নারীদের প্রশ্নে লেনিন — ক্লারা জেটকিন

১.

কমরেড লেনিন প্রায়ই আমার সঙ্গে নারীদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। অবশ্য কমিউনিজমের কথা বলতে গেলে নারীদের সামাজিক সমান অধিকার যে একটা প্রয়োজনীয় নীতি তা বলাই বাহুল্য। ১৯২০ সালের শরৎকালে ক্রেমলিনে লেনিনে পড়ার ঘরে বসেই সর্বপ্রথম আমাদের এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। লেনিন শুরু করলেন, — “সুস্পষ্ট মতবাদের ভিত্তিতে আমাদের একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে। এ কথা স্পষ্ট যে, মার্কসীয় মতবাদ ছাড়া কোন সুষ্ঠু বাস্তব কাজ সম্ভব নয়। এই প্রশ্নের ওপর আমাদের কমিউনিস্টদের নীতি সম্পর্কে সবচেয়ে সুস্পষ্ট ধারণার প্রয়োজন। আমাদের নিজেদের এবং অন্য সমস্ত পার্টির মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য থাকবেই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। এ প্রসঙ্গ উঠেছিল বটে কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি এখনও কমিশনের হাতে আছে। তাঁদেরই এর ওপর একটি প্রস্তাব লিখে ব্যাখ্যামূলক আলোচনা করে নির্দেশ দিতে হবে। যাই হোক, এখনও পর্যন্ত এই কমিশনের কাজ বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। এ বিষয়ে তোমাদের সাহায্য করতে হবে।”

লেনিন যা বললেন সে বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম এবং অবস্থাটা দেখে বিষ্ময় প্রকাশও করেছিলাম। বিপ্লবের সময় রাশিয়ার নারীরা যা করেছেন এবং এখনও তাঁরা দেশ রক্ষার ও দেশের উন্নতির জন্য যা করছেন তা দেখে আমি উৎসাহ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম, আর বলশেভিক পার্টির মধ্যে নারী কমরেডদের স্থান ও তাঁদের কাজকর্ম দেখে আমার মনে হয়েছিল- এ এক আদর্শ পার্টি। শুধু এটিই একটি প্রয়োজনীয় সুদক্ষ ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নারী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যা কিনা একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত বিশেষ।

শ্রমজীবী নারী আন্দোলন

“ঠিক ঠিক, খুব সত্যি কথা, চমৎকার কথা”- স্মিথ হেসে লেনিন বললেন। “পেট্রোগ্রাডে, এই মস্কোতে, অন্যান্য শহরে ও শিল্পাঞ্চলে নারী শ্রমিকরা বিপ্লবের সময় অদ্ভুত কাজ করেছেন, তাঁদের ছাড়া আমরা বিজয়ী হতেই পারতাম না, বা আমাদের জয় প্রায় অসম্ভব হতো। এই আমার মত। তাঁরা যে কত বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং এখনও দিচ্ছেন। ভেবে দেখ কতো কষ্ট, কত বঞ্চনা সহ্য করেছেন তাঁরা। আর এখনও যে তাঁরা তা করতে পারছেন তার কারণ তাঁরা চান স্বাধীনতা, তাঁরা চান কমিউনিজম। হ্যাঁ, আমাদের সর্বহারা নারীরা চমৎকার শ্রেণী সংগ্রামী। তাঁরা প্রশংসা ও ভালবাসার যোগ্য। তাছাড়া একথাও মনে রেখ এমনকি পেট্রোগ্রাডে ‘কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রাসি’ দলের ভদ্রমহিলারাও পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐ জাঙ্কারদের চেয়ে বেশি সাহসের পরিচয় গিয়েছেন। এ কথা সত্য। আমাদের পার্টিতে আছেন বিশ্বাসী, যোগ্য এবং অক্লান্ত পরিশ্রমী নারী কমরেডরা। আমরা তাঁদের সোভিয়েতে, এক্সিকিউটিভ কমিটিতে, পিপলস কমিসারিয়েটে এবং সর্বরকম নাগরিক প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট পদে নিয়োগ করতে পারি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই পার্টিতে সর্বহারা জনগণের মধ্যে কৃষকদের মধ্যে লালফৌজের মধ্যে দিবারাত্র কাজ করে থাকেন। আমাদের কাছে এর মূল্য অনেক। পৃথিবীময় সমস্ত নারীর কাছেও এর মূল্য আছে। এতে নারীদের যোগ্যতার প্রকাশ পায়। সমাজে তাঁদের কাজের যে কতখানি মূল্য আছে তার প্রমাণ হয়। মেয়েদের সামাজিক সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম সর্বহারা একনায়কত্ব সত্যই পথপ্রদর্শক। এই একনায়কত্ব যত বেশি কুসংস্কার দূর করেছে, তা স্ত্রী জাতির অধিকারের বিষয়ে লেখা গাদা গাদা সাহিত্যও করতে পারত না। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও এখনও আমাদের কোনো আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নারী আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এই জিনিসটির বিশেষ প্রয়োজন। এখনই এ কাজ শুরু করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের ইন্টারন্যাশনালের কাজ ও তার পার্টিগুলির কাজ কখনই সম্পূর্ণ হবে না, হতে পারে না। আমাদের বিপ্লবের কাজ সম্পূর্ণ করে তুলতেই হবে। বিদেশে কমিউনিস্টদের কাজ কেমন হচ্ছে বল ?

সামনের দিকে সামান্য একটু হেলে বসে লেনিন এক মনে সব শুনলেন। এমনকি ছোট ছোট ঘটনাগুলি পর্যন্ত শুনতে লাগলেন। বিরক্তি, অধৈর্য বা ক্লান্তির কোনো চিহ্নই নেই। ‘মন্দ নয়, মোটেই মন্দ নয়’- লেনিন বললেন। “নারী কমরেডদের শক্তি কাজের ইচ্ছা, উদ্দীপনা- বেআইনি বা আধা আইনি সময়ে তাঁরা যে সাহস ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তা থেকেই বোঝা যায় যে আমাদের অগ্রগতির ভবিষ্যৎ খুবই ভাল। পার্টির প্রসারের দিক থেকে, পার্টির শক্তিবৃদ্ধির দিক থেকে, জনসাধারণকে জয় করবার ও আমাদের কাজকর্ম চালিয়ে নিয়ে যাবার দিক থেকে তাঁরা খুবই মূল্যবান শক্তি। কিন্তু এই সব পুরুষ ও নারী কমরেডদের শিক্ষা দেবার ও তাদের কর্মনীতি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবার বিষয়টার কি হলো? জনসাধারণের মধ্যে কাজ করতে হলে এ বিষয়টার মৌলিক গুরুত্ব আছে। জনসাধারণকে জয় করতে হলে, তাদের উৎসাহিত করতে হলে এ জিনিসটির প্রভাব প্রভুত। কথায় বলে : “মহৎ কাজ সম্পন্ন করতে চাই উদ্দীপনা”। আমাদের এবং সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের সত্যই মহৎ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তাহলে বল, তোমাদের কমরেডরা, জার্মানির সর্বহারা নারীরা কিসে উদ্দীপনা পান ? তাঁদের সর্বহারা শ্রেণীচেতনা কতদূর জেগেছে? তাঁদের উৎসাহ তাঁদের কাজকর্ম কি শুধু আশু রাজনৈতিক দাবিগুলিকে ঘিরেই? তাঁদের ধ্যান ধারণার মূল উৎস কি?

রুশ ও জার্মান কমরেডদের কাছ থেকে আমি এ বিষয়ে কতকগুলি অদ্ভুত কথা শুনেছি। তা তোমাকে বলতেই হবে। আমি শুনলাম যে, হামবুর্গের একজন প্রতিভাসম্পন্ন কমিউনিস্ট নারী পতিতা নারীদের জন্য একখানি কাগজ প্রকাশিত করেছেন এবং তিনি তাদের বৈপ্লবিক সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করতে চান। পতিতারা তাদের ভয়ঙ্কর ব্যবসা চালাবার সময় পুলিসের কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করার জন্য গ্রেপ্তার হয় তাদের পক্ষ হয়ে রোজা এক প্রবন্ধ লিখে ভেবেছিলেন যে তিনি বুঝি কমিউনিস্টের কাজ করছেন। দুর্ভাগ্যবশত বুর্জোয়া সমাজে পতিতাদের দু’বার করে বলি দেওয়া হয়েছে। প্রথমত এই সমাজের অভিশপ্ত সম্পত্তি প্রথার দ্বারা, দ্বিতীয়ত এর অভিশপ্ত নৈতিক শঠতার দ্বারা, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। নিতান্ত পশু না হলে অথবা অদূরদর্শী না হলে এ কথা ভোলা যায় না। কিন্তু তবুও সে হলো এক জিনিস। আর কিভাবে বলবো কথাটা? এই মনে কর যে, পতিতারা এক বিশেষ শক্তিশালী বৈপ্লবিক অংশ, আর সেই ভেবে তাদের সংগঠিত করা, কারখানা থেকে তাদের জন্য কাগজ বের করা- এ হলো অন্য জিনিস। জার্মানিতে কি সত্যই অন্য কোনো শ্রমজীবী নারীরা নেই- যাদের সংগটিত করা যায়, আর যাদের কিনা তোমাদের সংগ্রামের মধ্যে টেনে আনা যায় ? ওরা হলো ব্যাধিগ্রস্থ সমাজদেহের অতিরিক্ত মাংসপিন্ডের মতো। মনে পড়ে গেল- প্রত্যেকটি পতিতাকেই কুমারী মেরীর মনোরম আলেখ্যরূপে আঁকবার সাহিত্যিক ফ্যাশানের কথা। অবশ্য এরও মূলে আছে সুস্থ চিন্তা ও সামাজিক সমবেদনা, সম্মানিত বুর্জোয়াদের ধার্মিক শঠতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কিন্তু সেই সুস্থ দিকটা দূষিত অধঃপতিত হয়ে গেছে।

“তাছাড়া পতিতাদের প্রশ্নে এখানে অনেক গুরুতর সমস্যা উঠবে। তাদের উৎপাদনশীল কাজের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, সামাজিক অর্থনীতির মধ্যে নিয়ে এসো। এই কাজ আমাদের করতেই হবে। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে ও প্রচলিত পরিস্থিতির কথা ভেবে দেখলে এ কাজ খুবই কঠিন ও জটিল। সর্বহারাদের ক্ষমতা দখলের পর নারীদের সমস্যার এই দিকটা আমাদের সামনে একটা মস্তবড় বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের একটা বাস্তব সমাধানে আসতে হবে। এখানে সোভিয়েত রাশিয়ায় আমাদের সামনে মস্তবড় কাজ রয়েছে। কিন্তু জার্মানিতে তোমাদের অবস্থা ভাবতে গেলে পার্টি মেম্বারদের পক্ষে এই ধরনের ক্ষতিকর কাজ সম্পর্কে পার্টির কোনোমতেই চুপ করে থাকা চলে না। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আর কর্মশক্তি বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর তুমি নিজে এর বিরুদ্ধে কি করছ ?”

যৌন সমস্যা ও বিবাহ

আমার উত্তর দেবার আগেই লেনিন বলে চললেন: “ক্লারা তোমাদের এই পাঠের তালিকা তবুও অনেক দীর্ঘ। আমি শুনেছি যে, নারী কমরেডদের সান্ধ্য পাঠ ও আলোচনার প্রধান বিষয়ই হলো যৌন সমস্যা ও বিবাহ। এইটিই তাদের প্রধান আকর্ষণ, রাজনৈতিক উপদেশ ও শিক্ষার প্রধান বিষয়। একথা শুনে আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। সর্বহারা একনায়কত্বের প্রথম দেশকে ঘিরে রেখেছে সারা দুনিয়ার প্রতিবিপ্লবীরা। জার্মানির নিজের অবস্থার দরুনই আজ প্রয়োজন সমস্ত সর্বহারাদের যথাসাধ্য সম্মিলিত করা। এখন বৈপ্লবিক শক্তিগুলির প্রয়োজন ক্রমবর্ধমান প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে পরাজিত করা। কিন্তু শ্রমজীবী নারী কমরেডরা কিনা আলোচনা করছেন যৌন সমস্যা, অতীতের বর্তমানের ও ভবিষ্যতের বিবাহ পদ্ধতির কথা। তাঁরা মনে করছেন যে, সর্বহারা নারীদের এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল করা তাঁদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। আমার মনে হয় যে পুস্তিকাখানি সব চেয়ে বেশি লোক পড়েছে, সেইট হলো যৌন সমস্যার উপর ভিয়েনার এক তরুণী কমরেডের লেখা পুস্তিকা। কি অপচয়! এরমধ্যে যেটুকু সত্য আছে তা শ্রমিকরা অনেক আগেই বেবেলের লেখায় পড়েছেন। আর বেবেলের লেখাটা এই পুস্তিকার মতো এত একঘেয়ে, এত গুরুপাক নয়- সে লেখায় আছে দৃঢ়তা, আছে বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ।

ফ্রয়েডের মতবাদকে আরও বেশিদূর টেনে নিয়ে যাওয়া যেন ‘পন্ডিতি’ এমনকি বিজ্ঞানসম্মত বলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা হলো মূর্খতা ও আনাড়িপনা। ফ্রয়েডের মতবাদ আধুনিক ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌন সমস্যার ওপর প্রবন্ধগুলির মতামত, তর্কাতর্কি, ঐ পুস্তিকাগুলি সংক্ষেপে- বলতে গেলে, বুর্জোয়া সমাজের নোংরা মাটিতে ঠিক যে ধরনের সাহিত্যগুলি ফন ফন করে বেড়ে ওঠে- সেগুলিতে আমার বিশ্বাস নেই, নিজ নাভির প্রতি নিবদ্ধদৃষ্টি ভারতীয় যোগীর মতো এই সব প্রশ্ন নিয়ে যারা সব সময়ই মাথা ঘামায় তাদের প্রতি আমার আস্থা নেই। আমার মনে হয় এই সব আড়ম্বরযুক্ত যৌন তত্ত্বগুলি যা কিনা প্রধানত প্রতারণামূলক এবং প্রায়ই নিছক কল্পনাপ্রসূত, সেগুলি ওঠে বুর্জোয়া নৈতিকতার কাছে মাথা নোয়ানো আর নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের অস্বাভাবিকতা ও ভোগের আতিশ্যকে সমর্থন করার খাতিরে। বুর্জোয়া নৈতিকতার প্রতি এই প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধাকে আমার অত্যন্ত বিরক্তিজনক মনে হয়, এবং এর দ্বারা যৌন সমস্যার বিষয়গুলিকে আরও খুঁচিয়ে তোলা হয়। এই আচরণগুলি যতই উৎকৃষ্ট ও বৈপ্লবিক হোক না কোন, আসলে বুর্জোয়াসুলভ। এগুলি প্রধানত বুদ্ধিজীবীদের ও তাদেরই ঘনিষ্ঠতম লোকদের সখের ব্যাপার। পার্টিতে, শ্রেণীসচেতন সংগ্রামী সর্বহারাদের মধ্যে এর কোনো স্থান নেই।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম যে ব্যক্তিগত সম্পত্তিবিশিষ্ট বুর্জোয়া সমাজে যৌন জীবন ও বিবাহের ব্যাপারে অনেক রকম সমস্যা দেখা দেয়, অনেক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং তাতে সমাজের প্রত্যেক শ্রেণী ও প্রত্যেক স্তরের নারীদের জীবনে অনেক দুর্গতি হয়ে থাকে। নারীদের জীবনে যৌন সমস্যা উদ্ভুত দুঃখ-কষ্টগুলি ও তার পরিণতির ফলে অনেক প্রবল হয়ে উঠেছে, এবং তাদের সামনে অনেক অনেক নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে- যেগুলি কিনা পূর্বে চাপা পড়েছিল এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া। পুরনো দিনের অনুভূতি ও চিন্তার জগৎ টলতে শুরু করেছে, পুরানো সামাজিক বাঁধনগুলি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ও ভেঙে যাচ্ছে। নতুন চিন্তাধারায় পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক গড়ে তুলবার দিকে ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। এই সব প্রশ্নে যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তা থেকেই বোঝা যায় যে, এই বিষয়ে নতুন আলোকপাত, নতুন দৃষ্টিতে পরিবর্তন সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বুর্জোয়া সমাজের মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়াও এর থেকে সূচিত হয়। বিবাহ ও পারিবারিক জীবনযাত্রার পদ্ধতি, তার ঐতিহাসিক জীবনের উপর এর নির্ভরশীলতা এই জিনিসগুলিই শ্রমজীবী নারীদের মন থেকে এ সংস্কার দূর করে দিচ্ছে যে বুর্জোয়া সমাজ চরিত্রই শাশ্বত নয়। এ বিষয়ে সমালোচনামূলক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থাকে নির্মমভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। এই সমাজের প্রকৃত চরিত্র ও তার ফলাফলগুলিকে- এর যৌন জীবনের নৈতিকতা ও তার মিথ্যাকে স্পষ্ট করে উন্মুক্তকরা দরকার। সব রাস্তাই রোমের দিকে। সমাজের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সামাজিক কাঠামোর যে কোনো প্রয়োজনীয় অংশের উপর প্রত্যেকটি প্রকৃত মার্কসীয় বিশ্লেষণই বুর্জোয়া সমাজের সম্পত্তি প্রথার ভিত্তির বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। আর পরিষ্কার উপলব্ধি করা দরকার যে, এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতেই হবে।’

লেনিন হেসে মাথা নাড়লেন। “এই তো! তুমি তোমার নারী কমরেডদেরও পার্টির পক্ষে সুপারিশ করছ। অবশ্য তুমি যা বলছ তা ঠিক। কিন্তু এর দ্বারা জার্মানিতে যে ভুল করা হয়েছে তাকে ক্ষমা করা হয়, তার ন্যায্যতা প্রমাণ করা হয় না। সেগুলি ভুলই, এবং ভুলই থেকে গেল। তুমি বাস্তবিকই স্থির বিশ্বাসে আমাকে একথা বোঝাতে পার যে যৌন ও বিবাহ সমস্যার প্রশ্নগুলি পরিণত, জীবন্ত, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো ? তার জন্য গভীর বহুমুখী জ্ঞানের, প্রয়োজন প্রভূত পরিমাণে মার্কসীয় বিচক্ষণতার। সে শক্তি এখন তোমরা কোথায় পাবে ? তা যদি থাকত তবে যে পুস্তিকার কথা আমি বললাম ঔ ধরনের পুস্তিকা পড়া এবং সমালোচনার জন্য ব্যবহার করা হতো না। তার সমালোচনা না করে উলটো তাকে সমর্থন করে প্রচার করা হয়েছে। এবং এই অনর্থক, অমার্কসীয় আলোচনার ফল কি হয়েছে ? যৌন সমস্যাগুলি বৃহৎ সমাজ জীবনের অংশ হিসাবে বোঝা হয়নি। না, তার চেয়েও খারাপ হয়েছে। বৃহৎ সমাজ জীবনের অংশ হিসাবে বোঝা হয়নি। না, তার চেয়েও খারাপ হয়েছে। বৃহৎ সমাজিক সমস্যাগুলিকেই যৌন সমস্যার আনুষঙ্গিক হিসাবেরর অংশ হিসাবে মনে করা হয়েছে। মূল জিনিসটিকে আনুষঙ্গিক হিসাবে ধরা হয়েছে। এর দ্বারা শুধু যে এই প্রশ্নটিকেই পরিষ্কার করে বুঝতে অসুবিধার সৃষ্টি করে তাই নয়, এতে সাধারণভাবে সর্বহারা নারীদের শ্রেণীচেতনা ও চিন্তাকে গুলিয়ে দেয়।

“শেষ গুরুত্বপূর্ণ কথা। এমনকি জ্ঞানী সলোমনও বলেছেন যে প্রত্যেকটি জিনিসেরই একটা সময় আছে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি এই কি সেই সময় যখন সর্বহারা নারীরা মজা করে এইসব আলোচনা করতে পারে যে কেমন করে একজন ভালোবাসে বা কেমন করে কেউ তার প্রেমে পড়ে ? কেমন করে বিয়ে হয় বা তাকে বিয়ে করে ? অবশ্যই, অতীতে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশে গর্বের সঙ্গে যাকে বলা হয়েছে বস্তুবাদ ! এখন মহিলা কমরেডদের, শ্রমজীবী মানুষের ঘরের নারীদের সমস্ত চিন্তাকে সর্বহারা বিপ্লবের দিকে নিয়ে যেতেই হবে। তা থেকেই বিবাহ ও যৌন সমস্যার বিষয়ে প্রকৃত নতুন চিন্তার ভিত্তি রচিত হয়। এই মুহূর্তের আগের দিনের মেওরীদের বা অবৈধ বিবাহের পদ্ধতি কি ছিল তার চেয়ে অন্য সমস্যাগুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানির সর্বহারাদের সামনে এখনও সোভিয়েত গড়ার প্রশ্ন বাকি আছে। ভার্সাই সন্ধি, শ্রমজীবী নারীদের জীবনে তার কী ফল- বেকারী, মজুরি হ্রাস, ট্যাক্স এবং আরও কত কি। সংক্ষেপে আমি বলি যে সর্বহারা নারীদের জন্য এই ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক শিক্ষা মিথ্যা- সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ মিথ্যা। কেমন করে এ বিষয়ে নীরব থাকবে ? এর বিরুদ্ধে তোমাদের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতেই হবে।”

২.

যৌন নৈতিকতা

আমি তাকে বললাম যে, নেতৃস্থানীয় মহিলা কমরেডদের আমি এ বিষয়ে সমালোচনা করেছি, ভৎসনাও করেছি। কিন্তু আমার সমালোচনার ফলে আমাকেই আবার শুনতে হয়েছে যে আমি নাকি “সোস্যাল ডেমোক্রাসির মতবাদ সমর্থন করছি আর সেকেলে সঙ্কীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছি”।

তিনি বললেন “জানি জানি এ বিষয়ে আমাকেও অনেকে সঙ্কীর্ণ বলেছে। কিন্তু আমার কাছে সে সব কথা বিরক্তিকর বলে মনে হয়। এ সব বলার মধ্যে অনেক শঠতা, অনেক সঙ্কীর্ণতা রয়েছে। যাহোক, আমি সে সব ধীরভাবে সহ্য করছি। বুর্জোয়া ভাবধারায় ডিম থেকে সদ্যোজাত হলুদ ঠোঁটওয়ালা ক্ষুদ্র পাখিগুলি সব সময়ই ভয়াবহ রকমের চালাক। তাদের কথা আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। যৌন সমস্যার বিষয়গুলির প্রতি মনোভাবের দিক থেকে যুব আন্দোলন পর্যন্ত আধুনিকতার ব্যাধি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে, এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাচ্ছে।” আধুনিকতা শব্দটির ওপর লেনিন শ্লেষাত্মক জোর দিয়ে বললেন, আর বলবার সময় মুখভঙ্গি করে উচ্চারণ করলেন : “আমি এ কথা শুনেছি যে যুব সংগঠনগুলির কাছেও যৌন সমস্যার অধ্যয়ন প্রিয় হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে নাকি আরও অনেক বক্তার প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। এই রকম ভুল ধারণা যুব আন্দোলনের পক্ষে বিশেষভাবে ক্ষতিকর, খুবই বিপজ্জনক। এর দ্বারা তাদের অনেকের উত্তেজনা বাড়তে পারে, যৌন জীবনের বাড়াবাড়ি হতে পারে, যার ফলে যুবকদের স্বাস্থ্য ও শক্তির অপচয় হবে। এর বিরুদ্ধেও তোমাদের লড়তে হবে। নারী আন্দোলন ও যুব আন্দোলনের মধ্যে যোগাযোগের অনেক সূত্র আছে। আমাদের নারী কমরেডদের নিয়মিতভাবে যুবকদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। তার দ্বারা মাতৃত্বের প্রভাব ব্যক্তিগত পরিধি থেকে সামাজিক পরিধির মধ্যে বিস্তারিত হবে নিরবচ্ছিন্ন উন্নতভাবে প্রভাব বিস্তার করবে। এবং নারীদের সামাজিক জীবনের জাগরণ, তাদের সমস্ত কাজে উৎসাহ সঞ্চার করা, যাতে তাঁরা ব্যক্তিগত গৃহসীমার সঙ্কীর্ণতা ও পারিবারিক মনস্তত্বকে বর্জন করতে পারে। আমরা এ কথায় আবার পরে আসব।

“আমাদের এখানেও যুবকদের মধ্যে অনেকেই যৌন সমস্যার বিষয়ে বুর্জোয়া ধারণাকে সংশোধন করে নেবার জন্য আগ্রহান্বিত । এবং এ কথাও বলতে হবে যে তাদের মধ্যে আমাদের কিছু কিছু সবচেয়ে ভাল, সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন যুবকরাও আছে। আগে তুমি যা বললে তা ঠিক। যুদ্ধ ও বিপ্লবের ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে পূর্বেকার পুরাতন আদর্শের মূল্য আর নেই, বা তার প্রভাব নেই। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নতুন মূল্যবোধ দানা বেঁধে উঠছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ, স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ সম্পর্কে অনুভূতি ও চিন্তায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তির অধিকার ও সমগ্রের অধিকারের মধ্যে, ব্যক্তির কর্তব্য বিষয়ে নতুন সীমারেখা স্থাপিত হচ্ছে। এখনও বিষয়টি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। ঘটনার গতিপথ এখনও সুনির্দিষ্ট হয়নি, বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী ভাবধারার মধ্যে দিয়ে যে শক্তিগুলির বিকাশ হবে তা এখন পরিষ্কার সংজ্ঞা লাভ করেনি। এটা ক্ষয় বৃদ্ধির খুব ধীর মন্থর, কখনও কখনও খুব বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া। এবং বিশেষ করে যৌন সম্বন্ধ বিবাহ ও পরিবারের বিষয়ে এ কথা সত্য। বুর্জোয়া বিবাহ প্রথার ক্ষয়িষ্ণুতা, ব্যভিচার, বিবাহ বিচ্ছেদের দুষ্কর ব্যবস্থা, এই প্রথায় পুরুষের স্বাধীণতা ও নারীদের দাসত্ব, যৌন নৈতিকতা ও যৌন সম্বন্ধের বিষয়ে ন্যাক্কারজনক শঠতা সবচেয়ে সক্রিয় ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মনকেও গভীর বিরক্তিতে ভরিয়ে দেয়।”

৩.

“বুর্জোয়া বিবাহের বাধ্যবাধকতা ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পারিবারিক আইনের ফলে সমাজের এই কুফল ও সংঘাতগুলি আরও সুতীব্র হয়ে ওঠে। এ হলো ‘পবিত্র সম্পত্তি ব্যবস্থা’র ফল। এতে ব্যাভিচার অবমাননা আর নোংরামিকে একটি পবিত্র রূপ দেওয়া হয়, এবং সৎ বুর্জোয়া সমাজের রীতিনীতির শঠতা বাকিটা করে দেয়। বর্তমানে সামাজিক পচন আর মিথ্যার বিরুদ্ধে লোকে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে, এবং ব্যক্তিগত অনুভূতিও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। যখন শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলি ধ্বংস হতে শুরু করেছে পুরাতন শাসন পদ্ধতি ভেঙে যাচ্ছে, যখন একটা গোটা সামাজিক জগতই অবলুপ্ত হতে শুরু করেছে তখন আনন্দ উপভোগ করবার আশঙ্কা ও ব্যগ্রতা সহজেই বাঁধনহীন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। বুর্জোয়া রীতি অনুযায়ী যৌন সম্বন্ধ ও বিবাহ পদ্ধতির ধরণগুলি অসন্তোষজনক। যৌন সম্বন্ধ ও বিবাহের ব্যাপারে সর্বহারা বিপ্লবের অনুযায়ী একটা বিপ্লব এগিয়ে আসছে। একথা সহজেই অনুমান করা যায় যে এই জটিল সমস্যায় যুবকদের এবং নারীদেরও মন লিপ্ত হবে। বিশেষ করে বর্তমান দিনের যৌন সমস্যার অসুবিধাগুলিতে তাদের ভুগতে হয়। তাদের বয়সসুলভ সমস্ত প্রাবল্য নিয়েই তারা বিদ্রোহ করছে। সে কথা আমরা বুঝতে পারি। যুবকদের কাছে মঠের তপস্যা আর নোংরা বুর্জোয়া নৈতিকতার পবিত্রতার গুণ গাওয়ার চেয়ে মিথ্যা আর কিছু নেই। আর দেহে যখন স্পষ্টতই যৌবন দেখা দেয়, তখন মনেও যদি যৌন সমস্যা প্রধান চিন্তা হয়, তাহলে বিষয়টি আরও গুরুতর হয়। তার ফল কী সাংঘাতিক হয়!”

“যৌন জীবনের প্রশ্নগুলির প্রতি যুবকদের পরিবর্তিত মনোভাবের পেছনে অবশ্য ‘নীতি’ ও তত্ত্বগত ভিত্তি আছে। তাদের অনেকেই নিজেদের মনোভাবকে ‘বৈপ্লবিক’ ও ‘কমিউনিস্ট’ বলে থাকে। এবং তারা সে কথা সৎ ভাবেই বিশ্বাস করে। এতে আমাদের মতো পুরনো লোকদের মনে দাগ কাটে না। যদিও এ বিষয়ে আমি একজন বিষন্ন সন্ন্যাসী ছাড়া আর কিছুই নই- যুবকদের তথাকথিত ‘নতুন যৌন জীবন’- কখনও কখনও, বুড়োদেরও – আমার কাছে প্রায়ই মনে হয় একদম বুর্জোয়া, বুর্জোয়া গণিকালয়েরই প্রসার। আমরা কমিউনিস্টরা ভালবাসার স্বাধীনতাকে যেভাবে বুঝি তার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। তুমি নিশ্চয়ই এই বিখ্যাত তত্ত্ব শুনেছ যে কমিউনিস্ট সমাজে যৌন কামনা, ভালবাসার পরিতৃপ্তি জিনিসটা নেহাতই এক গ্লাস জল খাবার মতো সরল ও গুরুত্বহীন ব্যাপারে দাঁড়াবে। এই এক গ্লাস জলের থিওরি আমাদের যুবকদের পাগল করে তুলেছে- ঠিক পাগলই। অনেক অল্পবয়স্ক ছেলে ও নারীদের পক্ষে এ জিনিস মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। এর সমর্থকরা মনে করেন যে এ মত মার্কসবাদী। কিন্তু যে মার্কসবাদ সমাজের তত্ত্বমূলক মতবাদের প্রত্যেকটি বহিরাঙ্গিক ঘটনা ও পরিবর্তনের হেতু স্বরূপ সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও আশু যোগসূত্র দেখিয়ে দেয়, সেই মার্কসবাদকে নমস্কার! বিষয়টি এত সোজা নয়। সেই একজন ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ঐতিহাসিক মতবাদ প্রসঙ্গে তা অনেক আগেই দেখিয়ে দিয়েছেন।”

“আমি মনে করি এই এক গ্লাস জলের থিওরি সম্পূর্ণ অমার্কসীয় এবং উপরন্তু সমাজ বিরোধী। যৌন জীবনের স্থুল বিষয়টি শুধু দেখলেই হবে না। এর কৃষ্টিমূলক বৈশিষ্ট্যগুলি- সেগুলি উচ্চ কি নিম্নস্তরে তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। এঙ্গেলস তাঁর ‘অরিজিন অব ফ্যামিলির’ মধ্যে দেখিয়েছেন যে ব্যক্তিগত যৌন প্রেমের মধ্যে সাধারণ যৌন প্রবৃত্তির বিকাশ ও উৎকর্ষের তাৎপর্য কতখানি। পরস্পরের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের দিকটা যে মনস্তত্ত্বের দিক থেকে চিন্তা বিবর্জিত, শুধুই যে সমাজের অর্থনীতি ও শারীরিক প্রয়োজনের পারস্পরিক প্রভাবের প্রকাশ তা নয়। এই সব বিষয়ের পরিবর্তনের কারণগুলি প্রত্যক্ষভাবে দেখতে চেষ্টা করা- সমগ্রভাবে তত্ত্বগত ও সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির সঙ্গে এর সম্বন্ধ না দেখা হলো হেতুবাদ, মার্কসবাদ নয়। নিশ্চয়ই, তৃষ্ণা থাকবেই। কিন্তু কোনো স্বাভাবিক মানুষ, স্বাভাবিক অবস্থায় কি নর্দমায় শুয়ে পড়ে নালার নোংরা কাদা জল পান করে? অথবা অনেকের মুখের এঁটো গ্লাসের জল খায়? কিন্তু এর সামাজিক দিকটা সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। জলপান করা জিনিসটা নিশ্চয়ই একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু প্রেমের সঙ্গে দুটি জীবন জড়িত! এবং আর একটি তৃতীয় নতুন জীবনও আসে। এটাই এর সামাজিক দিক এবং এর থেকেই সমাজের প্রতি দায়িত্বও এসে যায়।”

“একজন কমিউনিস্ট হিসাবে ‘এক গ্লাস জলের তত্ত্বের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। যদিও এর শিরোনামটি চমৎকার- প্রেমের পরিতৃপ্তি। যাই হোক প্রেমের এই রকম মুক্তি নতুনও নয় আর একে কমিউনিস্টও বলা যায় না। তোমার মনে পড়বে যে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি রোমান্টিক সাহিত্যের এই জিনিসটিকেই হৃদয়ের মুক্তি বলে প্রচার করা হয়েছিলো। বুর্জোয়াদের হাতে তা দেহের মুক্তিতে পরিণত হলো। সেই সময়কার প্রচার এখানকার চেয়ে বুদ্ধিমানের মতো হয়েছিল। আর কার্যক্ষেত্রে এমন কী তফাত হয়েছে তা আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমার সমালোচনা দ্বারা আমি সন্ন্যাস ধর্ম প্রচার করতে চাই না। কোনো মতেই না। কমিউনিজম সন্ন্যাস ধর্ম আনবে না- আনবে জীবনের আনন্দ, জীবনের শক্তি, আর তা আনতে সাহায্য করবে পরিতৃপ্ত প্রেমের জীবন। কিন্তু আমার মতে বর্তমানে যৌন বিষয়গুলির বিস্তারিত আতিশয্যে জীবনের আনন্দ ও শক্তি আসে না বরং কমে যায়। বিপ্লবের যুগে তা ভাল নয়- খুবই খারাপ।”

“যুবকদের জন্য বিশেষ করে জীবনের আনন্দ ও শক্তি চাই। স্বাস্থ্যকর খেলা, সাঁতার, দৌঁড়ানো, হাঁটা, সব রকমের শারীরিক ব্যায়াম এবং বুদ্ধিবৃত্তি উৎকর্ষের বহুমুখী আকর্ষণ চাই। যতটা সম্ভব সাধারণভাবে পড়া, অধ্যয়ন করা, প্রশ্ন দরকার। অনবরত যৌনতত্ত্ব, যৌন সমস্যা নিয়ে আলোচনার চেয়ে, আর তথাকথিত সম্পূর্ণভাবে বেচে থাকার চেয়ে এর থেকে যুবকদের বেশি লাভ হবে। স্বাস্থ্যবান শরীর, স্বাস্থ্যবান মন মঠের সন্ন্যাসীও নয় ডন জুয়ানও নয়। আবার জার্মান সঙ্কীর্ণতার মাঝামাঝি মনোভাবও নয়। জানো যুবক কমরেড কে ? একটি চমৎকার ছেলে, অত্যন্ত বুদ্ধিমান, তবুও আমার ভয় যে তার দ্বারা কিছুই ভাল কাজ হবে না। সে একটা প্রেমের ব্যাপার থেকে আর একটায় টালমাটাল খেয়ে বেড়ায়। তার দ্বারা রাজনৈতিক সংগ্রাম হবে না, বিপ্লব হবে না। আর যে সব নারী তাদের ব্যক্তিগত রোমাঞ্চের সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলে তাদের ওপর যে কতটা নির্ভর করা চলে, আর তাদের সংগ্রাম নিষ্ঠাও যে কতখানি তা আমি হলপ করে বলতে পারি না। আর যে সব ছেলেরা প্রত্যেক মেয়ের পেছনেই ছোটে, আর প্রত্যেক যুবতী মেয়েরই ফাঁদে পড়ে, তাদের কথা বলতে পারি না। না না তাদের সঙ্গে বিপ্লবের সম্বন্ধ নেই।”

“বিপ্লব দাবি করে অভিনিবেশ শক্তি বৃদ্ধি — জনণের কাছ থেকে, ব্যক্তির কাছ থেকে। দ্য অ্যনুনজিও (উদ অহহঁহুরড়) ক্ষয়িষ্ণু নায়ক নায়িকাদের পক্ষে যা স্বাভাবিক সেই রকম প্রমোদোন্মাদ অবস্থা বিপ্লব কখনও সহ্য করতে পারে না। যৌন জীবনে লাম্পট্য হলো বুর্জোয়া বৈশিষ্ট্য- ক্ষয়ের লক্ষণ। সর্বহারারা একটি উদীয়মান শ্রেণী। এদের পক্ষে নিস্তেজক বা উত্তেজক ওষুধের দরকার হয় না। যৌন আতিশয্য বা মাদকদ্রব্য কোনো উত্তেজকেরই প্রয়োজন নেই। এরা কখনই ভুলবে না- কিছুতেই ভুলবে না ধনতন্ত্রের লজ্জা, ক্লেদ, ক্রুরতা। শ্রেণীর অবস্থা থেকে কমিউনিস্ট আদর্শ থেকেই তারা সংগ্রাম করার সবচেয়ে বেশি প্রেরণা লাভ করে।”
“সব কথা স্পষ্ট করে বোঝা দরকার- স্পষ্ট, খুব স্পষ্ট। সুতরাং আমি আবার বলি, এই শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া চলবে না, শক্তির অপচয় ও শক্তিক্ষয় চলবে না। আত্মসংযম, আত্মশৃঙ্খলা দাসত্ব নয়- প্রেমের ক্ষেত্রেও নয়। কিন্তু ক্লারা, আমাকে ক্ষমা করে, আমি আমাদের আলোচনার সূত্র থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। তুমি আমাকে বলনি কেন ? আমার মনের সঙ্গে সঙ্গে আমার জিভ ছুটে চলেছে। আমাদের যুবকদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি গভীরভাবে ভাবছি। এ হলো বিপ্লবের একটি অংশ এই ক্ষতিজনক মনোভাবগুলি যদি দেখা যায়, সেগুলি বুর্জোয়া সমাজের থেকে বিপ্লবের জগতে গুড়ি মেরে মেরে আসে- যেমন অনেক আগাছার শিকড় ছড়িয়ে পড়ে- তাড়াতাড়ি সেগুলিকে লড়াই করে শেষ করে দেওয়া ভাল। এই প্রশ্নগুলি নারীদের সমস্যার অংশ।”

৪.

সংগঠনের নীতি

ঘড়ির দিকে এক পলক লেনিন বললেন : “ তোমাদের জন্য যতটা সময় দেব ভেবেছিলাম ইতিমধ্যেই তার অর্ধেক কেটে গেল, আমি বকেই চলেছি। নারীদের মধ্যে কমিউনিস্টদের কাজের প্রোগ্রাম তোমাকে ঠিক করতে হবে। চটপট বল, তুমি কি ধরনের প্রোগ্রাম ভেবেছ ?”

আমি সংক্ষেপে সে কথা বললাম। লেনিন বাধা না দিয়ে বারে বারে মাথা নাড়লেন। আমার কথা শেষ হলে প্রশ্নসূচকভাবে তাঁর দিকে তাকালাম।
তিনি বললেন, “ঠিক। আমি কয়েকটি প্রধান প্রধান বিষয়ে বলতে চাই- যে বিষয়ে তোমার মতের সঙ্গে আমার মিল আছে। আমার মনে হয় সেগুলি আমাদের বর্তমান প্রচার ও আন্দোলনের পক্ষে প্রয়োজনীয় যদি তা কাজে ও সফল সংগ্রামে পরিণত হয়।”

“বক্তব্য বিষয় থেকে একথা পরিষ্কার হওয়া চাই যে নারীদের প্রকৃত স্বাধীনতা কেবলমাত্র কমিউনিজম এর মারফতই আসতে পারে। নারীদের সামাজিক ও মানবিক অবস্থা আর উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার সঙ্গে যে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ সে কথা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে হবেই। তার থেকেই আমাদের নীতি আর নারীবাদ (ফেমিনিজম) এর মধ্যে স্পষ্ট ও মৌলিক পার্থক্য বোঝা যাবে এবং এর দ্বারা নারীদের প্রশ্নকে সামাজিক প্রশ্নের শ্রমিক সমস্যার অংশ হিসাবেই বুঝবার ভিত্তি যোগাবে। সুতরাং এই প্রশ্নকে সর্বহারা শ্রেণী সংগ্রাম ও বিপ্লবের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে জড়াতে হবে। কমিউনিস্ট নারীদের আন্দোলনটাই একটা গণআন্দোলন, সাধারণ গণআন্দোলনের অংশ হতেই হবে। শুধু সর্বহারাদের নয়, সমস্ত শোষিত ও নির্যাতিতদের – ধনতন্ত্র বা অন্য কিছুর শিকার যারা তাদেরই। তার মাঝেই আছে সর্বহারা শেণী সংগ্রামের তাৎপর্য এবং তার ঐতিহাসিক সৃষ্টি- কমিউনিস্ট সমাজ। আমরা প্রকৃতই গর্বের সঙ্গে এ কথা বলতে পারি যে আমাদের পার্টিতে, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে রয়েছে বিপ্লবী নারীজাতির ফুলগুলি। কিন্তু সে কথাই যথেষ্ট নয়। গ্রাম ও শহরের হাজার হাজার শ্রমজীবী নারীদের আমাদের দিকে জয় করে আনতেই হবে। তাদের জয় করে আনতে হবে আমাদের সংগ্রামের জন্য এবং বিশেষত কমিউনিজম এর দিকে, সমাজের রূপান্তরের জন্য। নারীদের ছাড়া কোন সত্যিকারের গণআন্দোলন হতে পারে না।”

“আমাদের তত্ত্বগত বোধ থেকেই সংগঠনের নীতিগুলি উদ্ভুত হয়। নারীদের জন্য বিশেষ সংগঠন নয়, ঠিক একজন পুরুষের মতোই একজন নারী কমিউনিস্ট পার্টির একজন সভ্য। তার সমান অধিকার, সমান কর্তব্য। তবুও এদিকে আমাদের চোখ বন্ধ করে থাকলে চলবে না যে সাধারণ শ্রমিক নারীদের উদ্বুদ্ধ করবার, তাদের পার্টির সঙ্গে যুক্ত করবার, তাদের পার্টির প্রভাবে রাখবার বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য সংগঠন, কর্মী গ্রুপ, কমিশন, কমিটি, ব্যুরো বা যা বলো রাখতেই হবে। এ অবশ্য তাদের মধ্যে নিয়মিত কাজের জন্যই প্রয়োজন। আমরা যাদের উদ্বুদ্ধ করি ও জয় করি, তাদের শিক্ষিত করে তুলতেই হবে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রেণী সংগ্রামের জন্য তাদের প্রস্তুত করে তুলতেই হবে। আমি শুধু সর্বহারা নারীদের কথাই ভাবছি না- কারখানাতেই কাজ করুক, আর বাড়িতেই কাজ করুক, সব নারীদের কথাই ভাবছি। গরিব কৃষক রমণী, মধ্যবিত্ত নারী- তারাও ধনতন্ত্রের শিকার এবং যুদ্ধের পর থেকে এর কথা আরও বেশি করে বলা যায়। এইসব নারীদের অরাজনৈতিক অসামাজিক পশ্চাদপদ মানসিক অবস্থা তাদের কর্মক্ষেত্রের বিচ্ছিন্ন পরিধি, তাদের জীবনের সমগ্র ধরণ-ধারণ এ সবই বাস্তব। সেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব- একেবারেরই অসম্ভব। তাদের মধ্যে কাজ চালিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন উপযোগী সংগঠন, বিশিষ্ট প্রচার পদ্ধতি এবং সংগঠনের ধরণ, তার নাম নারীবাদ (ফেমিনিজম) নয়- এ হলো কার্যকরী বাস্তব, বৈপ্লবিক প্রয়োজন।”

আমি লেনিনকে বললাম যে তাঁর কথা আমাকে প্রভূত উৎসাহ দিয়েছে। অনেক কমরেড, ভাল ভাল কমরেড পর্যন্ত জোরের সঙ্গে আপত্তি করে বলেছেন যে নারীদের মধ্যে নিয়মিত কাজের জন্য আলাদা সংগঠন থাকা উচিত নয়।

“এ কোন নতুন কথাও নয়, আর এর থেকে কিছু প্রমাণও হয় না”। লেনিন বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই এর দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছ। আমাদের পার্টিতে নারীদের সংখ্যা কখনও পুরুষদের মতো হয়নি কেন- সোভিয়েত রাশিয়াতে কখনও হয়নি কেন ? ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সংগঠিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা এত কম কেন? এই সব ঘটনাই আমাদের চিন্তার খোরাক যোগাবে। সাধারণ নারীদের মধ্যে কাজের জন্য আলাদা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করার চিন্তাটা আমাদের কমিউনিস্ট লেবার পার্টির অতিরিক্ত অতিরিক্ত আদর্শনিষ্ঠ ও উগ্র বন্ধুদের ধারণার মতোই। তাদের মতে সংগঠনের রূপ থাকবে একটিই- শ্রমিক ইউনিয়ন। আমি তাদের জানি। যখনই চিন্তার দৈন্য দেখা দেয় অনেক বিভ্রান্তমনা বিপ্লবী নীতির দোহাই পাড়ে। যখন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির প্রতি মনের দরজা বন্ধ থাকে তখন এই অবস্থা হয়। এইসব পবিত্র নীতির অভিভাবকরা তাদের ধারণার সঙ্গে আমাদের ওপর ঐতিহাসিকভাবে যে বৈপ্লবীক নীতি ন্যস্ত হয়েছে তার সামঞ্জস্য করে কিভাবে? কঠিন অনিবার্য প্রয়োজনের সময় এই ধরনের সব কথাবার্তার কোনো দামই থাকে না। যতক্ষণ না হাজার হাজার নারী আমাদের সঙ্গে আসছে আমরা সর্বহারা একনায়কত্ব কার্যকরী করে তুলতে পারি না, কমিউনিজম-এর লাইনে গঠনকার্য করতে পারি না। তাদের মধ্যে যাবার পথ বের করতেই হবে। সে পথ বের করবার জন্য আমাদের অধ্যয়ন করতেই হবে, চেষ্টা করতেই হবে।”

এই মুহূর্তের দাবি

“সেই জন্য নারীদের উপযোগী দাবিগুলি তুলে ধরা আমাদের কর্তব্য। সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের সোস্যাল ডেমোক্রাটদের মতানুযায়ী এটা একটা সংস্কারমূলক প্রোগ্রাম নয়, এটা একটা ন্যূনতম কর্মসূচি নয়। নারীদের দাবির কথা বললে এ কথা বোঝায় না যে বুর্জোয়া শাসন ও বুর্জোয়া রাষ্ট্র চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে বিশ্বাস করি। সংস্কারমূলক কাজ দ্বারা নারীদের তোষণ করা বা তাদের বিপ্লবী সংগ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়াও বোঝায় না। তাও নয়, আবার অন্য কোন রকম সংস্কারবাদী প্রতারণাও নয়। আমাদের দাবিগুলি বাস্তব সিদ্ধান্ত। এগুলি জ্বলন্ত প্রয়োজন থেকে উদ্ভুত। এর দ্বারা আমরা দেখাচ্ছি যে আমরা এই দাবিগুলি স্বীকার করি এবং নারীদের অবমাননা ও পুরুষের সুবিধা সম্বন্ধে সচেতন। আমরা ঘৃণা করি- হ্যাঁ যা কিছু নারী শ্রমিকদের, গৃহিণীদের, কৃষক রমণীদের ছোট ব্যবসায়ীদের স্ত্রীদের এবং অনেকক্ষেত্রে সম্পন্ন শ্রেণীর নারীদের নির্যাতন এবং শোষণ করে সে সব জিনিসকেই আমরা ঘৃণা করি এবং বর্জন করি। বুর্জোয়া সমাজের কাছ থেকে আমরা নারীদের জন্য যে অধিকারগুলি ও সামাজিক আইনের দাবি করি, তা থেকেই বোঝা যায় যে আমরা নারীদের অবস্থা ও স্বার্থ বুঝি এবং সর্বহারা একনায়কত্বের সময় আমরা সেগুলি বিবেচনা করবো। অবশ্য সংস্কারবাদীদের মতো তাদের কর্মদক্ষতা শিথিল করে দেব না। তাদের একঘেয়ে কাজের মধ্যে আটকে রাখব না। না কখনই না। আমরা বিপ্লবীদের মতো নারীদের আহ্বান জানাব সমানভাবে পুরাতন অর্থনীতি ও ভাবধারার বিবর্তন সাধন করতে।”
আমি লেনিনকে বললাম তার মতের সাথে আমার মতের মিল আছে। কিন্তু বাধা নিশ্চয়ই আসবে। একথা অস্বীকার করা যায় না যে নারীদের আশুদাবিগুলি ভুলভাবেও তৈরি ও প্রকাশ করা হয়ে যেতে পারে।

“বাজে কথা।” লেনিন প্রায় রাগতভাবেই বলে উঠলেন, “সে বিপদ আমরা যা কিছু করি বা বলি তার সব কিছুতেই আছে। আমরা যদি এই ভয়ে যা ঠিক ও প্রয়োজন তা করতে বিরত হই, তবে আমরা হয়তো চূড়ায় উপবিষ্ট ভারতীয় যোগীতে পরিণত হবো। কোনো কাজকর্মের দরকার নেই, উঁচু স্তম্ভের মাথায় বসে শুধু নীতি ও আদর্শ নিয়ে চিন্তা কর। ঠিকই, আমাদের শুধু দাবিগুলির বিষয়বস্তুর কথা ভাবলেই চলবে না, সেগুলি কিভাবে উপস্থিত করা হবে তাও দেখতে হবে। আমি ভেবেছিলাম যে সে কথা আমি যথেষ্ট পরিষ্কার করে বলেছি। অবশ্য যান্ত্রিকভাবে মালা জপ করবার মতো করে আমাদের দাবিগুলি বলে গেলেই হবে না। না, বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী যখন যেটা সম্ভব তখন সেই দাবির জন্য সংগ্রাম করতে হবে। এবং সর্বহারা সাধারণের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করে কাজ করতে হবে।”

এই রকম প্রতিটি সংগ্রাম সম্মানিত বুর্জোয়া সম্পর্কের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড় করায়, আর আমাদের নিয়ে আসে এই সম্পর্কের সমর্থক সংস্কারবাদী (এদের সম্মানও কম নয়) মোসাহেবদের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদে নেতৃত্বে তাদের লড়াই করতে বাধ্য করে – যা তারা করতে চায় না – অথবা এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাদের প্রকৃত চেহারাগুলি ফুটে বেরোয়। অর্থাৎ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের সঙ্গে অন্য পার্টিদের তফাত পরিষ্কার হয়ে যায়, আমাদের কমিউনিজম স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতদ্বারা আমরা সেইসব সাধারণ নারীদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারি- যার পুরুষের কর্তৃত্ব দ্বারা, মালিকের ক্ষমতার দ্বারা, সমগ্র বুর্জোয়া সমাজের দ্বারা শোষিত, দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ, নির্যাতিত হয়ে থাকে। সবার কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা পেয়ে ও সবার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে শ্রমজীবী নারীরা বুঝতে পারবে যে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংগ্রাম করতেই হবে।

আমায় কি আবার শপথ করে বলতে হবে অথবা তোমাকেই শপথ করে বলতে হবে যে নারীদের দাবির জন্য আমাদের যে সংগ্রাম, তা ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জড়িত করতেই হবে। বর্তমানে এই আমাদের মোট কথা। একথা স্পষ্ট, খুবই স্পষ্ট। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের দাবি যত করেই প্রকাশ করা হোক না কেন। না না, তা নয়- আমাদের দাবির সঙ্গে তাদের নিজেদের দুঃখ কষ্টের প্রয়োজনের এবং আকাক্সক্ষার যে রাজনৈতিক সম্বন্ধ আছে, সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বোঝা দরকার যে সর্বহারা একনায়কত্বের অর্থ তাদের কাছে কি: পুরুষের সঙ্গে আইনের চোখে, বাস্তব ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রে, সমাজে সম্পূর্ণ সমান অধিকার বুর্জোয়া ক্ষমতার অবসান।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম – “সোভিয়েত রাশিয়াই তা দেখিয়ে দিচ্ছে।” “আমাদের শিক্ষার মধ্যে এ এক মস্ত বড় উদাহরণ হবে”

লেনিন বলে চললেন, “সোভিয়েত রাশিয়া নারীদের জন্য আমাদের দাবিগুলিকে নতুন আলোকে তুলে ধরে। সর্বহারা একনায়কত্বে সে দাবিগুলি সর্বহারা এবং বুর্জোয়াদের মধ্যে সংগ্রামের বিষয়বস্তু নয়। তারা কমিউনিস্ট সমাজের কাঠামোর অংশ এ দ্বারা অন্য দেশের নারী জাতির কাছে সর্বহারার চূড়ান্ত গুরুত্ব সূচিত হয়। এই পার্থক্যটা বিশেষ জোর দিয়ে বলা দরকার যাতে নারীরা সর্বহারা বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রামে যোগ দেয়। কমিউনিস্ট পার্টিগুলির পক্ষে এবং তাদের জয়ের জন্য তাদের নীতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ও দৃঢ় সংগঠনের ভিত্তিতে তাদের সমবেত করা একান্তই প্রয়োজন। কিন্তু আমরা যেন নিজেদের প্রতারণা না করি। আমাদের জাতীয় অংশগুলির মধ্যে এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে সঠিক ধারণার অভাব রয়েছে। যখন কমিউনিস্ট নেতৃত্বে শ্রমজীবী নারীদের গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি করবার কাজ পড়ে রয়েছে, তখন তারা আলস্যে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। তারা বুঝতে পারে না যে এই রকম একটা গণ আন্দোলন গড়ে তোলা ও তার ব্যবস্থা করা সমগ্র পার্টির কাজেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বাস্তবিকই, পার্টির সাধারণ কাজের অর্ধেক। একটি শক্তিশালী স্বচ্ছ কমিউনিস্ট নারী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও তার মূল্য সম্বন্ধে তাদের সাময়িক স্বীকৃতি কেবলমাত্র নিস্পৃহ ও মৌখিক স্বীকৃতি, এর প্রতি সদা সর্বদা তাদের দৃষ্টি ও দায়িত্ব বোধ নেই।”

৫.

আর পুরুষরা ?

নারীদের মধ্যে প্রচার আন্দোলনের কাজকে, তাদের জাগ্রত ও বিপ্লবী করে তোলার কাজকে যেন প্রাসঙ্গিক বিষয়ের মতো ধরা হয়। এটা যেন কেবলমাত্র নারী কমরেডদেরই ব্যাপার। এদিকে কাজ আরও তাড়াতাড়ি, আরও জোরের সঙ্গে এগোচ্ছে না বলে শুধুমাত্র তাদেরই ভৎসনা করা হয়। ভুল, খুবই ভুল। আসলে স্বাতন্ত্র্যবাদ। ফরাসিরা যাকে বলে উল্টোধারা-নারীবাদ। আমাদের জাতীয় অংশের ভুল দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি কি ? চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাবে যে তা নারীদের ও তাদের কাজকে ছোট করে দেখা ছাড়া আর কিছুই নয়। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ! দুর্ভাগ্যবশত আমাদের অনেক কমরেডের বিষয়েই এ কথা বললে সত্য হবে যে, একটি কমিউনিস্ট-এর গায়ে নখের আঁচড় দিয়ে দেখ, তার সঙ্কীর্ণমনা চেহারা বেরিয়ে পড়বে। অবশ্য নরম জায়গায় আঁচড়ে দেখতে হবে—নারীদের বিষয়ে তাদের মনোভাব কী। কেমন করে নারীরা ক্ষুদ্র একঘেয়ে ঘরকন্নার কাজে জরাজীর্ণ হয়ে যায়, তাদের শক্তি ও সময় বিক্ষিপ্ত ও বিনষ্ট হয়,তাদের মন সঙ্কীর্ণ ও বিস্বাদ হয়ে যায়, তাদের নিঃশ্বাস মন্থর হয়ে আসে, ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে তা দেখেও পুরুষরা নারীদের নীরব আত্মদান ভোগ করতে আসছে। এর চেয়ে সঙ্কীর্ণ মনের বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? অবশ্য আমি সেই সব বুর্জোয়া মহিলাদের কথা বলছি না যারা চাকরদের ওপর ঘরকন্নার সব দায় ঠেলে দেয়- এমনকি ছেলেপিলেদেরও দেখাশোনা করার সব দায়িত্বও। আমি যা বলছি তা বেশির ভাগ নারীদের পক্ষে খাটে। শ্রমিকদের স্ত্রীদের পক্ষে এবং যারা সারাদিন কারখানায় খাটে, তাদের পক্ষেও খাটে।”

“সুতরাং অতি অল্প লোকই এমন কি সর্বহারাদের মধ্যেও খুব কম লোকই বোঝে যে যদি তারা ‘মেয়েদের কাজে’ একটু সাহায্য করে তবে কতখানি কষ্ট কমাতে, এমন কি অনেকটা দূর করতেও পারে। কিন্তু না তা হলো পুরুষের অধিকার ও মর্যাদার প্রতিকূল। তারা তাদের শান্তি ও আরাম চায়। নারীর ঘরোয়া জীবন হলো হাজার রকমের সামান্য সামান্য বিষয় নিয়ে প্রতিদিনের আত্মত্যাগ। পুরুষের আগেকার প্রভুত্বের অধিকার এখনও গোপনে গোপনে বেঁচে আছে। তার দাসীও গোপনে প্রতিশোধ নেয়। নারীদের পশ্চাৎপদতার দরুন, পুরুষের বৈপ্লবিক আদর্শের কথা তাদের না বোঝানোর দরুন পুরুষের আনন্দ কমে যায় ও সংগ্রামের দৃঢ়তা শিথিল হয়ে আসে। তারা ক্ষুদ্র কীটের মতো অলক্ষিতে, ধীরে অথচ নিশ্চিতরূপে পচন ধরায় ও ক্রমশ ক্ষয় করে। নারী শ্রমিকদের জীবন আমি জানি কেবলমাত্র বই থেকেই নয়। নারীদের মধ্যে আমাদের কমিউনিস্টদের কাজ, আমাদের রাজনৈতিক কাজ, পুরুষদের মধ্যেও অনেক শিক্ষামূলক কাজ পর্যন্ত বিস্তৃত। পুরাতন প্রভুত্বের ধারণা শেষ পর্যন্ত তার ক্ষুদ্রতম জড় পর্যন্ত নির্মূল করতেই হবে- পার্টির মধ্যে এবং জনগণের মধ্যে থেকে। যেমন শ্রমজীবী নারীদের মধ্যে পার্টির কাজ চালিয়ে যাবার জন্য, নীতি ও কাজের দিক থেকে সুশিক্ষিত পুরুষ ও নারী কমরেডদের কর্মীদল গঠন করবার কাজটা জরুরি, এটাও ঠিক তেমনই আমাদের অন্যতম রাজনৈতিক কাজ।”

নতুন জীবন গঠনে অযুত মানুষ

এ বিষয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার অবস্থা সম্বন্ধে আমার প্রশ্নের উত্তরে লেনিন বললেন, “অবশ্য, পুরুষ ও নারীর মধ্যে পশ্চাৎপদ ধারণা দূর করতে পুরাতন অকমিউনিস্ট মানসিকতার ধ্বংস করবার চেষ্টার দিক থেকে সর্বহারা একনায়কত্বের সরকার কমিউনিস্ট পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে মিলিত হয়ে যথাসাধ্য করছে। আইনের দিক থেকে স্বভাবতই পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার রয়েছে এবং সর্বত্রই এই সমান অধিকার কার্যে পরিণত করার জন্য আন্তরিক ইচ্ছার প্রমান দেখা যায়। আমরা নারীদের সামাজিক অর্থনীতির মধ্যে আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের মধ্যে নিয়ে আসছি। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বার তাদের কাছে উন্মুক্ত- যাতে তারা তাদের জীবিকা অর্জনের যোগ্যতা, সামাজিক যোগ্যতা বৃদ্ধি করতে পারে। আমরা সাধারণ রান্নাঘর, যৌথ রন্ধনশালা ও আহার গৃহ, ধোপাখানা ও মেরামতের দোকান, শিশু বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমস্ত রকমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছি। সংক্ষেপে, আলাদা আলাদা ঘরকন্নার অর্থনৈতিক ও শিক্ষামূলক কাজকর্মগুলিকে সামাজিক দায়িত্বে পরিণত করার প্রোগ্রাম আমরা গুরুত্বের সঙ্গে কাজে পরিণত করছি। তার অর্থ দাঁড়াবে সাবেকি ঘরকন্নার একঘেয়েমি থেকে ও পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে নারীদের মুক্তিলাভ। তার দ্বারা নারীরা সম্পূর্ণরূপে তাদের নিজেদের প্রতিভা, ক্ষমতা ও আগ্রহ কাজে ব্যবহার করতে সমর্থ হবে। শিশুরাও বাড়ি অপেক্ষা অনেক ভাল অবস্থায় মানুষ হচ্ছে। আমাদের দেশের নারী শ্রমিকদের জন্য যে রক্ষণমূলক আইন আছে তা পৃথিবীর অন্য সব দেশের আইনের চেয়ে বেশি অগ্রগামী, এবং সংগঠিত শ্রমিকরা সরকারি কর্মচারীরা সেগুলি কার্যকরী করে। আমরা প্রসূতি হাসপাতাল খুলছি, মা ও শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠান খুলছি, মাতৃ শিক্ষাসদন খুলছি, শিশুপালন সম্বন্ধে বক্তৃতার ব্যবস্থা করছি, মা ও শিশুদের যত্ন কি করে নিতে হয় সে সম্বন্ধে প্রদর্শনী এবং সেই রকম অনেক কিছুর ব্যবস্থা করছি। বেকার এবং সংস্থানহীন নারীদের ভরণপোষণের জন্য আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চেষ্টা করছি।”

“আমরা এ কথা পরিষ্কার বুঝতে পারি যে শ্রমজীবী নারীদের প্রয়োজনের তুলনায় এ সব কিছুও যথেষ্ট নয়- তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার থেকে এ অনেক অনেক কম। কিন্তু তবুও জার ধনতন্ত্রের অবাধ শাসন চলছে সে সব দেশের তুলনাতেও এ অনেকখানি বেশি। সঠিক দিকে আমাদের শুভ সূচনা শুরু হয়েছে এবং আমরা আরও অনেক উন্নতি করব। বিশ্বাস কর, আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তা করবো। সোভিয়েত রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতিটি দিনই বেশি করে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে নারীদের ছাড়া আমাদের অগ্রগতি অসম্ভব।”

(সূত্র: সাপ্তাহিক সেবা, বর্ষ-৩৪।।সংখ্যা-১-৪, রোববার।। এপ্রিল-জুন ২০১৪।।)

আরো পড়ুন:  কমরেড এম. এ. মতিন ও জমিলা খাতুন স্মরণে ময়মনসিংহে আলোচনা সভা

Leave a Comment

error: Content is protected !!