দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবাদ

সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি

১৮. দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবাদ

*** একজন কমিউনিস্ট যিনি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী, একই সময়েই কি আবার দেশপ্রেমিক হতে পারেন? আমরা মনে করি, তিনি শুধু হতেই পারেন না, তাঁর হওয়া উচিত। দেশপ্রেমের নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ঐতিহাসিক অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়। জাপানী আক্রমণকারীদের ও হিটলারের ‘দেশপ্রেম আছে, আবার আমাদেরও দেশপ্রেম আছে। কমিউনিস্টদের অবশ্যই জাপানী আক্রমণকারীদের ও হিটলারের তথাকথিত দেশপ্রেমের দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করতে হবে। তাদের দেশের দ্বারা চালিত যুদ্ধে জাপান ও জার্মানির কমিউনিস্টরা হচ্ছেন পরাজয়বাদী। প্রতিটি সম্ভাব্য উপায়ে জাপানী আক্রমণকারীদের ও হিটলারের পরাজয় ঘটানোই হচ্ছে জাপানী ও জার্মান জনগণের স্বার্থের অনুকূল; এই পরাজয় যতটা সম্পূর্ণ হয়, ততই ভাল।… কারণ, জাপানী আক্রমণকারীদের ও হিটলারের দ্বারা চালিত যুদ্ধ কেবলমাত্র যে বিশ্বের জনগণের ক্ষতি করছে তা-ই নয় বরং তাদের নিজেদের দেশের জনগণেরও ক্ষতি করছে। চীনের অবস্থা কিন্তু ভিন্ন, কারণ চীন হচ্ছে আক্রান্ত দেশ। অতএব, চীনা কমিউনিস্টদের অবশ্যই আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে দেশপ্রেমকে মিলিয়ে দিতে হবে। আমরা হচ্ছি আন্তর্জাতিকতাবাদী, একই সময়ে দেশপ্রেমিকও বটে, আমাদের স্লোগান হচ্ছে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। আমাদের পক্ষে, পরাজয়বাদ হচ্ছে অপরাধ, জাপানবিরোধী যুদ্ধে বিজয় লাভের চেষ্টা করাটা হচ্ছে অপরিহার্য কর্তব্য। কারণ, কেবলমাত্র মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করেই আমরা আক্রমণকারীদের পরাজিত করতে পারি এবং জাতীয় মুক্তি অর্জন করতে পারি। আর কেবলমাত্র জাতীয় মুক্তি অর্জন করেই সর্বহারা শ্রেণী ও শ্রমজীবী জনগণের পক্ষে নিজেদের মুক্তি অর্জন সম্ভব হবে। চীনের বিজয় এবং চীনের উপর আক্রমণকারী সাম্রাজ্যবাদীদের পরাজয় অন্যান্য দেশের জনগণকে সাহায্য করবে। তাই দেশপ্রেম হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের বাস্তব প্রয়োগ। “জাতীয় যুদ্ধে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির স্থান” (অক্টোবর, ১৯৩৮)

*** একজন বিদেশী হয়েও তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে চীনা জনগণের মুক্তির কার্যকে নিজের বলে মনে করতেন, এটা কি ধরনের ভাব-মানস? এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদের ভাব-মানস, এটা হচ্ছে কমিউনিজমের ভাব-মানস, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যেক সদস্যকেই এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।… সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত, জাপান, ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানি, ইতালী ও অন্যান্য সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। শুধু এভাবেই সাম্রাজ্যবাদকে নিপাত করা যাবে, আমাদের জাতি ও জনগণ এবং বিশ্বের জাতি ও জনগণের মুক্তি অর্জন করা যাবে। এই হচ্ছে আমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদ—সেই আন্তর্জাতিকতাবাদ যা দিয়ে আমরা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও সংকীর্ণ দেশপ্রেমের বিরোধিতা করি। “নর্মান বেথুন স্মরণে” (২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৯)

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক কাজ

*** নিপীড়িত জনগণ পূর্ণ মুক্তি অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম নির্ভর করেন তাঁদের নিজেদের সংগ্রামের উপর এবং শুধু তার পরেই আন্তর্জাতিক সাহায্যের উপর। যে জনগণ নিজেদের বিপ্লবে বিজয় লাভ করেছেন, তাদেরকে এখনও যারা মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছেন এমন সব জনগণকে সাহায্য করতেই হবে। এটা হচ্ছে আমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদী দায়িত্ব। “আফ্রিকান বন্ধুদের সাক্ষাৎদানকালে প্রদত্ত ভাষণ” (৮ আগস্ট, ১৯৬৩)

*** সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রাষ্ট্র। এগুলোতে শোষক শ্রেণিকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং শ্রমজীবী জনগণ ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন। এই দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদকে এক করে নেবার নীতি পালন করা হচ্ছে। একই স্বার্থ, একই আদর্শ আমাদেরকে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। মহান অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েতের সভায় প্রদত্ত ভাষণ” (৬ নভেম্বর, ১৯৫৭)

*** সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিভিন্ন দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত, পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত, সমস্ত শান্তিকামী দেশের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত, আমেরিকার দ্বারা আক্রান্ত, নিয়ন্ত্রিত, হস্তক্ষেপাধীন ও লাঞ্ছিত সমস্ত দেশের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণনীতি ও যুদ্ধনীতির বিরোধিতা করা এবং বিশ্বশান্তি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ব্যাপকতম যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা উচিত। “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পানামার জনগণের ন্যায়সঙ্গত দেশপ্রেমমূলক সংগ্রামের সমর্থনে প্রদত্ত বিবৃতি” (১২ জানুয়ারি, ১৯৬৪)

*** বস্তু অবিরাম বিকাশ লাভ করে। ১৯১১ সালের বিপ্লব, অর্থাৎ সিনহায় বিপ্লব থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র ৪৫ বছর অতীত হয়েছে, এর মধ্যেই চীনের চেহারা একেবারেই বদলে গেছে। আরও ৪৫ বছর কেটে গেলে, অর্থাৎ ২০০১ সালে অথবা একুশ শতকের শুরুতে চীনের চেহারার আরও বেশি পরিবর্তন ঘটবে। চীন হয়ে উঠবে একটা শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিল্পপ্রধান দেশ। চীনের অবশ্যই এমনি হওয়া উচিত। কারণ, চীন হচ্ছে এমন একটা দেশ যার আয়তন ৯,৬০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার আর যার লোকসংখ্যা হচ্ছে ৬০ কোটি, মানবজাতির প্রতি চীনের অবশ্যই অপেক্ষাকৃত বিরাট অবদান থাকা উচিত। কিন্তু অতীতে দীর্ঘকাল ধরে তার এই ধরনের অবদান খুবই কম ছিল। এর জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্তু আমাদের অবশ্যই বিনয়ী হতে হবে। শুধু এখনই নয়, এমনকি ৪৫ বছর পরেও, সর্বদাই আমাদের বিনয়ী থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, চীনা লোকদের অবশ্যই দৃঢ়ভাবে, নিঃশেষে সাফ করে, সম্পূর্ণরূপে বৃহৎ রাষ্ট্রবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। “ডাক্তার সান ইয়াৎ সেনের স্মরণে” (নভেম্বর, ১৯৫৬)

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট পার্টি

*** আমাদের কোনোক্রমেই বৃহৎ রাষ্ট্রবাদের দাম্ভিক মনোভাব রাখা উচিত নয়, বিপ্লবের জয়লাভ ও দেশ গঠন কার্যে কিছু সাফল্য অর্জনের কারণে অহঙ্কার ও আত্মগর্ব করা কোনো মতেই উচিত নয়। প্রত্যেকটি দেশ, সে ছোট বা বড় যাই হোক না কেন, তার সদগুণ ও অসদগুণ আছে। “চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত উদ্বোধনী ভাষণ” (১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬)

Leave a Comment

error: Content is protected !!