যুদ্ধ। বাংলার জমিদারদের বশ্যতা স্বীকার করাতে মোগলদের ১৬০৮ থেকে ১৬১২ সাল পর্যন্ত মোট চার বছর সময় লেগেছিলো।[১]

ব্রিটিশ আমলে বঙ্গ অঞ্চলের বিদ্রোহগুলো ছিলো খাপছাড়া ও স্থানিক এবং সেগুলো হটাত হটাত বিভিন্ন স্থানে জ্বলে উঠেছে, সেই বিদ্রোহগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে সংগঠিত হয়নি। এতদঞ্চলের লোকজন সর্বশেষ যে যুদ্ধটি করেছিলেন তা ছিলো চাপিয়ে দেয়া এবং সে যুদ্ধটিতে বঙ্গের অর্ধাংশ বা পশ্চিমবঙ্গ সরাসরি যুক্ত ছিলো না। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়লেও এবং সে সময় দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধ গোটা দুনিয়ায় চললেও বঙ্গাল মুলুকে গৃহযুদ্ধ না লাগা একটা রহস্য বটে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ২ কোটি বাঙাল স্রেফ না খেয়ে মারা গেল, অথচ তারা একটা গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত লাগাতে পারেনি। অথচ তখন গৃহযুদ্ধের সব পরিস্থিতিই বিরাজমান। তার তিন বছর পরে দাঙ্গাতে লাখ খানেক বাঙালি পরস্পরকে মারলো। অথচ গৃহযুদ্ধে মারলে ইতিহাসটা অন্য হতো।

বঙ্গ অঞ্চলের মানুষের, বিশেষভাবে বাঙালির জ্ঞানগত সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তারা রাজনীতি এবং যুদ্ধ সম্পর্কে যথাযথ ওয়াকিবহাল নয়। যুদ্ধ কেন[২] লাগে এ সম্পর্কেও তারা জ্ঞাত খুব সামান্যই। বঙ্গাল মুলুকে যুদ্ধ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা এতো কম যে অবাক হতে হয়। যুদ্ধ সম্পর্কে বাঙালি চিন্তাবিদগণ সর্বমোট দশটি প্রবন্ধও লেখেনি। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষ বাঙালি তো কস্মিনকালেও যুদ্ধবাজ জাতি ছিল না। ইংরেজ আমলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৮৯৫ সালে অবলুপ্ত করা হয়, সেসময় সৈন্যের যোগানটা দিত মূলত বিহার। মূঘল, সুলতানি বা হিন্দু যুগেও সেনাবাহিনীতে এই অঞ্চলের লোকদের অংশগ্রহণ ছিল অতি নগন্য।

আরো পড়ুন:  জনজীবনের রূপকার শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী

১৯৯০ পরবর্তীকালে হত্যা, গুম, খুন, আত্মহত্যা, ধর্ষণ সহ দুর্ঘটনায় যত লোক মারা গেছে তা অবশ্যই দু লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এতো বিশাল জীবনের অপচয় যে কয়েকটি দেশে গৃহযুদ্ধ চলেছে সেসব দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে ঘটেনি। বাংলাদেশে সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদনির্ভর উচ্চবিত্ত শাসকগোষ্ঠী এবং তার সহযোগী আমলাতন্ত্র যে অন্যায়, নিপীড়ন, অবিচার, বিচার বহির্ভূত হত্যা, গণহত্যা ও বর্বরতাগুলো[৩] চালিয়ে যাচ্ছে তার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হলে আমাদেরকে রাজনীতি এবং যুদ্ধের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। একটি দীর্ঘমেয়াদী সামগ্রিক গণযুদ্ধ বা গণযুদ্ধ ছাড়া এইরূপ বর্বরতা এখানে বন্ধ হবার আশা করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা ভাবার সময় হয়েছে বলে মনে হয়। 

বাঙালী জাতি বিদেশি বিজাতি শাসিত এই কথা বাঙালির প্রায় সব লেখক স্বীকার করেছেন। বাঙালি বিজাতি শাসিত হলেও তারা যে লড়াই করেনি তা নয়, তবে বাঙালি লড়াইপ্রিয় একথা বলা যায়, তবে তারা সবসময়ে লড়াইপ্রিয় ছিলো না। বাঙালির সাথে বসবাস করেছে এবং লড়াইপ্রিয় হিসেবে অগ্রণী হচ্ছেন সাঁওতালসহ অনেক জাতিসত্ত্বা রয়েছে। ইতিহাসের কোনো কোনো কালে এসব জাতির মানুষেরা জ্বলে উঠেছে এবং প্রায় সময়েই নিভন্ত থেকেছে। বাঙালি প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ লিখেছিলেন যে

“বাঙালী চিরকাল বিদেশী ও বিজাতি শাসিত। সাত শতকের শশাঙ্ক নরেন্দ্র-গুপ্ত এবং পনেরো শতকের যদু-জালালুদ্দীন ছাড়া বাঙালার কোনো শাসকই বাঙালী ছিলেন না। এটি নিশ্চিতই লজ্জার এবং বাঙালী চরিত্রে নিহিত রয়েছে এর গূঢ় কারণ।”[৪]

অন্যকে পরাধীন করা ও শোষণ করার সহজ উপায়ই হচ্ছে যুদ্ধ। এক্ষেত্রেই বাঙালি ব্যর্থ হয়েছে; তবে এই ব্যর্থতা দোষের নয় বরং এটি তাঁদের একটি বড় গুণ। কিন্তু গুণ হলেও এই ব্যর্থতা তাদেরকে নিপীড়ন ও ভোগান্তিতে ফেলেছে যথেচ্ছভাবে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলির দিকে দেখলে মনে হবে, শুধু বাঙালি নয় পাশের অন্যান্য জাতিগুলিও অসামান্য বীর। আবার রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বহারা ও কমিউনিস্ট পার্টির কচুকাটাকে খেয়াল করলে এখনকার ছেলেমেয়েদের নিরব থাকাটা বুঝতে দেরি হবার কথা নয়।

আরো পড়ুন:  শক্তির ভারসাম্য হচ্ছে একটি দেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত কৌশলের ব্যাপার

তথ্যসূত্র ও টিকা:

১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ লেভিন ও গ্রিগোরি কতোভস্কি, ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৩৩৬

২. যুদ্ধ কেন শিরোনামে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের লেখাটি আপনারা পড়ে দেখুন।

৩. সিরাজ সিকদার থেকে শুরু করে সাম্প্রতককালের ক্রসফায়ার সমূহ, অবিচার অর্থে বিশ্বজিত দাস এবং অন্যান্য কোর্ট মার্শালসমূহ, গণহত্যা অর্থে পাহাড়ে চালিত গণহত্যাসমূহ।

৪. আহমদ শরীফ, বাঙলা ও বাঙালী, পৃষ্ঠা ১৭

Leave a Comment

error: Content is protected !!