কল্পলৌকিক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র – ১৮৯২ ইংরেজি সংস্করণের জন্য বিশেষ ভূমিকা

(সাধারণ ভূমিকা এবং বস্তুবাদের ইতিহাস)

বর্তমানের এই ছোট্ট পুস্তিকাটি মূলত একটি বৃহত্তম রচনার অংশ। ১৮৭৫ সালের কাছাকাছি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের Privatdocent ডা. ও. দ্যুরিং সহসা ও খানিকটা সরবে সমাজতন্ত্রে তাঁর দীক্ষাগ্রহণের কথা ঘোষণা করেন ও জার্মান জনসাধারণের কাছে একটা বিস্তারিত সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বই শুধু নয়, সমাজ পুনর্গঠনের একটা সুসম্পূর্ণ ব্যবহারিক ছকও হাজির করেন। বলাই বাহুল্য উনি তাঁর পূর্ববর্তীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন; সর্বোপরি মার্কসকে পাকড়াও করে তাঁর পুরো ঝাল ঝাড়েন।

ঘটনাটা ঘটে প্রায় সেই সময় যখন জার্মানির সোস্যালিস্ট পার্টির দুটি অংশ আইজেনাখীয় ও লাসালীয়রা সবে মিলিত হয়েছে এবং তাতে করে প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করেছে তাই নয়, অধিকন্তু তাঁরা সমগ্র শক্তিকে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে নিয়োগের ক্ষমতাও অর্জন করেছে। জার্মানির সোস্যালিস্ট পার্টি দ্রুত একটা শক্তি হয়ে উঠছিল। কিন্তু শক্তি হয়ে ওঠার প্রথম শর্তই ছিল, এই নবার্জিত ঐক্যকে বিপন্ন করা চলবে না। ডা. দ্যুরিং কিন্তু প্রকাশ্যেই তাঁর চারিপাশেই একটা জোট পাকাতে শুরু করেন, একটি ভবিষ্যৎ পৃথক পার্টির তা বীজ। কিন্তু প্রয়োজন হয় আহ্বান গ্রহণ করে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ চালানোর, চাই বা না চাই।

কাজটা অতি দুষ্কর না হলেও স্পষ্টতই এক দীর্ঘ ঝামেলার ব্যাপার। একথা সুবিদিত যে আমরা জার্মানরা হলাম সাঙ্ঘাতিক রকমের গুরুভার এর ভক্ত- যাতে র্যা ডিক্যাল প্রগাঢ়ত্ব অথবা প্রগাঢ় র্যা ডিক্যালত্ব যা খুশি বলুন। আমাদের কেউ যখন তার বিবেচনানুসারে যা নতুন মনে হচ্ছে এমন একটি মতবাদ বিবৃত করতে চান, যখন সর্বাগ্রে সেটিকে একটি সর্বাঙ্গীন মতধারায় পরিপ্রসারিত করতে হবে তাঁকে। প্রমাণ দিতে হবে যে, ন্যায়শাস্ত্রের প্রথম সূত্রটি থেকে বিশ্বের মৌলিক নিয়মগুলি সবই যে অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান, তার পেছনে শুধু শেষ পর্যন্ত এই নবাবিষ্কৃত মুকুটমণি তত্ত্বটিকে পৌঁছানো ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। এবং এদিক থেকে ডা. দ্যুরিং একান্তই জাতীয় মানোত্তীর্ণ। একছিটে কম নয়, একেবারে সুসম্পূর্ণ একটা দর্শন ব্যবস্থা- মনোজাগতিক, নৈতিক, প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক; সুসম্পূর্ণ একটা অর্থশাস্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ব্যবস্থা; এবং পরিশেষে অর্থশাস্ত্রের বিচারমূলক ইতিহাস- অক্টাভো সাইজের তিনটি মোটা মোটা খন্ড, আকার ও প্রকার উভয়তঃ গুরুভার, সাধারণভাবে পূর্বতন সমস্ত দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদের বিরুদ্ধে বিশেষত মার্কসের বিরুদ্ধে তিনি অক্ষৌহিনী যুক্তি, মোট কথা একটা পরিপূর্ণ ‘বিজ্ঞান বিপ্লবের’ প্রচেষ্টা, এরই মোকাবেলা করতে হত। আলোচনা করতে হতো সম্ভাব্য সবকিছু প্রসঙ্গ: স্থান কালের ধারণা থেকে Bimetallism পর্যন্ত; বস্তু ও গতির চিরন্তনতা এবং নৈতিক ভাবনার মরণশীল প্রকৃতি; ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন থেকে ভবিষ্যৎ সমাজে তরুণদের শিক্ষা- সব। যাই হোক আমরা প্রতিবাদীর সর্বাঙ্গীনতার ফলে এই অতি বিভিন্ন সব প্রসঙ্গে মার্কস ও আমার যা মতামত সেগুলিকে দ্যুরিং-এর বিপরীতে, এবং এ যাবৎ যা করা হয়েছে তার চেয়ে আরও সুসম্বন্ধ আকারে বিকশিত করার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। অন্যথায় অকৃতার্থ এ কর্তব্যগ্রহণে সেই আমার প্রধান কারণ।

আমার জবাব প্রথমে প্রকাশিত হয় সোস্যালিস্ট পার্টির প্রধান মুখপত্র লাইপজিগ Vorwarts পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রবন্ধ হিসাবে এবং পরে ‘Herrn Eugen Duhrings Umwalzung der Wissenschaft’ (শ্রী ও দ্যুরিং-এর বিজ্ঞান ও বিপ্লব) নামক পুস্তকাকারে, দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় জুরিখে ১৮৮৬ সালে।

সুহৃদ্বয় এবং অধুনা ফরাসি প্রতিনিধি সভায় লিল্ প্রতিনিধি পল লাফার্গের অনুরোধে এ বইয়ের তিনটি পরিচ্ছেদ একটি পুস্তকাকারে সাজিয়ে দেই। তিনি তা অনুবাদ করে ১৮৮০ সালে (ইউটোপীয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) নামে প্রকাশ করেন। এই ফরাসি পাঠ থেকে একটি পোলীয় এবং একটি স্পেনীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮৮৩ সালে আমাদের জার্মান বন্ধুরা পুস্তিকাটিকে মূল ভাষায় প্রকাশ করেন। জার্মান পাঠের ওপর ভিত্তি করে ইটালীয়, রুশ, দিনেমার, ওলন্দাজ ও রুমানীয় অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান ইংরেজি সংস্করণের সাথে সাথে পুস্তকটি তাহলে দশটি ভাষায় প্রকাশিত হল। আর কোন সমাজতান্ত্রিক পুস্তক এর বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে বলে আমার জানা নেই, এমনকি আমাদের ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ইশতেহার বা মার্কসের পুঁজি বইটিও না। জার্মানিতে এই বইয়ের চারটি সংস্করণ হয়েছে, সর্বসমেত ২০,০০০ কপি।

মার্ক (জার্মানির প্রাচীন গ্রামগোষ্ঠী) এই সংযোজনী লেখা হয়েছিল জার্মানিতে ভূমি সম্পত্তির ইতিহাস ও বিকাশের কিছুটা প্রাথমিক জ্ঞান জার্মান সোস্যালিস্ট পার্টির মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে। এ কাজ তখন বিশেষ জরুরি ঠেকেছিল কারণ সে পার্টির দ্বারা শহুরে মজুরদের অঙ্গীভবন বেশ গুরুত্বপূর্ণ দিকে, পালা এসেছে ক্ষেতমজুর ও চাষিদের। অনুবাদে এ সংযোজনী রেখে দেওয়া হয়েছে, কেননা সমস্ত টিউটনিক জাতির পক্ষে যা একই সেই ভূমি-ব্যবস্থার আদি ধরণটা এবং তার অবক্ষয়ের ইতিহাস জার্মানির চেয়েও ইংল্যান্ডে কম সুবিদিত নয়। লেখাটি মূলে যা ছিল তাই রেখে দিয়েছি, ম্যাক্সিম কভালেভস্কি সম্প্রতি যে প্রকল্প দিয়েছেন তার কথা উল্লেখ করা হয়নি; এই প্রকল্প অনুসারে মার্ক-এর মধ্যে আবাদি ও চারণ-ভূমির বাঁটোয়ারা হয়ে যাবার আগে বেশ কয়েক পুরুষ এগুলির চাষ হত এজমালি হিসাবে এক একটি বৃহৎ পারিবারিক গোষ্ঠী দ্বারা (অদ্যাবধি বর্তমান দক্ষিণ স্লোভোনীয় জাদ্রুগা তার দৃষ্টান্ত স্থানীয়), বাঁটোয়ারা হয় পরে, যখন গোষ্ঠী বৃদ্ধি পায়, ফলে এজমালি হিসাবে পরিচালনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কভালেভস্কির বক্তব্য হয়ত ঠিকই, কিন্তু বিষয়টা এখনও বিচারসাপেক্ষ।

এ বইয়ে ব্যবহৃত অর্থনৈতিক পরিভাষার যেগুলি নতুন সেগুলি মার্কসের পুঁজি বইটির ইংরেজি সংস্করণ অনুযায়ী। ‘পণ্যোৎপাদন’ আমরা সেই পর্যায়কে বলছি যেখানে সামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে কেবলমাত্র উৎপাদকদের ভোগের জন্য শুধু নয়, বিনিময়ের জন্যেও; অর্থাৎ ব্যবহার মূল্য হিসাবে নয়, পণ্য হিসাবে। বিনিময়ের জন্য উৎপাদনের প্রথম সূত্রপাত থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত এই পর্যায়টা প্রসারিত; তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে কেবলমাত্র পুঁজিবাদী উৎপাদনেই অর্থাৎ সেই অবস্থায় যখন উৎপাদনের মালিক পুঁজিপতি মজুরি দিয়ে নিয়োগ করে শ্রমিকদের, শ্রমশক্তি ছাড়া যারা উৎপাদনের সর্ববিধ উপায় থেকে বঞ্চিত তাদের, এবং সামগ্রীর বিক্রয়মূল্য থেকে তার লগ্নির ওপর যেটা উদ্ধৃত্ত হয় সেটি পকেটস্থ করে। মধ্যযুগ থেকে শিল্পোৎপাদনের ইতিহাসকে আমরা তিনটি যুগে ভাগ করি: ১) হস্তশিল্প, ক্ষুদে ক্ষুদে ওস্তাদ কারুশিল্পী ও তদধীনস্থ কয়েকজন কর্মী ও সাগরেদ, প্রত্যেক শ্রমিকই এখানে পুরো সামগ্রীটাই তৈরি করে; ২) কারখানা (manufacture) যেখানে অধিকতর সংখ্যক শ্রমিক একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে একত্রে হয়ে সমগ্র সামগ্রীটা উৎপাদন করে শ্রম বিভাগ নীতিতে, প্রতেকটি শ্রমিক করে শুধু একটা আংশিক কাজ যাতে সামগ্রীটা সম্পূর্ণ হয় শুধু পর পর প্রত্যেকের হাত ফেরতা হয়ে যাবার পর; ৩) আধুনিক যন্ত্রশিল্প, যেখানে মাল তৈরি হয় শক্তি-চালিত যন্ত্র দ্বারা আর শ্রমিকের কাজ শুধু যন্ত্রের ক্রিয়ার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ।

আমি বেশ জানি যে এই বইয়ের বিষয়বস্তুতে ব্রিটিশ পাঠক সাধারণের একটা বড় অংশের আপত্তি হবে। কিন্তু আমরা কন্টিনেন্টবাসীরা যদি ব্রিটিশ ‘শালীনতা’ রূপ কুসংস্কারের বিন্দুমাত্র ধারও ধারতাম, তাহলে আমাদের অবস্থা যা আছে তা আরও শোচনীয় হত। আমরা যাকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলি এ বইয়ে তাকে সমর্থন করা হয়েছে আর বস্তুবাদ শব্দটাই ব্রিটিশ পাঠকদের বিপুল অধিকাংশের কানে বড়ো বেঁধে। অজ্ঞেয়বাদ তবু সহনীয়, কিন্তু বস্তুবাদ একেবারেই অমার্জনীয়। অথচ সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে আধুনিক সমস্ত বস্তুবাদেরই আদিভূমি হল ইংল্যান্ড।

‘বস্তুবাদ গ্রেট ব্রিটেনের আত্মজ সন্তান। ব্রিটিশ স্কলাস্টিক দুনস স্কোট তো আগেই প্রশ্ন তুলেছিলেন,“বস্তুর পক্ষে ভাবনা কি অসম্ভব?”

এই অঘটন-ঘটনের জন্যে তিনি আশ্রয় নেন ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তায় অর্থাৎ তিনি ধর্মতত্ত্বকে লাগান বস্তুবাদের প্রচারে। তদুপরি তিনি ছিলেন নামবাদী। নামবাদ বস্তুবাদের প্রাথমিক এই রূপ প্রধানত দেখা যায় ইংরেজ স্কলাস্টিকদের মধ্যে।

ইংরেজি বস্তুবাদের আসল প্রবর্তক হলেন বেকন। তাঁর কাছে প্রাকৃতিক দর্শনই হল একমাত্র সত্য দর্শন এবং ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করা পদার্থবিদ্যা হল প্রাকৃতিক দর্শনের প্রধান ভাগ। আনাক্সেইগরস এবং তাঁর homoiomeriae, ডিমোক্রিটস এবং তাঁর পরমাণুর কথা তিনি প্রায়ই উদ্ধৃত করতেন তাঁর প্রামাণ্য হিসাবে। তাঁর বক্তব্য, ইন্দ্রিয় অভ্রান্ত ও সর্বজ্ঞানের মূলাধার। সমস্ত বিজ্ঞানের ভিত্তি অভিজ্ঞতা, ইন্দ্রিয়-দত্ত তথ্যকে যুক্তিসম্মত পদ্ধতিতে বিচার করাই হল বিজ্ঞানের কাজ। অনুমান, বিশ্লেষণ, তুলনা, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা হল এই ধরনের যুক্তিসম্মত প্রণালীর প্রধান অঙ্গ। বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণের মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হল গতি, যান্ত্রিক ও গাণিতিক গতিই শুধু নয়, প্রধানত একটা উদ্বেগ (impulse), একটা সজীব প্রেরণা, একটা টান অথবা ইয়াকব ব্যেমের কথা অনুসারে- বস্তুর একটা বেদনা (qual)।

বস্তুবাদের প্রথম স্রষ্টা বেকন, একটা সর্বাঙ্গীণ বিকাশের বীজ তখনও তাঁর বস্তুবাদে অন্তর্নিহিত। একদিকে ইন্দ্রিয়গত কাব্যময় ঝলকে পরিবৃত বস্তু যেন মানবের সমগ্র সত্তাকে আকৃষ্ট করছিল মোহনী হাসি হেসে। অন্যদিকে অ্যাফরিজম-প্রভাবে সূত্রবদ্ধ মতবাদ ধর্মতত্ত্বের অসঙ্গতিতে পল্লবিত হয়ে উঠেছিল।

পরবর্তী বিকাশে বস্তুবাদ হয়ে উঠে একপেশে। বেকনীয় বস্তুবাদকে যিনি গুছিয়ে তোলেন তিনি হব্স। ইন্দ্রিয়ভিত্তিক জ্ঞান তার কাব্য মায়া হারিয়ে গাণিতিকের বিমূর্ত অভিজ্ঞতার করায়ত্ত হল; বিজ্ঞানের রাণী বলে ঘোষণা করা হল জ্যামিতিকে। বস্তুবাদ আশ্রয় নিল মানবদ্বেষে। প্রতিদ্বন্দ্বী মানবদ্বেষী দেহহীন আধ্যাত্মবাদকে যদি তারই স্বভূমিতে পরাস্থ করতে হয়, তাহলে বস্তুবাদকেও তার দেহ দমন করে যোগী হতে হয়। এইভাবে ইন্দ্রিয়গত সত্তা থেকে তার পরিণতি হল বুদ্ধিক সত্তায়; কিন্তু এভাবেও, বুদ্ধির যা বৈশিষ্ট্য সেই অনুসারে, ফলাফলের হিসাব না করে সবকটি সঙ্গতিকেই তা বিকশিত করে তোলে।বেকন অনুবর্তক হিসাবে হব্স-এর বক্তব্য এই : সমস্ত মানবিক জ্ঞান যদি পাই ইন্দ্রিয় থেকে তাহলে আমাদের ধারণা ও প্রত্যয়গুলি তাদের ইন্দ্রিয়গত রূপ থেকে, বাস্তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ছায়ারূপ ছাড়া আর কিছু নয়। দর্শন শুধু কেবল তাদের নামকরণ করতে পারে। একই নাম প্রযুক্ত হতে পারে একাধিক ছায়ারূপে। নামেরও নাম থাকতে পারে। স্ববিরোধ দেখা দেবে যদি আমরা একদিকে বলি যে, সমস্ত ধারণার উদ্ভব ইন্দ্রিয়ের জগত থেকে এবং অন্যদিকে বলি, শব্দটা শব্দেরও অতিরিক্ত কিছু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরিজ্ঞাত যে সত্তাগুলি সকলেই এক একটি একক, সেগুলি ছাড়াও একক নয় সাধারণ চরিত্রের সত্তা বর্তমান। দেহহীন বস্তুর মতই দেহহীন সত্তাও আজগুবি। দেহ, বস্তু, সত্তা হল একই বাস্তবের বিভিন্ন নাম। চিন্তক বস্তু থেকে চিন্তাকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। জগতে যে পরিবর্তন চলেছে তা সবের অধস্তন হলো এই বস্তু। অসীম কথাটা অর্থহীন, যদি না বলা হয় যে, অবিরাম যোগ দিয়ে যাবার ক্ষমতা আমাদের মনের আছে। কেবল বস্তুময় জগৎ আমাদের বোধগম্য বলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানা আমাদের সম্ভব নয়। একমাত্র আমাদের নিজস্ব অস্তিত্বই নিশ্চিত। মানবিক প্রতিটি আবেগই হল এক একটি যান্ত্রিক সঞ্চালন যার একটা শুরু ও একটা শেষ আছে। যাকে আমরা কল্যাণ বলি তা হল চিত্তাবেগের (Impulse) লক্ষ্য। প্রকৃতির মত মানুষও একই নিয়মের অধীন। ক্ষমতা ও স্বাধীনতা একই কথা।

হবস বেকনকে গুছিয়ে তুলেছেন, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের জগত থেকে সমস্ত মানবিক জ্ঞানের উদ্ভব, বেকনের এই মূলনীতির কোন প্রমাণ দাখিল করেননি। সে প্রমাণ দেন লক তাঁর মানবিক বোধ বিষয় প্রবন্ধে।

‘বেকনীয় বস্তুবাদ আস্তিক্যবাদী কুসংস্কার ছিন্ন করেছিলেন হব্স। লকের ইন্দ্রিয়বাদের মধ্যে যে ধর্মতত্ত্বের অবশেষ তখনও থেকে গিয়েছিল তাকে একই ভাবে ছিন্ন করেন কলিন্স, ডডওয়েল, কাউয়ার্ড, হার্টিলি, প্রিস্টলি। ব্যবহারিক বস্তুবাদীদের পক্ষে ধর্ম থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সহজ পদ্ধতি হল শেষ পর্যন্ত Deism।

আধুনিক বস্তুবাদের ব্রিটিশ উৎস বিষয়ে এই হল মার্কসের লেখা। ইংরেজদের পূর্ব পুরুষদের মার্কস যে প্রশংসা করেছিলেন সেটা যদি আজকাল তাদের তেমন রুচিকর না লাগে তবে আক্ষেপেরই কথা। কিন্তু অস্বীকার করার জো নেই যে, বেকন, হব্স, লকই হলেন ফরাসি বস্তুবাদীদের সেই চমৎকার ধারাটির জনক। যার দরুন ফরাসিদের ওপর ইংরেজ ও জার্মানরা স্থল ও নৌযুদ্ধে যত জয়লাভই করুক না কেন, অষ্টাদশ শতাব্দী পরিণত হয় প্রধানত এক ফরাসি শতাব্দীতে এবং তা হয় পরিণামের সেই ফরাসি বিপ্লবেরও আগে যার ফলশ্রুতি ইংল্যান্ড ও জার্মানির আমরা, বাইরের লোকেরা, আজও পর্যন্ত আত্মস্থ করতে চেষ্টিত।

এ কথা অনস্বীকার্য। এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিদগ্ধ যে বিদেশিরা ইংল্যান্ডে এসে বসবাস শুরু করেছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই যে জিনিসটা চোখে পড়েছে সেটাকে তাঁরা ভদ্র ইংরেজ মধ্য শ্রেণির ধর্মীয় গোঁড়ামি ও নির্বুদ্ধিতা গণ্য করতে বাধ্য। আমরা সেই সময়ে সকলেই ছিলাম নয় অন্ততপক্ষে অতি র্যা ডিক্যাল স্বাধীন-চিন্তক, এবং ইংল্যান্ডের প্রায় সমস্ত শিক্ষিত লোকেই যে যত রকম অসম্ভাব্য অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করবেন, বাকল্যান্ড ও মানটেলের মতো ভূতাত্ত্বিকরাও বিজ্ঞানের তথ্যকে বিকৃত করে বিশ্বসৃষ্টির পুরান কাহিনীর সঙ্গে খুব বেশি সংঘর্ষের মধ্যে যেতে চাইবেন না, তা আমাদের কাছে অকল্পনীয় লেগেছিল। অন্যপক্ষে ধর্মীয় প্রসঙ্গে যাঁরা স্বীয় বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগে সাহসী এমন লোকের সন্ধান পেতে হলে যেতে হয় অবিদ্যানদের মধ্যে, তখন যাদের বলা হত ‘অধৌত জনগণ’ সেই তাদের মধ্যে, বিশেষ করে ওয়েনপন্থী সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে। কিন্তু অতঃপর ইংল্যান্ড ‘সুসভ্য’ হয়েছে। ১৮৫১ সালের প্রদর্শনী থেকে আত্মপর ইংরেজি বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে খাদ্যে, আচার-আচরণে, ভাবনায়; এতটা পরিমাণে হয়েছে যে ইচ্ছে হয় বলি, কন্টিনেন্টের অন্যান্য অভ্যাস এখানে যেমন চালু হয়েছে তেমনি কিছু ইংরেজি আচার-ব্যবহার কন্টিনেন্টেও সমান চালু হোক। যাই হোক, স্যালাড-তেলের প্রবর্তন ও প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে (১৮৫১ সালের আগে তা কেবল অভিজাতদের কাছেই সুবিদিত ছিল) ধর্ম বিষয়ে কন্টিনেন্টসুলভ সন্দেহবাদের একটা মারাত্মক প্রসার ঘটেছে; এবং তা এতদূর গড়িয়েছে যে, চার্চ অব ইংল্যান্ডের মত ঠিক অতটা ‘এই-তো-চাই’ বলে এখনও গণ্য না হলেও অজ্ঞেয়বাদ শালীনতার দিক থেকে প্রায় ব্যাপটিস্ট সম্প্রদায়ের সমতুল্য এবং নিশ্চিতই ‘স্যালভেশন আর্মি’র চেয়ে উচ্চে। না ভেবে পারি না যে, এই অবস্থায় অধর্মের এ প্রসারে যাঁরা আন্তরিকভাবেই ক্ষুব্ধ ও তার নিন্দা করেন, তাঁরা এই জেনে সান্ত¡না পেতে পারেন যে, এই সব নয়া হালফিল ধারণাগুলি বিদেশি বস্তু নয়, দৈনন্দিন ব্যবহারের বহু সামগ্রীর মতো Made in Germany বস্তু নয়, বরং নিঃসন্দেহে তা সাবেকি বিলাতি এবং উত্তরপুরুষেরা এখন যতটা সাহস করে না দু’শো বছর আগে তার চেয়েও অনেক দূর এগিয়েছিলেন তাঁদের ব্রিটিশ আদিপুরুষেরা।

আরো পড়ুন:  কল্পলোক হচ্ছে নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা যেখানে হিংসা, নিপীড়ন অথবা সম্পত্তি থাকবে না

বস্তুতপক্ষে, ‘সসঙ্কোচ’ বস্তুবাদ ছাড়া অজ্ঞেয়বাদ আর কী? প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞেয়বাদীদের ধারণা বস্তুবাদী। সমগ্র প্রকৃতি জগত নিয়ম-চালিত, বাইরে থেকে তার ক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের কথা একেবারে ওঠে না। কিন্তু অজ্ঞেয়বাদী যোগ করে জ্ঞাত বিশ্বের অতিরিক্ত কোনো পরম সত্তার অস্তিত্ব নিরূপণের অথবা খন্ডনের কোন উপায় আমাদের নেই। এ কথা হয়তো বা খাটতো সেকালে যখন সেই মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানীর Mecanique celeste স্রষ্টার উল্লেখ নেই কেন, নেপোলিয়নের এ প্রশ্নে লাপ্লাস সগর্বে জবাব দেন, “Je navais pas besoin de cette hypotheses”। কিন্তু আজকাল বিশ্বের বিবর্তনী ধারণার স্রষ্টা বা নিয়ন্ত্রতার কোন স্থান নেই; সমগ্র বর্তমান বিশ্ব থেকে পরিবিচ্ছিন্ন এক পরম সত্তার কথা বলা স্ববিরোধসূচক, এবং আমাদের মনে হয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি একটা অকারণ অপমান।

অথচ, আমাদের অজ্ঞেয়বাদী মানেন যে, জ্ঞানের ভিত্তি হল ইন্দ্রিয়দত্ত সংবাদ। কিন্তু অজ্ঞেয়বাদী যোগ করেন ইন্দ্রিয়ের মারফত যে বস্তুর বোধ হচ্ছে তার সঠিক প্রতিচ্ছবিই যে ইন্দ্রিয় আমাদের দিয়েছে তা জানলাম কী করে? অতঃপর অজ্ঞেয়বাদী আমাদের জানিয়ে দেন, বস্তু বা তার গুণের কথা তিনি যখন বলেন তখন তিনি আসলে সেই সব বস্তু বা গুণের কথা বলছেন না, নিশ্চিত করে তার কিছু জানা সম্ভব নয়, স্বীয় ইন্দ্রিয়ের ওপর তারা যে ছাপ ফেলেছে শুধু তারই কথা বলছেন। এ ধরনের কথাকে কেবল যুক্তি বিস্তার করে হারান বোধ হয় সত্যিই শক্ত। কিন্তু যুক্তি বিস্তারের আগে হল ক্রিয়া। Im An fang war die That। এবং মানবিক প্রতিভা কর্তৃক এ সমস্যা আবিষ্কারের আগেই মানবিক কর্ম দ্বারা তার সমাধান হয়ে গেছে। পুডিংয়ের প্রমাণ তার ভক্ষণে। এই সব বস্তুর অনুভূত গুণাগুণ অনুসারে বস্তুটা আমাদের কাজে লাগালেই আমাদের অনুভূতিগুলির সঠিকতা বা বেঠিকতার একটা যাচাই হয়ে যায়। আমাদের এই অনুভূতিগুলি যদি ভুল হত, তাহলে সে বস্তুর ব্যবহার যোগ্যতা সম্পর্কে আমাদের হিসাবও ভুল হতে বাধ্য এবং সব চেষ্টা বিফল হত। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সফল করতে যদি আমরা সক্ষম হই, যদি দেখা যায় যে, বস্তুটা সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা তার সঙ্গে সে বস্তু মিলছে, বস্তুটার কাছ থেকে যে আশা করছি তা হাসিল হচ্ছে, তাহলে পরিষ্কার প্রমাণ হয়ে যায় যে, সে বস্তু এবং তার গুণাগুণ সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি ততটা পর্যন্ত মিলে যাচ্ছে আমাদের বহিঃস্থিত বাস্তবের সঙ্গে। যদি বা বিফলতার সম্মুখীন হই, তাহলে সে বিফলতার কারণ বার করতে দেরি হয় না; দেখা যায় যে অনুভূতির ভিত্তিতে আমরা কাজ করছি সেটা হয় অসম্পূর্ণ ও ভাসাভাসা, নয় অন্যান্য অনুভূতির ফলাফলের সঙ্গে তাকে এমনভাবে যুক্ত করা হয়েছে যা অসঙ্গত- একে আমরা বলি যুক্তির ত্রুটি। ইন্দ্রিয়গুলিকে ঠিকমতো পরিশীলিত ও ব্যবহৃত করতে এবং সঠিকভাবে গৃহীত ও সঠিকভাবে ব্যবহৃত অনুভূতির দ্বারা নির্দিষ্ট আওতার মধ্যে কর্মকে সীমাবদ্ধ রাখতে যতক্ষণ আমরা সচেষ্ট, ততক্ষণ পর্যন্ত দেখা যাবে যে, আমাদের কর্মের ফলাফল থেকে অনুভূত বস্তুর কর্তা-নিরপেক্ষ (Objective) প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অনুভূতির মিল প্রমাণিত হচ্ছে। এযাবৎ একটি দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়নি যাতে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে বৈজ্ঞানিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলি দ্বারা আমাদের মনে বহির্জগত সম্পর্কে যে ধারণা উপার্জিত হচ্ছে তা তৎপ্রকৃতিগতভাবেই বাস্তব থেকে বিভিন্ন কিংবা বহির্জগত ও সে বিষয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে একটা অনিবার্য গরমিল বর্তমান।

কিন্তু তখন আসেন নয়া-কান্টপন্থী অজ্ঞেয়বাদীরা এবং বলেন: হ্যাঁ একটা বস্তুর গুণাগুণ বোধ আমাদের সঠিক হতে পারে, কিন্তু কোন ইন্দ্রিয়গত ও মনোগত প্রকরণেই প্রকৃত-বস্তুটাকে (think-in-itself) আমরা ধরতে পারি না। এই প্রকৃত-বস্তু আমাদের জ্ঞান সীমার বাইরে। এবং উত্তরে হেগেল বহু পূর্বেই বলেছিলেন: একটা বস্তুর সমস্ত গুণই যদি জানা যায় তাহলে বস্তুটাকেও জানা হল; বাকি যা রইল সেটা এই সত্য ছাড়া কিছুই নয় যে, বস্তুটা আমাদের বাদ দিয়েই বর্তমান; এবং ইন্দ্রিয় মারফত এই সত্যটি শেখা হলেই প্রকৃত-বস্তুটির, কান্টের বিখ্যাত অজ্ঞেয় Ding an sich-এর চূড়ান্ত অবশেষটিও জানা হয়ে যায়। এর সঙ্গে যোগ দেওয়া যেতে পারে যে, কান্টের কালে প্রাকৃতিক বস্তু বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ছিল এতই টুকরো টুকরো যে, প্রত্যেকটা বস্তুর যেটুকু আমরা জানতাম তার পরেও একটা রহস্যময় ‘প্রকৃত-বস্তুর’ সন্দেহ তাঁর স্বাভাবিক। কিন্তু একের পর এক এইসব অধরা বস্তুগুলোকে ধরা হয়েছে, বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং আরও বড় কথা, পুনঃসৃষ্টি করা হয়েছে বিজ্ঞানের অতিকায় প্রগতির কল্যাণে; আর যেটাকে আমরা সৃষ্টি করতে পারি সেটাকে নিশ্চয় অজ্ঞেয় বলে গণ্য করা যায় না। এ শতকের প্রথমার্ধে জৈব-বস্তুগুলো ছিল রসায়নের কাছে এক ধরনের রহস্য-বস্তু; এখন জৈব ক্রিয়া ব্যতিরেকেই এক ধরনের রাসায়নিক মৌলিক উপাদান থেকে একের পর এক তাদের বানাতে আমরা শিখেছি। আধুনিক রসায়নবিদরা ঘোষণা করেন, যে-বস্তুই হোক না কেন তার রাসায়নিক সংবিন্যাস জানতে পারলেই মৌলিক উপাদান থেকে তাকে তৈরি করা যায়। উচ্চ পর্যায়ের জৈব বস্তুর, এ্যালবুমিন-বস্তুর সংবিন্যাস এখনও আমরা জানতে পারিনি; কিন্তু কয়েক শতাব্দী পরেও তার জ্ঞান আমাদের অর্জিত হবে না, এবং তার সাহায্যে কৃত্তিম এ্যালবুমিন তৈরি করতে পারবো না, এর কোন যুক্তি নেই। যদি তা পারি তবে সেই সঙ্গে জৈব জীবনও আমরা সৃষ্টি করতে পারবো, কেননা এ্যালবুমিন-বস্তুর অস্তিত্বের স্বাভাবিক ধরণ হল জীবন তার নিম্নতম থেকে উচ্চতর রূপ পর্যন্ত।এই সব আনুষ্ঠানিক মানসিক আপত্তি পেশ করার পরেই আমাদের অজ্ঞেয়বাদীর কথা ও কাজ একেবারে এক ঝানু বস্তুবাদীর মতো, যা তাঁর আসল স্বরূপ। অজ্ঞেয়বাদী হয়তো বলবেন আমরা যতটা জেনেছি তাতে পদার্থ ও গতিকে, আমরা বর্তমানে তার যা নাম, তেজকে (Energy) সৃষ্টিও করা যায় না, ধ্বংসও করা যায় না, কিন্তু কোন না কোন সময়ে তার সৃষ্টি হয়নি এমন প্রমাণ আমাদের নেই। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তার এই স্বীকৃতি তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে গেলেই তিনি মামলা খারিজ করে দেবেন। In abstract o (বিমূর্ত ক্ষেত্রে) আধ্যাত্মবাদ মানলেও In concerto (প্রত্যÿ ক্ষেত্রে) তা তিনি মোটেও মানতে রাজি নন। বলবেন যতদূর আমরা জানি ও জানতে পারি তাতে বিশ্বের কোন স্রষ্টা বা নিয়ন্তা নেই; আমাদের সঙ্গে যতটা সম্পর্ক তাতে পদার্থ বা তেজ সৃষ্টিও করা যায় না, ধ্বংসও করা যায় না, আমাদের ক্ষেত্রে ভাবনা হল তেজের একটা ধরন, মস্তিষ্কের একটা ক্রিয়া; যা কিছু আমরা জানি তা এই যে ক্ষেত্রে তিনি বৈজ্ঞানিক মানুষ, যে ক্ষেত্রে তিনি কোন কিছু জানেন, সে ক্ষেত্রে বস্তুবাদী; কিন্তু তাঁর বিজ্ঞানের বাইরে যে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না, সে অজ্ঞতাকে তিনি গ্রিক অনুবাদ করে বলেন agnosticism বা অজ্ঞেয়বাদ।

যাই হোক একটা জিনিস মনে হয় পরিষ্কার: আমি যদি অজ্ঞেয়বাদী হতাম তাহলেও এই ছোট বইখানিতে ইতিহাসের যে ধারণা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেটাকে ঐতিহাসিক অজ্ঞেয়বাদ বলে বর্ণনা করা যে যেত না তা স্পষ্ট। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা হাসাহাসি করতেন, অজ্ঞেয়বাদীরা সরোষে প্রশ্ন করতেন, আমি কি তাদের নিয়ে তামাশা শুরু করেছি? তাই আশা করি ব্রিটিশ শালীনতাবোধও অতিমাত্রায় স্তম্ভিত হবে না যদি ইংরেজি তথা অপরাপর বহু ভাষায় ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ কথাটি আমি ব্যবহার করি ইতিহাস ধারার এমন একটা ধারণা বোঝাবার জন্যে, যাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার মূল কারণ ও মহতী চালিকা শক্তির সন্ধান করা হয় সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্যে, উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতির পরিবর্তনের মধ্যে, বিভিন্ন শ্রেণিতে সমাজের তজ্জনিত বিভাগের মধ্যে এবং সেই সব শ্রেণির পারস্পরিক সংগ্রামের মধ্যে।

এ প্রশ্রয় বোধ হয় আরও পাওয়া সম্ভব যদি দেখান যায় যে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ব্রিটিশ শালীনতার পক্ষেও সুবিধাজনক হতে পারে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে ইংল্যান্ডে বসবাস করতে গিয়ে বিদগ্ধ বিদেশিদের যেটা চোখে পড়ত সেটাকে তাঁরা ইংরেজ শালীন মধ্য শ্রেণির ধর্মীয় গোঁড়ামি আর নির্বুদ্ধিতা বলে গণ্য করতে বাধ্য হতেন। আমি এবার প্রমাণ করতে চাই যে, বিদগ্ধ বিদেশিদের কাছে সে সময় শালীন ইংরেজ মধ্য শ্রেণি ঠিক যতটা নির্বোধ বলে মনে হত ততটা নির্বোধ তারা ছিল না। তাদের ধর্মীয় প্রবণতার ব্যাখ্যা আছে।
ইউরোপ যখন মধ্যযুগ থেকে উত্থিত হয় তখন শহরের উদীয়মান মধ্য শ্রেণি ছিল তার বিপ্লবী অংশ। মধ্যযুগীয় সামন্ত সংগঠনের মধ্যে তারা একটা সর্বজনস্বীকৃত প্রতিষ্ঠা অর্জন করে নিয়েছিল, কিন্তু সে প্রতিষ্ঠাও তার বর্তমান ক্ষমতার তুলনায় অতি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে; মধ্য শ্রেণির bourgeoisie-র বিকাশের সামন্ত ব্যবস্থার সংরক্ষণ খাপ খাচ্ছিল না; সুতরাং সামন্ত ব্যবস্থার পতন হতে হল।

কিন্তু সামন্ততন্ত্রের বিরাট আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ। অভ্যন্তরীণ যুদ্ধাদি সত্ত্বেও তা সমগ্র সামন্ততান্ত্রিক প্রতীচ্য ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করে এক বিরাট রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এবং তা ছিল যেমন স্খিস্মাটিক গ্রিক দেশগুলির বিরুদ্ধে তেমনি মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে। সামন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে চার্চ স্বর্গীয় আশীর্বাণীর জ্যোতিঃভূষিত করে। সামন্ত কায়দায় এ চার্চ নিজ যাজকতন্ত্রের সংগঠন করে এবং শেষত, এ চার্চ নিজেই ছিল এর প্রবলতম সামন্ত অধিপতি, ক্যাথলিক জগতের পুরো এক-তৃতীয়াংশ জমি ছিল এর দখলে। দেশে দেশে এবং সবিস্তারে অপবিত্র সামন্ততন্ত্রকে সফলভাবে আক্রমণ করার আগে তার এই পবিত্র কেন্দ্রীয় সংগঠনটিকে বিনষ্ট করার দরকার ছিল।

তাছাড়া মধ্য শ্রেণির অভ্যুদয়ের সমান্তরালে শুরু হয় বিজ্ঞানের বিপুল পুনরুজ্জীবন; জ্যোতির্বিজ্ঞান, বলবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, শরীরস্থান, শরীরবৃত্তের চর্চা ফের শুরু হয়। শিল্পোৎপাদনের বিকাশে বুর্জোয়াদের দরকার ছিল একটা বিজ্ঞানের যাতে প্রাকৃতিক বস্তু দৈহিক গুণাগুণ এবং প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ক্রিয়া-পদ্ধতি নিরূপিত করা যায়। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞান হয়ে ছিল গির্জার বিনীত সেবাদাসী, খৃষ্ট বিশ্বাসের আরোপিত সীমা তাকে লঙ্ঘন করতে দেওয়া হত না, সেই কারণে তা আদৌ বিজ্ঞানই ছিল না। বিজ্ঞান বিদ্রোহ করল গির্জার বিরুদ্ধে; বিজ্ঞান ছাড়া বুর্জোয়ার চলছিল না, তাই সে বিদ্রোহে যোগ দিতে হল তাকে।

প্রতিষ্ঠিত ধর্মের সঙ্গে উদীয়মান মধ্য শ্রেণি যে কারণে সংঘাতে আসতে বাধ্য তার শুধু দুটি ক্ষেত্রের উল্লেখ করলেও এটা দেখানোর পক্ষে তা যথেষ্ট যে, প্রথম, রোমান চার্চের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ স্বার্থ ছিল বুর্জোয়া শ্রেণির; এবং দ্বিতীয়ত, যে সময় সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিটি সংগ্রামকেই নিতে হত ধর্মীয় ছদ্মবেশ, পরিচালিত করতে হত সর্বাগ্রে চার্চের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শহরের ব্যবসায়ীরা কলরবের সূত্রপাত করলেও প্রবল সাড়া পাওয়া নিশ্চিত ছিল এবং পাওয়া যায় ব্যাপক গ্রামবাসীদের মধ্যে, চাষিদের মধ্যে- আধ্যাত্মিক ও ইহজাগতিক সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে যাদের সর্বত্র সংগ্রাম করতে হত নিতান্তই প্রাণধারণের জন্যেই।
সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে বুর্জোয়ার দীর্ঘ সংগ্রামের পরিণতি হয় তিনটি চূড়ান্ত মহাযুদ্ধে।

প্রথমটিকে বলা হয় জার্মানির প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন। চার্চের বিরুদ্ধে লুথার যে রণধ্বনি তোলেন তাতে সাড়া দেয় দুটি রাজনৈতিক চরিত্রের অভ্যুত্থান: প্রথমে ফ্রানৎস ফন জিকিঙ্গেনের নেতৃত্বে নিম্ন অভিজাতদের অভ্যুত্থান (১৫২৩), পরে- ১৫২৫ সালে- মহান কৃষক যুদ্ধ। দুটিই পরাজিত হয় প্রধানত যে দলগুলির সবচেয়ে বেশি স্বার্থ, শহরের সেই বার্গারদের অনিশ্চিতমতির ফলে, এ অনিশ্চিতমতির কারণ নিয়ে এখানে আলোচনা করা চলে না। সেই সময় থেকে স্থানীয় রাজন্যদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শক্তির লড়াইয়েতে সে সংগ্রামের অধঃপতন ঘটে এবং তার পরিণতি হয় ইউরোপের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় জাতিগুলির ভেতর থেকে দু’শো বছরের জন্য জার্মানিকে মুছে দেওয়া। লুথারীয় রিফর্মেশন থেকে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধর্মমত, স্বৈরশক্তি রাজতন্ত্রেরই উপযোগী একটা ধর্ম। উত্তর-পূর্ব জার্মানির কৃষকরা লুথারবাদ গ্রহণ করতে না পারলেও স্বাধীন লোক থেকে তারা পরিণত হয় ভূমিদাসে।
কিন্তু লুথার যেখানে পরাজিত হলেন যেখানে জয়ী হলেন কালভাঁ। কালভাঁ-এর ধর্মমত ছিল তাঁর কালের সবচেয়ে সাহসী বুর্জোয়াদের উপযোগী। প্রতিযোগিতার বাণিজ্যিক জগতে সাফল্য অসাফল্য মানুষের কর্ম বা বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে তার সাধ্যাতীত পরিস্থিতির ওপর, এই ঘটনাটার এক ধর্মীয় প্রকাশ হল তাঁর ঐশ্বরিক নির্বন্ধ (Predestination) মতবাদ। অভিপ্রায় সেটা আমার নয়, কর্ম সেটা আমার নয়, উচ্চতর অজানা অর্থনৈতিক শক্তির কৃপায়; এটা সবিশেষ সত্য ছিল অর্থনৈতিক বিপ্লবের সেই এক যুগের যখন সমস্ত পুরানো বাণিজ্য পথ ও কেন্দ্রের জায়গায় আসছে নতুন পথ, নতুন কেন্দ্র, যখন ভারত ও আমেরিকা উন্মুক্ত হয়েছে দুনিয়ার কাছে এবং তখন বিশ্বাসের পবিত্রতম অর্থনৈতিক মানদন্ড যথা সোনা রূপার দামও টলতে শুরু করেছে, ভেঙ্গে পড়ছে। কালভাঁ-এর গির্জা-গঠনতন্ত্র পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক। এবং ঈশ্বরের রাজত্ব যেখানে প্রজাতান্ত্রিক করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ইহজাগতিক রাজ্য কি থাকতে পারে রাজরাজড়া, বিশপ আর সামন্তপ্রভুদের অধীনে? জার্মান লুথারবাদ সেই ক্ষেত্রে রাজন্যদের হাতের পাঁচ হয়ে রইল সে ক্ষেত্রে কালভাঁবাদ হল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করলো একটি প্রজাতন্ত্রের এবং ইংল্যান্ডে সর্বোপরি স্কটল্যান্ডে সৃষ্টি করল সক্রিয় প্রজাতান্ত্রিক পার্টির।

আরো পড়ুন:  রবার্ট ওয়েন কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র, সমবায় আন্দোলনের আদি প্রবক্তা

কালভাঁবাদের মধ্যে দ্বিতীয় মহান বুর্জোয়া অভ্যুত্থান পেল তার তৈরি মতবাদ। এ অভ্যুত্থান ঘটে ইংল্যান্ডে। শহরের মধ্য শ্রেণি (বুর্জোয়া) তাকে শুরু করে আর গ্রামাঞ্চলের চাষিরা (Yeomanry) তা লড়ে শেষ করে। মজার ব্যাপার এই যে মহান তিনটি বুর্জোয়া অভ্যুত্থানেই লড়াইয়ের সৈন্যবাহিনী যোগায় কৃষক সম্প্রদায়, অথচ জয়লাভ হবার পরেই সে জয়লাভের অর্থনৈতিক ফলাফল অনিশ্চিত যারা ধ্বংস হতে বাধ্য তারা হল এই কৃষকেরাই। ক্রমওয়েলের একশ বছর পরে ইংল্যান্ডের কৃষককূল প্রায় অদৃশ্য হয়। মোটের ওপর কৃষককূল ও শহরের প্লেবিয়ান অংশ না থাকলে একা বুর্জোয়ারা কখনই চরম পরিণতি পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেত না এবং ফাঁসির মঞ্চে কখনও এনে দাঁড় করাত না প্রথম চার্লসকে। বুর্জোয়ার যে সমস্ত প্রতিষ্ঠা তখন অর্জনযোগ্য হয়ে উঠেছে সেইগুলো লাভ করতে হলেও বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় বহুদূর পর্যন্ত- ঠিক ১৭৯৩ সালে ফ্রান্স এবং ১৮৪৮ সালে জার্মানির মতো। বস্তুত এ যেন বুর্জোয়া সমাজের একটা ক্রমবিকাশের নিয়ম বলেই গণ্য হয়।বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের এই আধিক্যের পর অবশ্যই আসে অনিবার্য প্রতিক্রিয়া এবং যে পর্যন্ত সে প্রতিক্রিয়ার থাকা সম্ভব ছিল তাও এবার তার ছাড়িয়ে যাবার পালা। একাদিক্রমে এদিক ওদিক দোলার পর অবশেষে পাওয়া যায় নতুন ভারকেন্দ্র এবং তা থেকে হয় একটা নতুন সূচনা। ইংল্যান্ডে ইতিহাসের যে সমারোহী যুগটা ভদ্রসম্প্রদায়ের কাছে ‘বৃহৎ বিদ্রোহ’ নামে পারিচিত সেই যুগ ও তার পরবর্তী সংগ্রামগুলির অবসান হয় অপেক্ষাকৃত তুচ্ছ এক ঘটনায়, উদারনৈতিক ঐতিহাসিকেরা যার নাম নাম দিয়েছেন ‘গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লব’।

নতুন সূচনাটি হল উদীয়মান মধ্য শ্রেণি ও ভূতপূর্ব সামস্ত জমিদারদের মধ্যে আপোস। এখনকার মতো এ জমিদারদের অভিজাত বলা হলেও বহু আগে থেকেই তাঁরা সেই পথ নিয়েছিল যাতে তারা হয়ে ওঠে বহু পরবর্তী যুগের ফ্রান্সের লুই ফিলিপের মতো ‘রাজ্যের প্রথম বুর্জোয়া’। ইংল্যান্ডের পক্ষে সৌভাগ্যবসত গোলাপের যুদ্ধের সময় প্রাচীন সামন্ত ব্যারনরা পরস্পরকে নিধন করেছিল। তাদের উত্তরাধিকারীরা অধিকাংশই প্রাচীন বংশোদ্ভূত হলেও প্রত্যক্ষ বংশধারা থেকে এতই দূরে যে, তারা একটা নতুন সম্প্রদায় হয়ে ওঠে, তাদের যা অভ্যাস ও মনোবৃত্তি সেটা সামন্ততান্ত্রিক নয়, হয়ে ওঠে বহু পরিমাণে বুর্জোয়া। টাকার দাম তারা বেশ বুঝতো এবং অবিলম্বেই ছোট ছোট ক্ষুদে চাষিকে উচ্ছেদ করে সে জায়গায় ভেড়া রেখে তারা খাজনা বেশি তুলতে শুরু করে। অষ্টম হেনরি গির্জার জমি অপব্যয় করে পাইকারি হারে নতুন নতুন বুর্জোয়া জমিদার সৃষ্টি করেন; অসংখ্য মহালের বাজেয়াপ্তি ও একেবারে ভুঁইফোড় বা আধা ভুঁইফোড়দের নিকট তা ফের বিলি, গোটা সপ্তদশ শতাব্দী ধরে যা চলে একই ফল হয়। সুতরাং সপ্তম হেনরির সময় থেকে ইংরেজ অভিজাতরা শিল্প উৎপাদনের বিকাশে বাধা দেবার বদলে উল্টে তা থেকেই মুনাফা তোলার চেষ্টা করেছে; এবং চিরকালই বড়ো বড়ো জমিদারদের এমন একটা অংশ ছিল যারা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে মহাজনী ও শিল্পজীবী বুর্জোয়ার সঙ্গে সহযোগিতায় ইচ্ছুক। ১৬৮৯ সালের আপোস তাই সহজেই সাধিত হয়। ‘অর্থ ও পদমর্যাদার’ রাজনৈতিক বখরা রইল বড়ো বড়ো জমিদার বংশের জন্য এই শর্তে যে, মহাজনী কারখানাজীবী ও বাণিজ্যিক মধ্য শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থ যথেষ্ট দেখা হবে। এবং সে সময় দেশের সাধারণ নীতি নির্দেশ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এই সব অর্থনৈতিক স্বার্থ। খুঁটিনাটি ব্যাপারে ঝগড়া হয়তো হত, কিন্তু মোটের ওপর অভিজাত গোষ্ঠীতন্ত্র খুব ভালোই জানতো যে, তার নিজস্ব অর্থনৈতিক উন্নতি অনিবার্যরূপে ছড়িয়ে আছে শিল্পজীবী ও বাণিজ্যিক মধ্য শ্রেণির উন্নতির সঙ্গে।

সেই সময় থেকে ইংল্যান্ডের শাসক শ্রেণির একটা কিন্তু তথাপি স্বীকৃত অংশ হল বুর্জোয়ারা। অন্যান্য শাসক শ্রেণির সঙ্গে এদেরও সমান স্বার্থ ছিল দেশের বিপুল মেহনতিজনকে বশে রাখা। বণিক বা কারখানা-মালিক (manufacturer) নিজেই হল তার কেরানি, তার মজুর, তার বাড়ির চাকরবাকরদের কাছে প্রভু, বা কিছু আগে পর্যন্তও যা বলা হত ‘স্বতঃই ঊর্ধ্বতন’। তাদের কাছ থেকে যথাসাধ্য বেশি ও যথাসাধ্য ভাল কাজ আদায় করাই তার স্বার্থ; সে উদ্দেশ্যে ঠিকমতো বাধ্যতার শিক্ষায় তাদের শিক্ষিত করতে হবে। নিজেও সে ধর্মভীরু; তার ধর্মের পতাকা নিয়েই সে রাজা ও ভূস্বামীদের সঙ্গে লড়েছে; স্বতঃই-অধস্তনদের মনের ওপর প্রভাব ফেলে, ঈশ্বরস্থাপিত প্রভুটির আদেশাধীন করে তোলার দিক থেকে এ ধর্ম যে সুবিধা দান করেছে তা আবিষ্কার করতে তার দেরি হয়নি। সংক্ষেপে ‘ছোট লোকদের’ দেশের বিপুল উৎপাদক জনগণকে দাবিয়ে রাখার কাজে ইংরেজ বুর্জোয়াকে এবার একটা অংশ নিতে হচ্ছে এবং সে উদ্দেশ্য প্রযুক্ত অন্যতম একটা উপায় হল ধর্মের প্রভাব।
আর একটা ঘটনাও ছিল যাতে বুর্জোয়াদের ধর্মীয় প্রবণতা বেড়েছে। সেটা হল ইংল্যান্ডে বস্তুবাদের উত্থান। এই নতুন মতবাদ মধ্য শ্রেণির ধর্মানুভূতিতেই শুধু ঘা দেয়নি; বুর্জোয়া সমেত বিপুল অশিক্ষিত জনগণের যাতে বেশ চলে যায় সেই ধর্মের বিপরীতে এ মতবাদ নিজেকে জাহির করলো কেবল দর্শন বলে যা বিশ্বের পন্ডিত বিদগ্ধ জনদেরই যোগ্য। হব্স-এর হাতে বস্তুবাদ মঞ্চে আসে রাজকীয় অধিকার ও ক্ষমতার সমর্থক হিসাবে। স্বৈরশক্তি রাজতন্ত্রকে তা আহ্বান করে সেই puer robustus sed malitiosus অর্থাৎ জনগণকে দমন করতে। একইভাবে হব্স-এর পরবর্তীদের- বলিংব্রক, শ্যাফ্টস্বেরি ইত্যাদির কাছে বস্তুবাদের নতুন deistic ধারাটা থেকে যায় একটা অভিজাত, অধিকার-ভেদী (esoteric) মতবাদ হিসাবে এবং সেহেতু মধ্য শ্রেণির কাছে তা ঘৃণ্য হয়, তার ধর্মীয় অস্বীকৃতি ও বুর্জোয়া বিরোধী রাজনৈতিক যোগাযোগ উভয় কারণেই। এইভাবে, অভিজাতদের deism ও বস্তুবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মধ্য শ্রেণির প্রধান শক্তি যোগাতে থাকলো সেই সব প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়েরাই যারা রণপতাকা ও সংগ্রামী বাহিনী যুগিয়েছিল স্টুয়ার্টদের বিরুদ্ধে, ‘মহান উদারনৈতিক পার্টির মেরুদন্ড’ আজও পর্যন্ত তারাই।

ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড থেকে বস্তুবাদ চলে যায় ফ্রান্সে, সেখানে আর একটি বস্তুবাদী দার্শনিক ধারার, কার্থেজিয়ানবাদের একটি শাখার সংস্পর্শে সে আসে এবং তার সঙ্গে মিশে যায়। ফ্রান্সেও প্রথম দিকে বস্তুবাদ থাকে একটি অভিজাত মতবাদ হিসাবে। কিন্তু অচিরেই তার বিপ্লবী চরিত্র আত্মপ্রকাশ করল। ফরাসি বস্তুবাদীরা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই সমালোচনা সীমাবদ্ধ রাখল না; তৎকালীন বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা কিছু সামনে পড়ল সবেতেই প্রসারিত করলো তাদের সমালোচনা; তাদের মতবাদের সর্বজনীন প্রয়োগযোগ্যতার দাবি প্রমাণের জন্য সংক্ষিপ্ততম পন্থা অবলম্বন করে সাহসের সঙ্গে তা জ্ঞানের সবকটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলো এক অতিকায় রচনা, encyclopedie-য়, যা থেকে তাদের নাম। এইভাবে খোলাখুলি বস্তুবাদ বা deism, এই দুই ধারার কোন না কোন একটা রূপে বস্তুবাদ হয়ে দাঁড়াল ফ্রান্সের সমগ্র সংস্কৃতিবান যুব সমাজের মতবাদ; এতটা পরিমাণে হল যে, মহান বিপ্লব যখন শুরু হয় তখন ইংরেজ রাজতন্ত্রীদের সৃষ্ট মতবাদটা থেকেই এল ফরাসি প্রজাতন্ত্রী ও সন্ত্রাসবাদীদের তাত্ত্বিক ধ্বজা, এবং ‘মানবিক অধিকার ঘোষণাপত্রের বয়ান। মহান ফরাসি বিপ্লব হল বুর্জোয়াদের তৃতীয় অভ্যুত্থান, কিন্তু এই প্রথম বিপ্লব যা ধর্মের আলখাল্লাটা একবারে ছুড়ে ফেলে এবং লড়াই চালায় অনাবরণ রাজনৈতিক ধারায়। এদিক থেকে এটা প্রথম যে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের একপক্ষের, অর্থাৎ অভিজাতদের বিনাশ এবং অন্য পক্ষের, বুর্জোয়ার পরিপূর্ণ জয়লাভ না হওয়া পর্যন্ত সত্যি করেই সে লড়াই চালিয়ে যাওয়া হয়। ইংল্যান্ডে প্রাকবিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর প্রতিষ্ঠানাদির ধারাবাহিকতা এবং জমিদার ও পুঁজিপতিদের মধ্যে আপোসের প্রকাশ হয় আদালতী নজিরের ধারাবাহিকতায় এবং আইনের সামন্ততান্ত্রিক রূপগুলির পবিত্র সংরক্ষণে। ফ্রান্সে অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে একটা পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটায় বিপ্লব; সামন্ততন্ত্রের শেষ জেরটুকুও তা সাফ করে code civil-এর মাধ্যমে আধুনিক পুঁজিবাদী পরিস্থিতির উপযোগী করে চমৎকার খাপ খাইয়ে নেয় প্রাচীন রোমক আইনকে- মার্কস যাকে বলেছিলেন পণ্যোৎপাদন, সেই অর্থনৈতিক পর্যায়ের অনুসারী আইনি সম্পর্কের একটা প্রায় নিখুঁত প্রকাশ ছিল তাতে, -এমন চমৎকার খাপ খাইয়ে নেয় যে, এই ফরাসি বিপ্লবী বিধিসংহিতাটি আজও পর্যন্ত অন্য সব দেশের সম্পত্তি আইন সংস্কারের আদর্শস্বরূপ, ইংল্যান্ডও বাদ নয়। অবশ্য, ইংরেজি আইন যদিও পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রকাশ করেই চলেছে সেই এক বর্বর সামন্ততান্ত্রিক ভাষায় যার সঙ্গে প্রকাশিত বস্তুর ততটাই সাদৃশ্য যতটা সাদৃশ্য ইংরেজি বানানের সঙ্গে ইংরেজি উচ্চারণের-vous ecrivez Londres et vous prononcez constantinople বলেছিলেন জনৈক ফরাসি-তবুও এ কথা ভোলা ঠিক নয় যে, সেই একই ইংরেজি আইনই একমাত্র আইন যা প্রাচীন জার্মান ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্থানীয় স্বশাসন এবং আদালত ছাড়া অন্য সমস্ত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তির সেরা অংশটিকে যুগে যুগে রক্ষা করে এসেছে এবং প্রেরণ করেছে আমেরিকা ও উপনিবেশে- স্বৈরশক্তি রাজতন্ত্রের যুগে কন্টিনেন্ট থেকে এ জিনিসটা লোপ পায় এবং এখনও পর্যন্ত কোথাও তার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা হয়নি।আমাদের ব্রিটিশ বুর্জোয়ার কথায় ফেরা যাক। ফরাসি বিপ্লবের ফলে তার একটা চমৎকার সুযোগ হল কন্টিনেন্টের রাজতন্ত্রগুলির সাহায্যে ফরাসি নৌবাণিজ্য ধ্বংস, ফরাসি উপনিবেশ অধিকার এবং জলপথে ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার শেষ দাবিটাকেও চূর্ণ করার। ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বুর্জোয়া যে লড়েছিল তার একটা কারণ এই। আর একটা কারণ, এ বিপ্লবের ধরণ-ধারণটা তার অভিরুচিকে বড়ো বেশি ছাড়িয়ে যায়- জঘন্য ‘সন্ত্রাস’ শুধু নয়, বুর্জোয়া শাসনকে চরমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটাই। যে অভিজাতরা ব্রিটিশ বুর্জোয়াকে আদব-কায়দা শিখিয়ে তুলেছে (ঠিক নিজেরই মতো), ফ্যাশন উদ্ভাবন করে দিয়েছে তার জন্য, যারা অফিসার জুগিয়েছে সৈন্য বাহিনীতে যা শৃঙ্খলা রক্ষা করেছে স্বদেশে, এবং নৌ-বাহিনীতে, যা জয় করে দিয়েছে ঔপনিবেশিক সম্পত্তি এবং বিদেশের নতুন নতুন বাজার- তাদের বাদ দিয়ে ব্রিটিশ বুর্জোয়ার চলে কী করে? বুর্জোয়াদের একটা প্রগতিশীলতা অবশ্য ছিল, আপসের ফলে এ সংখ্যালঘুর স্বার্থ তত বেশি দেখা হচ্ছিল না। অপেক্ষাকৃত কম সম্পন্ন মধ্য শ্রেণি দিয়ে প্রধানত তৈরি এই অংশটার সহানুভূতি ছিল বিপ্লবের প্রতি, কিন্তু পার্লামেন্টে তার ক্ষমতা ছিল না।

এভাবে বস্তুবাদ যতই হয়ে ওঠে ফরাসি বিপ্লবের মতবাদ ততই ধর্মভীরু ইংরেজ বুর্জোয়া আরও বেশি আঁকড়ে ধরে ধর্ম। জনগণের ধর্মচেতনা লোপ পেলে তার ফল কী দাঁড়ায় তা কী প্যারিস সন্ত্রাসের কালে প্রমাণিত হয়নি? বস্তুবাদ যতই ফ্রান্স থেকে আশপাশের দেশে ছড়িয়ে শক্তি সঞ্চয় করছিল অনুরূপ মতবাদ থেকে, বিশেষ করে জার্মান দর্শন থেকে, সাধারণভাবে স্বাধীন চিন্তা ও বস্তুবাদ যতই কন্টিনেন্টে প্রকৃতপক্ষে বিদগ্ধ ব্যক্তির অনিবার্য গুণস্বরূপ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, ততই গোঁ ধরে ইংরেজ মধ্য শ্রেণি আঁকড়ে রইল তার বহুবিধ ধর্ম বিশ্বাসকে। এ সব ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে পারস্পরিক তফাৎ যতই থাকুক তাদের সবকটিই হল পরিষ্কার রকমের ধর্মীয়, খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস।

বিপ্লব যখন ফ্রান্সে বুর্জোয়া রাজনৈতিক বিজয় নিশ্চিত করছিল, সেই সময়ে ইংল্যান্ডে ওয়াট, আর্করাইট, কার্টরাইট প্রভৃতিরা সূচিত করে এক শিল্প বিপ্লবের, অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্র তাতে পুরোপুরি সরে যায়। ভূমিজীবী অভিজাতদের চেয়ে বুর্জোয়ার সম্পদ বেড়ে উঠতে লাগল অতি দ্রুত গতিতে। খাস বুর্জোয়ার মধ্যেই মহাজনী অভিজাত, ব্যাঙ্কার প্রভৃতিদের পিছনে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে এল কারখানা-মালিকরা। ১৬৮১ সালের আপোস এযাবৎ ক্রমশ বুর্জোয়ার অনুকূলে পরিবর্তিত হয়ে এলেও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর পারস্পরিক অবস্থানের সঙ্গে তা আর খাপ খাচ্ছিল না। পক্ষগুলির চরিত্রেও বদল হয়েছে; ১৮৩০ সালের বুর্জোয়ারা আগের শতকের বুর্জোয়াদের চেয়ে ভয়ানক পৃথক। অভিজাতদের হাতে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে গিয়েছিল এবং নতুন শিল্পজীবী বুর্জোয়ারা দাবি-দাওয়া প্রতিরোধে যা ব্যবহৃত হচ্ছিল তা নতুন অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিহীন হয়ে দাঁড়াল। অভিজাতদের সঙ্গে একটা নতুন লড়াইয়ের প্রয়োজন পড়ল; তার পরিণতি হতে পারতো কেবলমাত্র নতুন অর্থনৈতিক শক্তির জয়লাভে। প্রথমে ১৮৩০ সালের ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে, সমস্ত প্রতিরোধ সত্ত্বেও সংস্কার আইন (Reform Act) পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এতে পার্লামেন্টে বুর্জোয়ারা পেল একটা শক্তিশালী ও সর্বজনস্বীকৃত প্রতিষ্ঠা। তারপর শস্য আইন বরবাদ, এতে ভূমিহীন অভিজাতদের ওপর বুর্জোয়ার বিশেষ করে তার সবচেয়ে সক্রিয় অংশ- কারখানা মালিকদের প্রাধান্য চিরকালের মত নির্দিষ্ট হয়ে গেল। বুর্জোয়ার এই সব চেয়ে বড় জয়; একান্ত নিজের স্বার্থে অর্জিত বিজয় হিসাবে এই আবার কিন্তু তার শেষ বিজয়। পরে যা কিছু সে জিতেছে তা ভাগ করে নিতে হয়েছে নতুন সামাজিক শক্তির সঙ্গে, এ শক্তি ছিল প্রথমে তার সহায় কিন্তু অচিরেই হয়ে দাঁড়াল তার প্রতিদ্বন্দ্বী।

শিল্প-বিপ্লবে বৃহৎ কারখানা মালিক পুঁজিপতিদের একটা শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল তাদের চেয়ে বহু বেশি সংখ্যক কলজীবী শ্রমিকদের একটা শ্রেণি। যে অনুপাতে শিল্প বিপ্লব উৎপাদনের একটা শাখার পর আর একটা শাখা অধিকার করতে থাকে সে অনুপাতে এ শ্রেণি ক্রমশ সংখ্যায় বেড়ে ওঠে এবং সেই অনুপাতেই হয়ে ওঠে শক্তিশালী। ১৮২৪ সালেই এ শক্তির প্রমাণ সে দেয়- শ্রমিকদের সমিতি গঠনের নিষেধ-আইন নাকচ করতে অনিচ্ছুক পার্লামেন্টকে বাধ্য করে। সংস্কার আন্দোলনের সময়ে শ্রমিকেরা ছিল সংস্কারের দলের (Reform party) র্যা ডিক্যাল অংশ; ১৮৩২ সালের আইনে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করায় তারা জনগণের চার্টার বা সনদে নিজেদের দাবি-দাওয়া নির্দিষ্ট করে শস্য আইন বিরোধী বৃহৎ বুর্জোয়া পার্টির বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করে এক স্বাধীন চার্টিস্ট, আধুনিককালে এই প্রথম মজুর পার্টি।

আরো পড়ুন:  সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ ব্যবস্থার বা সমাজের পার্থক্যরেখাগুলো কোথায় ও কীভাবে?

তারপর শুরু হয় ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কন্টিনেন্টের বিপ্লবগুলি। এতে শ্রমিকজন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা নেয় এবং অন্তত প্যারিসে তারা যেসব দাবি-দাওয়া উপস্থিত করে পুঁজিবাদী সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে তা নিশ্চিতই অননুমোদনীয়। তারপর সাধারণ প্রতিক্রিয়া। প্রথমে ১৮৪৮ সালের ১০ এপ্রিল চার্টিস্টদের পরাজয়, তারপর সেই বছরের জুনে প্যারিস শ্রমিকদের অভ্যুত্থান দমন, তারপর ইতালি, হাঙ্গেরি, দক্ষিণ জার্মানিতে ১৮৪৯ সালের বিপর্যয়, পরিশেষে ১৮৫১ সালের ২ ডিসেম্বর প্যারিসের ওপর লুই বোনাপার্টের জয়। অন্তত, কিছু কালের জন্য শ্রমিক দাবি-দাওয়ার জুজুটাকে দমন করা গেল, কিন্তু কী মূল্য দিয়ে! সাধারণ লোককে ধর্মভীরু করে রাখার প্রয়োজনীয়তা যদি ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা আগেই বুঝে থাকে তবে এত সব অভিজ্ঞতার পর তারা সে প্রয়োজনীয়তা আরও কত বেশিই না টের পাচ্ছে! কন্টিনেন্টি ভায়াদের বিদ্রূপের পরোয়া না করে তারা নিম্ন শ্রেণির মধ্যে বাইবেলের প্রচারের জন্যে হাজার হাজার টাকা খরচ করে চলেছে; নিজেদের স্বদেশি ধর্মযন্ত্রে তুষ্ট না হয়ে তারা আবেদন জানিয়েছে ধর্ম ব্যবসার বৃহত্তম সংগঠক জোনাথন ভাইদের কাছে এবং আমেরিকা থেকে আমদানি করছে রিভাইভ্যালিজন, মুডি স্যাঙ্কি প্রভৃতিদের; এবং পরিশেষে ‘স্যালভেশন আর্মির’ বিপজ্জনক সাহায্যও গ্রহণ করেছে- এটা আদি খৃষ্ট ধর্মের প্রচার ফিরিয়ে আনছে, সেরা অংশ হিসাবে আবেদন করে গরিবদের কাছে, পুঁজিবাদের সঙ্গে লড়ে ধর্মের মধ্যে দিয়ে এবং এইভাবে আদি খৃষ্টীয় শ্রেণি বৈরিতার একটা বীজ লালন করে তুলছে, যে সম্পন্ন লোকরা আজ এর জন্যে নগদ টাকা ধার দিচ্ছে তাদের কাছে যা হয়তো একদিন মুশকিল বাধাবে।
মনে হয় এ যেন ঐতিহাসিক বিকাশের একটা নিয়ম যে, মধ্যযুগে সামন্ত অভিজাতরা যে-ভাবে একান্তরূপে নিজেদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রেখেছিল, কোন ইউরোপীয় দেশেই বুর্জোয়ারা সেভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা রাখতে পারবে না- অন্তত বেশ কিছু দিনের জন্যে। এমনকি সামন্ততন্ত্র যেখানে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়েছে সেই ফ্রান্সেও বুর্জোয়ারা সমগ্রভাবে সরকারের পুরো দখল পেয়েছে কেবল অতি স্বল্প কতকগুলি সময়ের জন্য। ১৮৩০-১৮৪৮ সালে ল্ইু ফিলিপ-এর রাজত্বকালে বুর্জোয়াদের একটি ক্ষুদ্র অংশই রাজ্য চালায়; যোগ্যতার কড়া শর্তের ফলে তাদের বড় অংশটাই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের আমলে, ১৮৪৮-১৮৫১ সালের মধ্যে সমগ্র বুর্জোয়াই শাসন চালায়, কিন্তু কেবল তিন বছরের জন্য; তাদের অক্ষমতায় এলো দ্বিতীয় সাম্রাজ্য। মাত্র এখন তৃতীয় প্রজাতন্ত্রেই বুর্জোয়ারা সরকারের কর্ণধার হয়ে আছে কুড়ি বছরেরও বেশি কাল, এবং ইতিমধ্যেই তাদের অবক্ষয়ের শুভলক্ষণ ফুটে। বুর্জোয়াদের একটি স্থায়ী শাসন সম্ভব হয়েছে কেবল আমেরিকার মত দেশে, যেখানে সামন্ততন্ত্র অজানা এবং সমাজ প্রথম থেকেই শুরু হয় বুর্জোয়া ভিত্তিতে। এবং এমনকি ফ্রান্স ও আমেরিকাতেও বুর্জোয়াদের উত্তরাধিকারী শ্রমিক জনগণ ইতিমধ্যেই দ্বারে করাঘাত শুরু করেছে।ইংল্যান্ডে বুর্জোয়াদের কখনোই একক অধিকার ছিল না। ১৮৩২ সালের বিজয়েও ভূমিজীবী অভিজাতদের হাতে প্রধান প্রধান সরকারি পদের প্রায় পূর্ণ দখল ছিল। ধনী মধ্য শ্রেণি যেরূপ বিনয়ে এটা মেনে নেয় তা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল ততদিন পর্যন্ত যতদিন না উদারনীতিক বৃহৎ কলওয়ালা মিঃ ডবলিউ এ. ফস্টার প্রকাশ্য ভাষণে ব্রাডফোর্ডের যুব সম্প্রদায়কে জানান, দুনিয়ায় চলতে গেলে ফরাসি শিখতে হবে এবং নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ক্যাবিনেটে মন্ত্রী হিসাবে তাঁকে যখন এমন একটা মহলে চলাফেরা করতে হত সেখানে ফরাসি ভাষা অন্তত ইংরেজি ভাষার মতোই জরুরি, তখন তাকে কী আহাম্মকই না লাগত। আসলে তখনকার ইংরেজ মধ্য শ্রেণি ছিল সাধারণত একেবারে অশিক্ষিত ভুঁইফোঁড়, অভিজাতদের তারা উচ্চতর সরকারি সেই সব পদ না দিয়ে পারত না যেখানে ব্যবসায়ী চতুরতায় পোক্ত একটা নিতান্ত গন্ডি সঙ্কীর্ণতা ও গন্ডি অহমিকা ছাড়াও অন্য যোগ্যতার প্রয়োজন ছিল। এমনকি তখনও মধ্য শ্রেণির শিক্ষা বিষয়ে সংবাদপত্রের অনবসান বিতর্ক থেকে দেখা যায়, ইংরেজ মধ্য শ্রেণি তখনও নিজেকে সেরা শিক্ষার যোগ্য বলে মনে করছে না, কিছু কম-সমের দিকেই তার চোখ। সুতরাং শস্য আইন বাতিল করার পরেও এ যেন স্বাভাবিক যে, কবডেন, ব্রাইট, ফস্টার প্রভৃতি যে লোকেরা জিতল তারা দেশের সরকারি শাসনের অংশ থেকে বঞ্চিত রইল পরবর্তী কুড়ি বছর পর্যন্ত যতদিন না নতুন একটা সংস্কার আইনে ক্যাবিনেটের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাদের জন্য। ইংরেজ বুর্জোয়ারা আজও পর্যন্ত তাদের সামাজিক হীনতাবোধে এত বেশি আচ্ছন্ন যে, সমস্ত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তারা যোগ্যরূপে জাতির প্রতিনিধিত্বের জন্য স্বীয় খরচায় এবং জাতির খরচায় একদল শোভাবর্ধক নিষ্কর্মার প্রতিপালন করে চলেছে; এবং নিজেদের দ্বারাই তৈরি করা এই অধিকারী ও সুবিধাভোগী মহলে নিজেদের কেউ যখন প্রবেশাধিকারের যোগ্য বিবেচিত হয় তখন ভয়ানক সম্মানিত বোধ করে তারা।
সুতরাং শিল্পজীবী ও বাণিজ্যিক মধ্য শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে ভূমিজীবী অভিজাতদের সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করতে না করতে মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল আর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী- শ্রমিক শ্রেণির। চার্টিস্ট আন্দোলন ও কন্টিনেন্টের বিপ্লবগুলির পরেকার প্রতিক্রিয়া তথা ১৮৪৮-১৮৬৬ সালের ব্রিটিশ বাণিজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে (স্থূলভাবে বলা হয় একমাত্র স্বাধীন বাণিজ্যই তার কারণ, তার চেয়েও কিন্তু অনেক বড় কারণ রেলপথ, সমুদ্র জাহাজ ও সাধারণভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল বিস্তার) শ্রমিক শ্রেণিকে ফের উদারনীতিক দলের অধীনে যেতে হয়- প্রাক চার্টিস্ট যুগের মত তারা হয় এ দলের র্যা ডিক্যাল অংশ। তাদের ভোটাধিকারের দাবি কিন্তু ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে; উদারনীতিকদের হুইগ নেতারা যে-ক্ষেত্রে ভয় পায় সে-ক্ষেত্রে ডিজরেলি তাঁর উৎকর্ষের প্রমাণ দিয়ে টোরিদের পক্ষে অনুকূল মুহূর্তটিকে ব্যবহার করে আসনের পুনর্বণ্টনসহ প্রবর্তন করান ‘বুরো’-গুলিতে ঘর পিছু ভোট (household suffrage in the boroughs)। অতঃপর প্রবর্তিত হয় ব্যালট; তারপরে ১৮৮৪ সালে কাউন্টিগুলিতে ঘর-পিছু ভোটাধিকারের প্রসার এবং আসনের আর একটা নববণ্টন যাতে নির্বাচনী এলাকাগুলি কিছুটা সমান সমান হয়ে আসে। এই সব ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির নির্বাচনী ক্ষমতা একটা বেড়ে যায় যে, অন্তত দেড়’শ থেকে দুই’শটি নির্বাচনী এলাকায় এ শ্রেণির লোকেরা এবার হয় অধিকাংশ ভোটদাতা। কিন্তু ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখানোর একটা খাসা স্কুল হল পার্লামেন্টি ব্যবস্থা; লর্ড জন ম্যানের্স ঠাট্টা করে যাদের বলেছিলেন ‘আমাদের সাবেকি অভিজাত’ তাদের দিকে মধ্য শ্রেণি যদি তাকায় সভয়সম্ভ্রমে তাহলে শ্রমিক শ্রেণিও শ্রদ্ধা সম্মান করে তাকাবে মধ্য শ্রেণির দিকে যাদের অভিহিত করা হয়েছে তাদের ‘শ্রেয়তম’ বলে। বস্তুতপক্ষে, বছর পনের আগে ব্রিটিশ মজুর ছিল আদর্শ মজুর, মনিবের প্রতিষ্ঠার প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মান এবং নিজের জন্য অধিকার দাবি করতে তার সংযমী বিনয় আমাদের ক্যাথিডার- সোস্যালিস্ট গোষ্ঠীর জার্মান অর্থনীতিবিদরা তাদের স্বদেশি মজুরদের দুরারোগ্য কমিউনিস্ট এবং বিপ্লবী প্রবণতার একটা সান্ত্বনা পেয়েছিল।

কিন্তু ইংরেজ মধ্য শ্রেণি ভাল ব্যবসায়ী বলে জার্মান অধ্যাপকদের চাইতে দূরদর্শী। শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে তারা ক্ষমতা ভাগ করে যে নিয়েছিল তা অনিচ্ছা সহকারে। চার্টিস্ট আন্দোলনের বছরগুলিতে তারা শিখেছে সেই puer robustus sed malitious, অর্থাৎ জনগণের ক্ষমতা কেমন। সেই সময় থেকে জনগণের চার্টারের সেরা ভাগটা যুক্তরাজ্যের স্ট্যাটিউটে সন্নিবদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এখনই সবচেয়ে বেশি করে জনগণকে শৃঙ্খলায় রাখতে হবে নৈতিক উপায়ে, এবং জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তারের কার্যকরী সমস্ত নৈতিক উপায়ের মধ্যে প্রথম ও প্রধান উপায় ছিল এবং রয়েই গেল ধর্ম। এই কারণেই স্কুল বোর্ডগুলিতে পাদ্রীদের সংখ্যাধিক্য, এই কারণেই পূজার্চনা থেকে ‘স্যালভেশন আর্মি’ পর্যন্ত সর্ববিধ পুনরুদয়বাদের (revivalism) সমর্থনে বুর্জোয়াদের ক্রমবর্ধমান আত্ম-ট্যাক্স।

কন্টিনেন্টি বুর্জোয়ারা স্বাধীন চিন্তা ও ধর্মীয় শিথিলতার ওপর এবার জিত হল ব্রিটিশ শালীনতার। ফ্রান্স ও জার্মানির শ্রমিকরা বিদ্রোহভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল। সমাজতন্ত্রে তারা একেবারে সংক্রামিত এবং যে উপায়ে স্বীয় প্রাধান্য অর্জন করতে হবে, তার বৈধতা নিয়ে তারা, সঠিক কারণেই, বিশেষ ভাবিত নয়। এখানকার puer robustus দিন দিন বেশি malitiosus হয়ে উঠছে। বড়াই করে জ্বলন্ত চুরুটটা নিয়ে ডেকের ওপর সমুদ্রপীড়ার প্রকোপে ছোকরা যাত্রী যেমন সেটিকে গোপনে ত্যাগ করে তেমনিভাবে শেষ পন্থা হিসাবে ফরাসি ও জার্মান বুর্জোয়ার পক্ষে তাদের স্বাধীন চিন্তা নিঃশব্দে পরিত্যাগ করা ছাড়া আর কোন গত্যান্তর রইল না; বাইরের ব্যবহারে একের পর এক ধার্মিক হয়ে উঠতে লাগলো ঈশ্বরবিদ্বেষীরা, চার্চ এবং তার শাস্ত্রবচন ও অনুষ্ঠানাদির ওপর কথা কইতে লাগল সম্মান করে, যেটুকু না করলে নয় সে সব মেনেও নিতে লাগল। ফরাসি বুর্জোয়ারা শুক্রবার শুক্রবার হবিষ্যি শুরু করল আর রবিবার রবিবার জার্মান বুর্জোয়ারা গির্জায় নিদিষ্ট আসটিতে বসে শুনতে লাগলো দীর্ঘ প্রটেস্টান্ট সার্মন। বস্তুবাদ নিয়ে তারা বিপদে পড়েছে। “Die Religion muss dem volk erhaltenwerden”-ধর্মকে জীইয়ে রাখতে হবে জনগণের জন্য- সমূহ সর্বনাশ থেকে সমাজের পরিত্রাণের এই হল ও সর্বশেষ উপায়। দুর্ভাগ্যবশত, চিরকালের মত ধর্মকে চূর্ণ করার জন্য যথাসাধ্য করার আগে এটি তারা আবিষ্কার করতে পারেনি। এবার বিদ্রূপ করে ব্রিটিশ বুর্জোয়ার বলার পালা : “আহাম্মকের দল, এ কথা তো দুশো বছর আগেই আমি তোমাদের বলতে পারতাম!”

আমার কিন্তু আশঙ্কা, ব্রিটিশদের ধর্মীয় নিরেটত্ব অথবা কন্টিনেন্টি বুর্জোয়াদের post festum দীক্ষাগ্রহণ কিছুতেই বর্তমান প্রলেতারীয় তরঙ্গকে ঠেকাতে পারবে না। ঐতিহ্যের একটা মস্ত পিছু টানের শক্তি আছে, ইতিহাসের সে vis inertiae কিন্তু নিতান্ত নিষ্ক্রিয় বলে তা ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য এবং এই কারণে পুঁজিবাদী সমাজের চিরস্থায়ী রক্ষাকবচ ধর্ম হবে না। আমাদের আইনি, দার্শনিক ও ধর্মীয় ধারণাগুলি যদি হয় একটা নির্দিষ্ট সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্কপাতের মোটামুটি সুদূর কতকগুলো শাখা তাহলে এই সম্পর্কের আমূল পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া সহ্য করে এ সব শাখা টিকে থাকতে পারবে না। এবং অলৌকিক দৈব-প্রজ্ঞায় বিশ্বাস না করলে আমাদের মানতেই হবে যে, পতনোম্মুখ সমাজকে ঠেকা দিয়ে রাখার শক্তি কোন ধর্মীয় প্রবচনেই নেই। বস্তুতপক্ষে ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণি বেশ সচল হয়ে উঠেছে। সন্দেহ নেই যে, তারা নানাবিধ ঐতিহ্যে শৃঙ্খলিত। বুর্জোয়া ঐতিহ্য, যথা এই ব্যাপক-প্রচলিত বিশ্বাস যে, শুধু রক্ষণশীল ও উদারনীতিক, মাত্র এই দুই পার্টিই থাকা সম্ভব এবং শ্রমিক শ্রেণিকে মুক্তি অর্জন করতে হবে মহান উদারনীতিক পার্টির সাহায্যে ও তারই মাধ্যমে। শ্রমিকদের ঐতিহ্য, যা স্বাধীন সংগ্রামের প্রথম খসড়া প্রচেষ্টা থেকে তারা পেয়েছে, যথা যারা একটা নিয়মিত শিক্ষানবিসীর মধ্য দিয়ে আসেনি এমন সমস্ত আবেদনকারীকে সাবেকি বহু ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বাদ দিয়ে রাখা; তার অর্থ দাঁড়াবে এই সব ইউনিয়ন কর্তৃক নিজেদের হাতেই নিজেদের বেইমান বাহিনী গঠন করা। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও শ্রমিক শ্রেণি এগুচ্ছে, ভ্রাতৃপ্রতিম ক্যাথিডার- সোস্যালিস্টদের কাছে এমনকি অধ্যাপক ব্রেনতানোকেও যা রিপোর্ট করতে হয়েছে সখেদে। এগুচ্ছে ইংল্যান্ডের সবকিছুর মতোই, ধীরে ধীরে পা মেপে মেপে, কোথাও দ্বিধা, কোথাও মোটের ওপর অসফল অনিশ্চিত প্রচেষ্টায়; এগুচ্ছে মাঝে মাঝে সমাজতন্ত্র এই নামটার প্রতি এক অতিসতর্ক অবিশ্বাস নিয়ে, সেই সঙ্গে ক্রমশই তার সারবস্তুটিকে আত্মসাৎ করছে সে; এবং এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকদের একটার পর একটা স্তরকে ধরে ফেলছে। লন্ডন ইস্ট এন্ডের অনিপুণ মজুরদের তন্দ্রা ঘুচিয়ে দিয়েছে এ আন্দোলন, এবং আমরা সকলেই জানি, প্রতিদানে এই নতুন শক্তিগুলো কী চমৎকার প্রেরণা জুগিয়েছে শ্রমিক শ্রেণিকে। আন্দোলনের গতি যদি কারও অধৈর্যের সমপর্যায়ে না ওঠে তাহলে এ কথা যেন তাঁরা না ভোলেন যে, ইংরেজ চরিত্রের সেরা গুণগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে শ্রমিকেরাই এবং একটা অগ্রসর পদক্ষেপ যদি ইংল্যান্ডে একবার অর্জিত হয় তাহলে পরে তা প্রায় কখনও মোছে না। সাবেকি চার্টিস্টদের ছেলেরা যদি পূর্ব কথিত কারণে ঠিক বাপ কা বেটা হয়ে উঠতে না পেরে থাকে, তবে নাতিদের দেখে মনে হয় পূর্বপুরুষদের মান তারা রাখবে।

কিন্তু ইউরোপীয় শ্রমিকদের বিজয় শুধু ইংল্যান্ডের ওপরেই নির্ভরশীল নয়। সে বিজয় অর্জিত হতে পারে অন্তত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির একযোগে। শেষোক্ত দুটি দেশেই শ্রমিক আন্দোলন ইংল্যান্ডের চেয়ে বেশ এগিয়ে। জার্মানিতে এমনকি তার সাফল্যের দিন এখন হিসাবের মধ্যেও ধরা যায়। গত পঁচিশ বছরে সেখানে তার যে অগ্রগতি ঘটেছে সেটা অতুলনীয়। ক্রমবর্ধমান গতিতে তা এগুচ্ছে। জার্মান মধ্য শ্রেণি যদি রাজনৈতিক দক্ষতা, শৃঙ্খলা, সাহস, উদ্যোগ, অধ্যাবসায়ে শোচনীয় অযোগ্যতা জাহির করে থাকে, তবে জার্মান শ্রমিক শ্রেণি সবকটি যোগ্যতারই প্রভূত প্রমাণ দিয়েছে। চারশ বছর আগে ইউরোপীয় মধ্য শ্রেণির প্রথম উৎসারের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল জার্মানি; অবস্থা এখন যা, তাতে ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েতের প্রথম মহান বিজয়ের মঞ্চও হবে জার্মানি, এ কি সম্ভাব্যতার বাইরে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!