লেনিনবাদ জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ধারনাকে সুদূর প্রসারী করেছে, আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারনাকে ব্যাখ্যা করেছে; এবং উপনিবেশ আর পরাধীন দেশের নির্যাতিত জনসাধারণের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অধিকার এবং প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন জাতীয় প্রশ্নের তত্ত্বমূলক বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন তাঁর “জাতীয় প্রশ্নে সমালোচনামূলক মন্তব্য” এবং “জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের আধিকার” শিরোনামের দুটি প্রবন্ধে। ভ্লাদিমির লেনিন ১৯১৪ সালে প্রবন্ধ দুটি লেখেন এবং প্রবন্ধ দুটি ছিলো রাজনৈতিক প্রচারপুস্তিকা। এই প্রচারপুস্তিকা দুটোতে লেনিন জাতীয় প্রশ্নের মার্কসবাদী কর্মসূচি এবং বলশেভিক পার্টির জাতীয় নীতি বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করেন।
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হচ্ছে প্রত্যেক জাতির পৃথক হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার। নিজের এই দুটি রচনায় লেনিন দেখালেন যে নিপীড়িত জাতিদের অধিকার ও স্বার্থের রক্ষক কেবল বলশেভিক পার্টি এবং জমিদার ও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এক দুর্বার শক্তি হিসবে দাঁড়াতে হলে দরকার জাতি নির্বিশেষে শ্রমিক ও কৃষক জনগণের ঐক্য।[১] জোসেফ স্তালিন লেনিনবাদকে বিশ্লেষণ করেছেন, জাতি সমস্যা নিয়ে সারা জীবন কাজ করেছেন। স্তালিন লেনিনবাদ সম্পর্কে বলেছেন যে
“লেনিনবাদ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ধারণা আরও সুদূরপ্রসারী করেছে এবং এর ব্যাখ্যা করে বলেছে যে, উপনিবেশ আর পরাধীন দেশের নির্যাতিত জনসাধারণের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অধিকার আছে, প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার আছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে শুধু স্বায়ত্তশাসনের অধিকার হিসেবে ব্যাখ্যা করে পরদেশ গ্রাসের সাফাই গাওয়ার সম্ভাবনা এর ফলে দূর হয়েছে।”[২]
তবে এই কথার এরকম অর্থ নয় যে, প্রলেতারিয়েতকে প্রত্যেকটি জাতীয় আন্দোলনকে সব সময়, সকল ক্ষেত্রেই প্রতিটি ব্যাপারেই সমর্থন দিতে হবে।
একটু সেই সময়ের প্রেক্ষাপটটি বিবেচনা করা যাক। প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হবার আগের সময়। তখন নতুন যুদ্ধের আয়োজন করছিল বুর্জোয়া ও জমিদাররা, জাতিসমূহকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছিল, তাঁদের ভেতরে পারস্পরিক বৈরীভাব উসকিয়ে দিচ্ছিল আর শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিভেদ ঘটাতে চাইছিলো। সেই সময়ে বলশেভিকদের সামনে শ্রমিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক ঐক্য রক্ষার কর্তব্য হাজির করলেন লেনিন, এই ঐক্যের মধ্যেই তিনি শ্রমিক শ্রেণির পরাক্রমের মূল শর্ত দেখেছিলেন। বহুজাতিক রাশিয়ার পক্ষে সবচেয়ে জরুরি ছিলো রুশ প্রলেতারিয়েতের শ্রেণি সংগ্রামের সংগে নিপীড়িত জাতিদের শ্রমিক ও সমস্ত মেহনতিদের সংগ্রামকে মেলানো।
পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে জাতীয় প্রশ্নের দুটি ঐতিহাসিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয় জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জীবন জেগে ওঠা, জাতীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু এবং জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি হচ্ছে প্রথম প্রবণতা। বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দ্রুত গড়ে ওঠা, জাতীয় আড়াল ভেঙে পড়া, পুঁজি, সাধারণভাবে অর্থনৈতিক জীবন ও রাজনীতি বিজ্ঞান ইত্যাদির আন্তর্জাতিক ঐক্য সৃষ্টি হচ্ছে এর দ্বিতীয় প্রবণতা। পুঁজিবাদ থাকলে এই দুটি ঝোঁক বা প্রবণতা থাকবেই।
প্রথম প্রবণতাটির ঐতিহাসিক সংযোগ আছে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের জয়ের যুগের সংগে। অর্থনৈতিক কারণ থেকেই এটির উদ্ভব। পুঁজিবাদকে অবাধে বিকশিত করতে হলে দেশের বাজারটি বুর্জোয়াদের অধিকারে থাকা চাই। সেজন্য একই ভাষাভাষী সমস্ত এলাকাকে যুক্ত করে একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হয়, সেই ভাষার বিকাশের পথে যা কিছু বাধা তা দূর করতে হয়, সেই ভাষার সাহিত্যকে সংহতরূপ দিতে হয়। এ-কারণে প্রত্যেক জাতীয় আন্দোলনের প্রবণতা থাকে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলার দিকে। আধুনিক পুঁজিবাদের চাহিদাও তাই। অর্থাৎ পুঁজিবাদের আওতায় জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, এটাই সাধারণ লক্ষণ। আর এই যে ব্যাপারটি ঘটছে তার মূলে রয়ে গেছে অর্থনৈতিক কারণ, অর্থাৎ বাজার তৈরি হওয়া। গোটা সভ্য জগতেই এই ব্যাপারটি ঘটে চলেছে।[৩]
দ্বিতীয় প্রবণতাটি প্রকাশ পায় পুঁজিবাদের বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে, সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ে। এই সময়ে সমুদ্রপথে ও রেলপথে ব্যাপক আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ঘটেছে, তৈরি হয়েছে বিশ্ব বাজার, রপ্তানি হচ্ছে পুঁজি, ফলে জাতিতে জাতিতে অর্থনৈতিক বন্ধন আরো ঘনিষ্ঠ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমবিভাগ ঘটে যাচ্ছে। উৎপাদন শক্তি যখন প্রচণ্ড রকমের ব্যাপকতা লাভ করে তখনই এই দ্বিতীয় প্রবণতাটি প্রকাশ পায়। ফলে জাতীয় ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা লোপ পায় এবং উদ্ভব হয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার। লেনিনের মতে,
“পুঁজিবাদের বিকাশের গোড়ার দিকে প্রথমটির প্রাধান্য দেখা যায়; দ্বিতীয়টি হলো উন্নততর পুঁজিবাদের, পুঁজিবাদ যখন সমাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে চলেছে তখনকার বৈশিষ্ট্য।”[৪]
লেনিন আরো বলেন, পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠতর অর্থনৈতিক বন্ধন কিন্তু সমান সহযোগিতার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়নি; হয়েছে বর্বর প্রতিযোগিতা, নির্যাতন, জবরদস্তি, ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক বশ্যতা স্থাপনের মধ্য দিয়ে, পশ্চাৎপদ দেশগুলোকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও লুঠপাট করার মধ্য দিয়ে। কাজেই এই দ্বিতীয় প্রবণতাটি প্রথম প্রবণতাকে চাপা দিতে পারে না, বরং আরো প্রবল করে তোলে এবং নির্যাতিত জাতিগুলোর মধ্যে জাগিয়ে তোলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম।
লেনিন বলেন জাতীয় প্রশ্নে মার্কসবাদী কর্মসূচি এই দুটি প্রবণতাকেই বিবেচনায় রাখবে। প্রথম ঝোঁক অনুযায়ী তুলে ধরবে জাতির ও ভাষার সমানাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার—এমনকি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার অধিকার পর্যন্ত। দ্বিতীয় প্রবণতা অনুযায়ী তুলে ধরবে প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার মহান নীতি এবং আপোষহীন লড়াই চালাবে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে জাতীয়তাবাদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে।
সাম্রাজ্যবাদের আমলে [মুষ্টিমেয়] একদল জাতি যেখানে অন্য একদল জাতিকে শোষণ করে বেঁচে থাকে, সেখানে বিভিন্ন জাতির সমান মর্যাদার কথা বলা নির্যাতিত জাতিদের নিছক বিদ্রুপ করা ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতিসমূহের সমান মর্যাদা থাকে না, থাকে না অর্থনৈতিক সমতা। ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সকল সাম্যবাদীর কর্তব্য প্রসঙ্গে লেনিন লিখেছেন,
“জাতি ও ভাষাসমূহের সমানাধিকার যে স্বীকার করে না এবং তার স্বপক্ষে দাঁড়ায় না, সর্বপ্রকার জাতীয় নিপীড়ন ও অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে না, সে মার্কসবাদী নয়, এমনকি গণতন্ত্রীও নয়। এতে কোনো সন্দেহই নেই।”[৫]
একজন গণতান্ত্রিকও জাতীয় নিপীড়ন এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, ভাষাসমূহের সমানাধিকারের জন্য লড়াই করবেন। আবার জাতিসমস্যার সমাধানে পৌঁছার রাস্তা হিসেবে ভি. আই. লেনিন কী বিষয়গুলোকে বিবেচনাতে রাখতেন তাও এখনকার মার্কসবাদী-লেনিনবাদিদের মনে রাখা দরকার;
“সাধারণভাবে জাতীয় সংস্কৃতির কথা বলতে পারে কেবল যাজকতন্ত্রীরা আর বুর্জোয়ারা। মেহনতি জনগণ বলতে পারে কেবল বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির কথাই। ওটাই একমাত্র সংস্কৃতি যা নির্দেশ করে জাতিসমূহের পূর্ণাঙ্গ, প্রকৃত, আন্তরিক সমানতা, জাতিগত উৎপীড়নের অবর্তমানতা এবং গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন। একমাত্র, পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির সমস্ত সংগঠনে সমস্ত জাতির শ্রমিকদের ঐক্য আর সংহতির পথেই ‘জাতিসমস্যার সমাধানে’ পৌঁছান যাবে।”[৬]
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করেছিলেন কার্ল মার্কস। উৎপীড়ক জাতির, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাঙালি, সমাজতন্ত্রীগণ উৎপীড়িত জাতিসমূহের প্রতি বৃহৎ শক্তি বুর্জোয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত জাতীয়তাবাদী কুসংস্কারের চর্বিতচর্বণ করবে না, অর্থাৎ নিজ জাতিকে আদর্শ জাতি বলে মানবে না। ‘শ্রমিক সমস্যার’ কাছে জাতীয় সমস্যার অধীনতা বিষয়ে মার্কসের কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু জাতীয় সমস্যা উপেক্ষা করার সংগে তাঁর তত্ত্বের আসমান জমিন তফাত। কেননা, পুঁজিবাদের আমলে জাতীয় নিপীড়নের বিলোপ অসম্ভব।[৭]
তথ্যসূত্র:
১. অবিচকিন, গ. দ.; অস্ত্রউখভা, ক. আ.; পানক্রাতভা, ম. ইয়ে.; স্মিনর্ভা, আ. প. (১৯৭১)। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন সংক্ষিপ্ত জীবনী (১ সংস্করণ)। মস্কো: প্রগতি প্রকাশন। পৃ: ১২০।
২. জে ভি স্তালিন, লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, পঞ্চম মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ৪৬
৩. দাশগুপ্ত, অমল (২০১৩)। “কারাগারে ও নির্বাসনে”। কমরেড লেনিন (এনবিএ-র প্রথম সংস্করণ সংস্করণ)। কলকাতা: এনবিএ। পৃ: ২২১-২২২। আইএসবিএন 978-81-7626-291-53
৪. জে ভি স্তালিন, লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা; নবগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় অনুদিত; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড; কলকাতা; সেপ্টেম্বর ২০০৮; পৃষ্ঠা ৪৯-৫০
৫. ভি. আই. লেনিন; জাতীয় সমস্যায় সমালোচনামূলক মন্তব্য, অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯১৩, জাতীয় কর্মনীতি ও প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার সমস্যা, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, পৃষ্ঠা-২৭, প্রকাশকাল ১৯৭৪
৬ . ভি. আই. লেনিন; ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩; জনশিক্ষা, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো পৃষ্ঠা ৫৬; রচনাবলী ২৪ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০।
৭. এই বিষয়ে পড়ুন, ভ ই লেনিন, জাতীসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ১৯১৩, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো পৃষ্ঠা ৮৭-৯০ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনার সারসংকলন, পৃষ্ঠা ১৩১।
রচনাকাল ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।