সমাজতন্ত্র শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, ধারনার উদ্ভব ও ব্যখ্যা

সমাজতন্ত্রের ইংরেজি ‘socialism’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ sociare থেকে এসেছে। ল্যাটিন শব্দটির অর্থ সংযুক্ত করা বা অংশীদার করা। এই সম্পর্কিত, রোমান ভাষায় এবং পরবর্তীতে মধ্যযুগের আইনে আরো কুশলী শব্দ হল societas. পরের societas শব্দটি দ্বারা বোঝাতো সাহচর্য এবং সংঘ বা সহযোগিতা। এছাড়াও শব্দটি দ্বারা আরো আইনানুগ ধারণায় বোঝাতো মুক্তমানুষের মধ্যে সম্মতিসূচক চুক্তি।[১] সেইন্ট সাইমন ছিলেন একজন কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী যিনি সমাজতন্ত্র শব্দটি তৈরি করেন। ফরাসি বিপ্লবোত্তরকালে ব্যক্তিবাদের উদার তত্ত্বের বৈসাদৃশ্য বোঝাতে সমাজতন্ত্র শব্দটি তৈরি করা হয়। ব্যক্তিবাদ মূলত জোর দেয় যে জনগণকে একজন আরেকজনের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে ক্রিয়া করতে হয় বা ক্রিয়া করা উচিত। সমাজতন্ত্রীরা উদার ব্যক্তিবাদীদের এই বলে অভিযুক্ত করেন যে তারা দারিদ্রের সামাজিক উদ্বেগ, সামাজিক নির্যাতন, এবং মোট সম্পদের অসাম্যকে লোপ করতে ব্যর্থ। সমাজতন্ত্রীরা আরো মতামত দেন যে, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে তৈরি সমাজের বর্ধন করে সংঘ জীবনের ঐকতানের ক্ষতি করছে যাকে উদার ব্যক্তিবাদীরা সমর্থন করে এবং এর ফলে তারা স্বার্থপর অহংবাদ বাড়িয়ে সমাজকে অধপতিত করছে। তারা সমাজতন্ত্রকে সহযোগিতার ভিত্তিতে চালিত উদার ব্যক্তিবাদের বিকল্প হিসেবে এক সমাজ হিসেবে সমর্থন করেন।[২] সমাজতন্ত্র শব্দটি আরোপ করা হয় ফরাসি দার্শনিক পিয়েরে লেরক্স (১৭৯৭_ ১৮৭১) ও লেখক মেরি রক লুই রেবো (১৭৯৯_ ১৮৭৯); ইংল্যান্ডে সমবায় আন্দোলনের অগ্রদূত রবার্ট ওয়েনের (১৭৭১_ ১৮৫৮) উপর। রবার্ট ওয়েন ১৮২৭ সালে কোঅপারেটিভ ম্যাগাজিনে প্রথম ব্যবহার করেন। মার্কস ও এঙ্গেলসের পূর্ববর্তী লেখকেরা সমাজব্যবস্থার গতি প্রকৃতি এবং লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কল্পলোকের আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তারা সমাজের অতিপ্রকট বাধাগুলো থেকে মুক্ত এক সমাজের কাল্পনিক দিকনির্দেশ করতেন। কিন্তু মার্কস এঙ্গেলস তাঁদের রচনাবলীর মাধ্যমে নতুন সমাজের মূল বিশেষত্বগুলিকে তার বিকাশের ধারার ভিত্তিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সমাজবিকাশের সাধারণ নিয়মের ভিত্তিতে। একারণে মার্কসবাদ কোনো গোঁড়া মতবাদ নয়, অধিকন্তু এটি হলও কর্মের দিশারি। আর এই কারণেই মার্কসবাদকে বলা হয় ‘Philosophy of Praxis’ বা ‘বাস্তব কর্মকাণ্ডের দর্শন’। 

আরো পড়ুন:  পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পুঁজির তেজী ও মন্দার চক্র

ফরাসি বিপ্লবের বহু পূর্ব থেকে তথা মানব ইতিহাসে শ্রেণি ও শোষণ উদ্ভবের কাল থেকেই সমাজকে কেন্দ্র করে সাম্যবিষয়ক চিন্তা মানুষ করে এসেছে। আধুনিক যুগের মানুষ প্রগতিশীল বিকাশে মানবজাতির ঐতিহাসিক স্থান ব্যাখ্যার আগ্রহে আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের (Primitive Clan Society) প্রতি কৌতূহলী হয়। নৃতত্ত্ববিদগণ আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজকে মানবজাতির ক্রমবিকাশে এক অনিবার্য সূচনাগ্রন্থি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আদিম ভিত্তিতে হলেও সেই সমাজ দেখিয়েছে যে ব্যক্তিগত মালিকানা, শোষণ, শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রামরাষ্ট্র ছাড়াও মানুষের জীবন গড়ে উঠতে পারে। এখান থেকেই সূচনা ঘটেছে বহু কমিউনিস্ট ঐতিহ্যের; সামাজিক মালিকানা, যৌথ প্রথা, স্বাধীনতা, সমতা, গণতান্ত্রিকতা ইত্যাদির। ইতিহাসের গতিপথে সেগুলো হারিয়ে যায়নি। বরং যথার্থ সমাজতন্ত্রে গুণের বিচারে নবরূপে বাস্তবায়িত হবার ভিত্তি তৈরি হয়েছে।[৩]

আধুনিককালে সমাজতন্ত্র শব্দটির সংজ্ঞা ও ব্যবহার পাকাপোক্ত হয় ১৮৬০ এর বছরগুলোতে সেই সময়ের আগে ব্যবহৃত সমবায়ী (co-operative), পারস্পরিকপন্থী (mutualist) এবং সংঘপন্থী (associationist) শব্দগুলোর পরিবর্তে। ১৮৪০ এর বছরগুলোতে সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদ শব্দ দুটির পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যের জন্য সাম্যবাদ শব্দটির ব্যবহার কমে যায়। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ শব্দ দ্বারা আগে বোঝানো হতো যে প্রথম শব্দটি শুধু উৎপাদনের সামাজিকীকরণ করতে চায় যেখানে সাম্যবাদ উৎপাদন এবং ভোগ উভয়ের সামাজিকীকরণ চায়। ১৮৮৮ সালের আগে মার্কসবাদীরা সাম্যবাদের পরিবর্তে সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করতো। সাম্যবাদ এখন সমাজতন্ত্রের সমার্থক নয় এবং ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর লেনিন সমাজতন্ত্রকে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যবর্তী স্তর হিসেবে উপস্থাপন করলে শব্দটি আবার সামনে আসে যদিও সেসময় পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী মার্কসবাদীরা সমালোচনা করতো যে রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য যথার্থ উন্নত নয়।

আধুনিককালের সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী চিন্তা আবির্ভাবের হাজার বছর পূর্বে দেখা দিয়েছিল মানবজাতির সুখ ও ন্যায়পরায়ণ সমাজের অনুসন্ধানের এক দীর্ঘ চিন্তাভাবনা। মানবজাতির চিন্তায় এসেছিল কমিউনিস্ট কল্পলোকের নানা উৎস ও পর্ব। এসব পর্বের ভেতরে আলোচনা করার প্রয়োজন কমিউনিস্ট কল্পলোকের প্রাথমিক পর্ব, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের কমিউনিস্ট কল্পলোক এবং অষ্টাদশ শতকের ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র।

আরো পড়ুন:  অভিজাতবাদ বা সম্ভ্রান্তবাদ বা এলিটবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচিত তত্ত্ব

তথ্যসূত্র:

১. Andrew Vincent. Modern political ideologies. Wiley-Blackwell publishing. 2010. pg. 83

২. Marvin Perry, Myrna Chase, Margaret Jacob, James R. Jacob. Western Civilization: Ideas, Politics, and Society – From 1600, Volume 2. Ninth Edition. Boston, Massachusetts, USA: Houghton Mifflin Harcourt Publishing Company, 2009. p. 540

৩. এ বিষয়ে আরো দেখুন, খারিস সাবিরভ, কমিউনিজম কী, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৮। 

৭. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ১৮-২০ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ৩০ অক্টোবর, ২০১৪। 

Leave a Comment

error: Content is protected !!