জনগণতন্ত্র (ইংরেজি: People’s Democracy) হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরােপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টদের প্রভাবে গঠিত নতুন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা। পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যবর্তী পর্যায়কে আজকাল জনগণতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়। সােভিয়েত রাষ্ট্রতাত্ত্বিকেরা জনগণতান্ত্রিক অর্থাৎ পিপলস ডেমােক্রেসি নামে সেগুলিকে অভিহিত করেন। মতাদর্শের বিচারে সেগুলির অবস্থান সােভিয়েত ইউনিয়নের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের নিচে। সেগুলির প্রধান লক্ষণ ছিল রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে শ্রমিক ও কৃষকদের যােগদান, সরকারি সংস্থায় শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্ব, আইন সভা ও প্রশাসন কর্তৃত্বের সংযুক্ততা, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অনুসারে সরকার পরিচালনা এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব।
কোনও কোনও জনগণতান্ত্রিক দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা দেখা দেয় যার নেতৃত্বে থাকে সুসংবদ্ধ এক কমিউনিস্ট পার্টি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মতাদর্শের ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি বিভিন্ন দলকে জাতীয় ফ্রন্টে একতাবদ্ধ করে। বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক পরিস্থিতির তারতম্য অনুযায়ী সেখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই হয় প্রধান লক্ষ্য। এই গণতন্ত্রে পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা ও শ্রমিক-কৃষকের নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে লােকের যাবতীয় বক্তব্য, প্রতিনিধিত্ব ও জনমত প্রতিফলিত হয়। যেহেতু জনগণের জন্য নির্দিষ্ট এবং জনস্বার্থ সংরক্ষণ এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য, সেকারণে এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে জনগণতন্ত্র বলা হয়। জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাসমূহ মার্কিন ও ব্রিটিশ সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রসমূহের বিরোধিতা করেছে দীর্ঘকাল।[১]
রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে, এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্য্ন্ত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সাধারণভাবে গৃহীত মত এই ছিল যে, বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শান্তিপূর্ণভাবে এবং পার্লামেন্টারি বা পরিষদীয় গণতন্ত্রের মারফত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা গৃহীত হতো না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যে পূর্ব জার্মানীসহ পূর্ব য়ুরোপের কয়েকটি দেশ সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের হাত হতে মুক্তি লাভ করে। ফ্যাসি-বিরোধী মুক্তিযুদ্ধে এই সমস্ত দেশে এমন একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠে যার নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণীর হলেও তার মধ্যে কেবল শ্রমিক ও কৃষক নয়, জাতীয় ধনিক শ্রেণীরও একটি বৃহৎ অংশ যোগদান করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে এরূপ সার্বিক ঐক্য গঠিত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। ভারতবর্ষ যখন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল তখন তার আন্দোলনেও সর্বশ্রেণীক চরিত্র প্রকাশ পেয়েছিল।[২]
সাধারণ মুক্তি আন্দোলনের জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপীয় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বেশ কয়েকটি পার্থক্য ছিল। পার্থক্যগুলিকে এভাবে চিহ্নিত করা চলে। ১. রাষ্ট্রীয়ভাবে যে আন্তর্জাতিক শক্তি এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সহায়ক ছিল সে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত দেশ, কোনো ধনতান্ত্রিক দেশ নয়। ২. জাতীয় মুক্তি মোর্চায় শ্রমিক শ্রেণী কেবল অংশীদার ছিল না। শ্রমিক শ্রেণীই এই জাতীয় মুক্তি মোর্চায় সর্বাগ্রে এবং সর্বাধিক সশস্ত্র সংগ্রামী নেতা ছিল। ৩. শ্রমিক শ্রেণী এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শে সংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টি এই মুক্তি মোর্চার নেতৃত্ব দিয়েছে। ৪. জাতীয় পুঁজিবাদী শ্রেণীর সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ফ্যাসিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদে সহযোগী শক্তি হিসাবে জনসাধারণের কাছে চিহ্নিত এবং মুক্তিযুদ্ধের সফল অগ্রগতিতে দৈহিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াতে পুঁজিবাদ এবং সামন্ততন্ত্রের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জাতীয় ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সমস্ত কারণে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে যুদ্ধশেষে সরাসরি সমাজতন্ত্র কায়েম না হলেও, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে অপরাপর জাতীয় শ্রেণীর সহযোগিতায় গঠিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে অবারিত করে দেয়।[২]
রাষ্ট্রীয় কাঠামো কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বমূলক না হওয়াতে, অপরাপর শ্রেণীতে উহার অংশ থাকাতে এবং অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ আকারে ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্ব থাকাতে এই পর্যায়কে সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকগণ নয়াগণতন্ত্র বা জনগণতন্ত্র বলে অভিহিত করতে শুরু করেন। চীন এবং এশিয়ার অপর কয়েকটি দেশে মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখিত চরিত্রের কারণে সমাজতন্ত্রের পূর্ববর্তী স্তর হিসাবে জনগণতন্ত্র বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় এবং অর্থনীতিক ব্যবস্থা। ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের সফল মুক্তি আন্দোলনেও জনগণতন্ত্রের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আত্মপ্রকাশ করেছিল বলে অনেকে মনে করেন।[২]
তথ্যসূত্র
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১০৯-১১০।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩০৬-৩০৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
good information to broaden my horizons but if there is any other information if you can let me know