প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিম রণাঙ্গন (ইংরেজি: Western Front of First World War) ছিল ইউরোপের যুদ্ধের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। বলতে গেলে ১৯১৪ সালের ২১ আগস্ট ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি ফোর্সের চতুর্থ ড্রাগন গার্ডসের ১২০ জন অশ্বারােহী সৈন্য গিয়ে অবস্থান নেয় বেলজিয়ামের চ্যাস্টাউ গ্রামে। সেখানে জার্মান সৈন্যদের জোরদার অবস্থান দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি ১৬ বছর বয়স্ক কিশাের ব্রিটিশ সৈন্য বেন ক্লাউটিং। ২২ আগস্ট তাঁর ছােড়া গুলির মধ্য দিয়েই মূলত হয়ে শুরু যায় এ যুদ্ধ। তারপর এগিয়েছে নানা সংঘাত আর ঘটনার ঘনঘটায়, সেগুলাের মধ্যে থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনের কিছু অংশ এখানে বর্ণনা করা হলো।
রণাঙ্গনে প্রথম লড়াই
১৯১৪ সালের ৩ আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সীমান্ত লংঘনের অভিযােগ এনে প্রথম যুদ্ধ ঘােষণা করা হয় জার্মানির পক্ষ থেকেই। পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মান ও ফ্রাঙ্কো-ব্রিটিশ বাহিনীর সৈন্য সমাবেশ যেকোনাে মুহূর্তে প্রলয়ঙ্করী সংঘাত বাধার কথা জানান দেয়। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেই যুদ্ধে ক্ষান্ত দেয়নি জার্মানরা। তারা একইসাথে বেলজিয়ামেও সৈন্য প্রেরণ করে। ৪ আগস্ট ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলেও শুরুতেই তারা শান্তি আলােচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের শান্তি আলােচনার প্রস্তাব আমলে না দিয়ে দুর্নিবার আক্রমণ চালিয়ে মাত্র ৩ দিনের মাথায় লাইজি দখল করে বেলজিয়ামের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। পুরাে বেলজিয়াম দখলে নিতে জার্মানির ১৮ আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এর মাত্র দুদিন পর জার্মান বাহিনীর আক্রমণ লােরেন থেকে ফরাসিদের পিছু হটতে বাধ্য করে। ২২-২৫ আগস্ট পাল্টা হামলার চেষ্টা করেও নিউচাটাও ও লংওয়ের লড়াইয়ে বিধ্বস্ত হয় ফরাসিরা।
ব্রিটিশ-জার্মান মুখােমুখি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম লড়াই শুরু হয় ব্রিটিশ ও জার্মান সৈন্যদের পরস্পর মুখােমুখি অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে। বেলজিয়ামের পশ্চিম রণাঙ্গনে ব্রিটিশ ও জার্মান সৈন্যরা সমবেত হয়। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি ফোর্সের সৈন্যরা ৭০ হাজারের একটি দল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় ১৪ আগস্ট। এরপর তাদের সাথে গিয়ে যােগদান করে ফরাসি জেনারেল লানরেজাসের নেতৃত্বাধীন ফিফথ আর্মি। এসময় ফিল্ড মার্শাল ফ্রেঞ্চ জেনারেল স্মিথ ডােরেন ও হেইগের নেতৃত্বে পশ্চিমের প্রায় ৪০ কিলােমিটার রণাঙ্গনে সমবেত হতে থাকে সৈন্যরা। আর তাদের প্রতিরােধে উপস্থিত হয় জেনারেল ফন ক্লার্কের নেতৃত্বাধীন চৌকস জার্মান সৈন্যের একটি দল। তিনি শুরুতে ব্রিটিশ সৈন্যদের ধাওয়া করেন। পরে আক্রমণ বন্ধ করে সংখ্যা পূরণ করার চেষ্টা করেন।
সার্বিয়া অভিমুখে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বাহিনী
গ্রিস, সার্বিয়া ও আলবেনিয়ার সংঘাত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে অন্যতম। সার্বিয়ার অস্ট্রোহাঙ্গোরির আক্রমণ বলতে গেলে এ সময়ে যুদ্ধের মােড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯১৪ সালের আগস্টে যুদ্ধ শুরু হলে এর শেষ তথা ১৯১৮ সাল নাগাদ চলতে থাকে এ দু’পক্ষের লড়াই। মার্শাল রাদোমিক পুতনিকের নেতৃত্বাধীন সার্বিয়ার সৈন্যদের সাথে যুক্ত হয়েছিল মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা। এদিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির পাশাপাশি বেলজিয়ামের সৈন্যরা সেখানে প্রথম অভিযান চালায় জেনারেল অস্কার পােটিওরেকের নেতৃত্বে। যুদ্ধে শুরুতে জেনারেল রামােমির পুতনিকের নেতৃত্বাধীন সার্বিয়ার সৈন্যসংখ্যা মাত্র ২ লাখ ছিল। তখন অস্ট্রিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতার করে অস্ট্রীয় বাহিনী। তবে তাকে চিনতে না পেরে চরম বােকামির পরিচয় দিয়ে একটি ট্রেনে করে সার্বিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযােগ দেয়। তারপর সার্বিয়ায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরির আক্রমণ হলে শুরু হয় প্রতিরােধ যুদ্ধ। ভয়ানক অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সার্বিয়ার সৈন্যবাহিনীকে পরিচালনা করেন মার্শাল রাদোমির পুতনিক। ২১ আগস্ট দিনা নদী অতিক্রমের পর শুরু হয় মরণপণ লড়াই। তখন একজন অসুস্থ সেনানায়ক পুতনিক জেনারেল অস্কার পােটিওরেকের চৌকস বাহিনীকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেন প্রতিরােধ লড়াই কাকে বলে। পুতনিকের যােগ্য নেতৃত্ব এবং অসুস্থ অবস্থায়ও দেশের প্রতি সীমাহীন আন্তরিকতা সার্বিয়ার বাহিনীকে পথ দেখায়। তারা প্রতিপক্ষের দ্রিনা ও সাভা নদী পার হওয়ার সব ধরনের চেষ্টা নস্যাৎ করে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেয়।
ইপ্রের যুদ্ধ
অন্যতম আলােচিত যুদ্ধক্ষেত্র ইপ্রেতে পরপর তিনটি যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এগুলােকে ইস্ত্রের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। মহাযুদ্ধের প্রথম বছরের দীর্ঘতম এবং ভয়াবহ লড়াই হিসেবে ইস্ত্রের প্রথম যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে যা ব্যাটল অব ফ্লান্ডার্স নামেও পরিচিত। এক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীর বিজয় হলেও দু’পক্ষে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯১৪ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর নেতৃত্ব দেন জন ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ফচ। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স মিলিয়ে মিত্রবাহিনীর লক্ষাধিক সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। অন্যদিকে এরিক ফন ফাকেনহায়েনের নেতৃত্বাধীন জার্মান বাহিনীর বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের চতুর্থ ও ষষ্ঠ আর্মি থেকে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার সৈন্যের প্রাণহানি হয়। এদিকে ১৯১৫ সালের ২২ এপ্রিল আবার লড়াই বাধে বেলজিয়ামের ইস্ত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে যা ২৫ মে পর্যন্ত স্থায়ী হয়। হােরেস স্মিথ ডােরেনের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর ৮টি পদাতিক ডিভিশন এতে অংশ নেয় যাদের ৭০ হাজার হতাহত কিংবা নিখোঁজ হয়। অন্যদিকে জার্মানির পক্ষে ৭টি পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অলব্রেট অব ওয়ার্টেম্বার্গ যার থেকে ৩৫ হাজার সৈন্য হতাহত কিংবা নিখোঁজ হলেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ থাকে অমীমাংসিত। এদিকে ১৯১৭ সালের ৩১ জুলাই বেলজিয়ামের পশ্চিম ফ্লান্ডার্সে নতুন করে শুরু হয় ইপ্রের তৃতীয় লড়াই। এতে বিশালাকার মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন চারজন কুশলী সেনানায়ক জেনারেল ডগলাস হেইস, জেনারেল হুবার্ট গাফ, জেনারেল হার্বার্ট প্লামার ও জেনারেল আর্থার কুরি। অন্যদিকে জেনারেল ম্যাক্স ফন গ্যালউইজ ও জেনারেল এরিক লুডেনডর্ফের নেতৃত্বে অংশ নেয় শক্তিশালী জার্মান বাহিনী। শেষ পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর ৪ লাখ ৪৮ হাজার এবং জার্মানদের ২ লাখ ৬০ হাজার হতাহত হলেও যুদ্ধের ফলাফল ছিল অমীমাংসিত।
মারনির সংঘাত
ভয়াবহ পশ্চিম রণাঙ্গনের একক বৃহত্তম যুদ্ধ হিসেবে মারনির সংঘাতের কথা বলা যেতে পারে। এই লড়াইয়ে মিত্রবাহিনীর জয়ের মধ্য দিয়ে বলতে গেলে অনেক দিক থেকে যুদ্ধে স্থবিরতা লক্ষ করা গেছে। এতে দ্রুত জয়লাভের আশা বাদ দিয়ে জার্মান বাহিনী দুই রণাঙ্গনে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। রুশ জেনারেল সিলাইফেনের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে জার্মান বাহিনী তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন দুজন কুশলী সেনানায়ক ফিল্ড মার্শাল স্যার জন ফ্রেঞ্চ ও জেনারেল জোসেফ জোফরে। তাঁদের নেতৃত্বে প্যারিসের মারনি নদীর তীরে প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার সৈন্য সমাবেশ করে মিত্রবাহিনী। মিত্রবাহিনীকে উপযুক্ত জবাব দিতে তিনজন জার্মান সমরনায়ক জেনারেল হেলমুট ফন মােল্টকি, জেনারেল কার্ল ফন বুলাে, জেনারেল আক্সান্ডার ফন ক্লাকের প্রায় ১৪ লাখ ৮৫ হাজার সৈন্য এতে জড়াে করে জার্মান বাহিনী। এতে মিত্রবাহিনীর ৩ লাখ ৬৩ হাজার সৈন্যের পাশাপাশি জার্মান পক্ষে হতাহত হয় প্রায় আড়াই লাখ সৈন্য।
১৯১৬ সালের ভার্দুনের সংঘাত
ফ্রান্সের পশ্চিম ফ্রন্টে ১৯১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভার্দুনের যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হলে জার্মানরা দ্রুত জয়লাভের চেষ্টা করে নানা দিক থেকে ব্যর্থ হতে থাকে। তবে তাদের তীব্র প্রতিরােধের মুখে মিত্রবাহিনীও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বিশ্বযুদ্ধের মূল যুদ্ধ যখন পরিখার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে ঠিক তখনি ফ্রান্সের ভার্দুনে সংঘটিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। ১৯১৬ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ মাস ধরে চলা এ সংঘাতে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় ফরাসি বাহিনী। মার্শাল ফিলিপ পেঁতা ও জেনারেল রবার্ট নিভেলির নেতৃত্বে জার্মানদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ফরাসি সৈন্যরা। জেনারেল এরিক ফন ফাকেন হায়েন প্রায় দেড় লাখ জার্মান সৈন্য নিয়ে তাদের বাধা দিতে গিয়ে পুরােপুরি ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত লক্ষাধিক জার্মান সেনার প্রাণহানি ঘটে এ সংঘাতে। পাশাপাশি আহত ও নিখোঁজ হয় আরাে অনেকে।
ব্যাটল অব সােম
ফ্রান্সের পিকার্ডির সােম অঞ্চলে ১৯১৬ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হয় এক প্রাণঘাতী সংঘাত যা ১৯১৭ সালের ১৮ জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত থাকলেও দু’পক্ষেই প্রচুর হতাহত হয়। ম্যাক্স ফন গ্যালউইজ ও ফ্রিটজ ফন বুলাের নেতৃত্বাধীন জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা। এক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স ও নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের সৈন্যরা জড়াে হয় ডগলাস হেউগ ও ফার্দিনান্দ ফচের নেতৃত্বে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ৫০ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে লড়তে থাকা জার্মানদের পক্ষে এ যুদ্ধে মারা যায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার সৈন্য। অন্যদিকে ৫১ ডিভিশন মিত্রবাহিনীর সৈন্য থেকে হতাহত হয় সাড়ে ছয় লাখের মত। মিত্রবাহিনীর অনেকগুলাে বিমান ও শক্তিশালী ট্যাংকও ধ্বংস হয় এ যুদ্ধে।
নিভেলি অফেন্সিভ
ফরাসি সেনানায়ক জোসেফ জোফরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ফরাসি জেনারেল রবার্ট নেভেলি ঘােষণা করেন মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় জার্মানদের বিধ্বস্ত করা হবে। তাঁর নামানুসারে এ লড়াইকে নিভেলি অফেন্সিভ (১৬ এপ্রিল – ৯ মে ১৯১৭) বলা হয়। ফ্রান্সের পক্ষে তিনিসহ নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল চার্লস মানগিন, জেনারেল ফ্রাঁসােয়া অ্যান্থনি ও জেনারেল মাজেন। ১২ লাখ ৭ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে হামলা চালিয়ে সেখান থেকে ১ লাখ ৮৭ হাজার সৈন্য হারায় ফ্রান্স। অন্যদিকে জার্মান পক্ষে জেনারেল ফন বােহেন ও জেনারেল ফ্রিটজ ফন বুলাের নেতৃত্বাধীন ১০ লক্ষ সৈন্যের বাহিনী থেকে নিহত হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার। আইসনি নদী উপত্যকায় চলা এ সংঘাতে জেনারেল নিভেলি শেষ পর্যন্ত তার কথা রাখতে পারেননি। ফলে এ যুদ্ধে জার্মানদের কৌশলগত বিজয়ের কথা ধরে নেয়া যেতেই পারে। ফরাসি যুদ্ধমন্ত্রী হুবার্ট লাইটি, চিফ অব স্টাফ জেনারেল হেনরি ফিলিপ পেঁতা এবং ব্রিটিশ কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ডগলাস হেইগ নিভেলির এ পরিকল্পনার তীব্র বিরােধিতা করেছিলেন শুরু থেকেই। তাদের আপত্তি সত্ত্বেও ফরাসি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিস্টাইড ব্রায়ান্ড এ পরিকল্পনা অনুমােদন করলে ক্ষোভে পদত্যাগ করেন যুদ্ধমন্ত্রী হুবার্ট লাইটি।
ভিমি রিজের লড়াই
ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ভিমি ছিল পশ্চিম রণাঙ্গনের অন্যতম সুরক্ষিত স্থান। এটাকে অনেকটা দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে মনে করা হত। ১৯১৭ সালের ৯ থেকে ১২ এপ্রিল এ তিন দিন এখানে চলে ভয়াবহ সংঘর্ষ। জার্মান বাহিনীর পক্ষ থেকেও এখানে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেখা যায়। তারা সুড়ঙ্গ, কাঁটাতারের বেড়া, তিন স্তরের পরিখা, প্রচুর কামানের প্রহরার পাশাপাশি অগণিত মেশিনগান পয়েন্ট স্থাপন করে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করেছিল। এর আগে পাহাড়টির দখল নিতে গিয়ে ব্রিটিশরা হাজার হাজার সৈন্য খুইয়েছিল। ১৯১৫ সালের লড়াইয়ে সেখানে ফরাসি সৈন্যরাই মারা যায় দেড় লাখের মত। এবার কানাডা ও যুক্তরাজ্যের বাহিনী সম্মিলিতভাবে জেনারেল জুলিয়ান বায়ানগ ও জেনারেল আর্থার কুরির নেতৃত্বে আক্রমণ চলায়। তাদের ৩০ হাজার সৈন্য থেকে ৩৫৮৯ জন নিহত হলেও যুদ্ধের ফলাফল তাদের পক্ষেই যায়। জার্মানি প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এক্ষেত্রে কানাডার ৯টি প্রদেশের প্রত্যেকটি স্থান থেকে সৈন্যরা দিয়ে ভিমি রিজের দখলযুদ্ধে অংশ নেয়।
ভয়াবহ পশ্চিম রণাঙ্গন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ লড়াইগুলাে হয়েছিল পশ্চিমের রণাঙ্গনেই। এক্ষেত্রে উত্তর সাগর থেকে শুরু করে ফ্রান্সের সীমান্তঘেঁষে সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল এ রণাঙ্গন। প্রথম দিকে জার্মান বাহিনী কিংবা মিত্রবাহিনী কারাে দিক থেকেই কোনাে ধরনের দুর্বলতা লক্ষ করা যায়নি। দুপক্ষেই প্রচুর হতাহত হলেও শেষ পর্যন্ত নতুন সৈন্য এনে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা লক্ষ করা গেছে তাদের মধ্যে। ব্রিটেনের নেতৃত্বে বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র এখানে মার্শাল ফার্দিনান্দ ফচের নেতৃত্বে মােকাবেলা করে জার্মানদের। এদিকে কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম স্বয়ং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই ফ্রন্টের লড়াইয়ে। শেষ পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে ৪৮ লাখ হতাহতের কথা বলা হলেও জার্মান বাহিনী তাদের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির উপযুক্ত সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারেনি। তবে যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত বেলজিয়ামের বেশিরভাগ এলাকা, লুক্সেমবার্গ ও ফ্রান্সের শিল্পাঞ্চলগুলাে ছিল জার্মানির দখলেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গের পর ফ্রান্সে নিজেদের অগ্রযাত্রাকে ধারাবাহিক করে জার্মান বাহিনী। তবে ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সাল নাগাদ এ ফ্রন্টে পরপর কয়েকটি প্রাণঘাতী লড়াই হয়। দলবদ্ধ পদাতিক বাহিনীর হামলার পাশাপাশি ব্যাপক কামানের গােলাবর্ষণ করা হয় দুই বাহিনীর পক্ষ থেকেই। কাঁটাতারের শক্ত বেষ্টনীর পাশাপাশি পরিখা খনন করে আগে থেকেই উপযুক্ত অবস্থান নিয়ে বসে থাকে জার্মান বাহিনী। পাশাপাশি পথগুলাে আরাে নিরাপদ করতে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাইন পুঁতে রাখে জার্মানরা। তাই অনবরত মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে থাকলেও শেষ পর্যন্ত জার্মানদের তেমন কোনাে ক্ষতিই করতে পারেনি মিত্রবাহিনী। পশ্চিম রণাঙ্গনের এ অচলাবস্থা কাটাতে মরিয়ে হয়ে ওঠে মিত্রবাহিনী। তারা শেষ পর্যন্ত এখানে বিষাক্ত গ্যাসবােমা হামলা করে। পাশাপাশি জঙ্গবিমান থেকে চলতে থাকে লাগাতার বােমাবর্ষণ।
তথ্যসূত্র:
১. মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, [Pdf]. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি ২০১৯. সানজিদা মুস্তাফিজ ও সুমা কর্মকার. সম্পা. পৃষ্ঠা ৪১-৪২; Retrieved from http://www.ebookbou.edu.bd/wp/OS/hsc4_2.php#hsc2855
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।