সমাজতান্ত্রিক সমাজে জনশিক্ষার গুরুত্ব ও প্রকৃতি

সমাজতন্ত্র জনশিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচনা করে। একটি প্রগতিশীল ও সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিনির্মাণে সহায়ক। সমাজতন্ত্রে জনসাধারণ অবাধে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ লাভ করে। এটি ব্যক্তিমানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টি করে। ভ্লাদিমির লেনিন বলেছেন,

“পুরনো আমলে, মানুষের প্রতিভা, মানুষের মস্তিষ্ক সৃষ্টি করেছিল শুধু কিছু লোককে প্রযুক্তিবিদ্যা ও সংস্কৃতির সুফলগুলো দেয়ার জন্য এবং অন্যদের ন্যূনতম অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী, শিক্ষা ও বিকাশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য। এখন থেকে বিজ্ঞানের সমস্ত বিস্ময় ও সংস্কৃতির অর্জনগুলো সামগ্রিকভাবে জাতির সম্পত্তি, এবং আবার কখনো মানুষের মস্তিষ্ক ও মানবপ্রতিভা নিপীড়ন ও শোষণের জন্য ব্যবহৃত হবে না।”[১]

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিশ্চিত করা হয় জনসাধারণের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বৃত্তিমূলক প্রস্তুতির একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। সেই রাষ্ট্রে তরুণ তরুণীদের লালন এবং আত্মিক ও দৈহিক বিকাশের জন্য কমিউনিস্ট শিক্ষাব্যবস্থা নিয়োজিত থাকে; তরুণ তরুণীদের তৈরি করা হয় সামাজিক ক্রিয়াকলাপের জন্য। সমাজের প্রয়োজন অনুসারে বিজ্ঞানের পরিকল্পিত বিকাশ ও বৈজ্ঞানিক কর্মীবাহিনী তৈরি করে সমাজতন্ত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল জনসাধারণের পক্ষে প্রয়োগের আয়োজন করে। পুঁজিবাদে পুঁজিপতিরা আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্ময়গুলোকে মুনাফা সৃষ্টির কাজে লাগায়, এর বিপরীতে সমাজতন্ত্র কাজে লাগায় সমগ্র সমাজের কাজে।

সমাজতন্ত্রে শিক্ষা ব্যবস্থায় নিশ্চিত হয় রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় গণতান্ত্রিক নীতিগুলোর সুসংগত রূপায়ণ। জনগণের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেলে তাঁদের সামাজিক-রাজনৈতিক সক্রিয়তা বেড়ে ওঠে, সামাজিক কমিউনভিত্তিক কাজকর্মের পরিচালনায় সাম্যাকাঙ্খি তরুণতরুণীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। তরুণ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও জ্ঞানপ্রচার কর্মীদের হতে হয় অগ্রবাহিনী। জ্ঞানের অবিরাম প্রচার একটি রাজনৈতিক কাজ, সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের রাজনৈতিক সাংগঠনিক কাজ ছাড়া জ্ঞানপ্রচার কর্মীদের কাজ পরিপূর্ণতা পাবে না। ‘জ্ঞানপ্রচার রাজনীতির সংগে সংশ্লিষ্ট না হয়ে পারে না’[২]।  

সমাজতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থার কাজ হলও সামাজিক শ্রেণিভেদ মুছে জেলায় সাহায্য করা। এই শিক্ষা ব্যবস্থার আরো কাজ হলও উৎপাদনের জন্য শুধু কর্মী তৈরিই নয়, উৎপাদনের উপকরণের উপর সর্বজনীন মালিকানার সমান অংশীদার এবং সমৃদ্ধচিত্ত মানুষ গড়ে তুলতে সহায়তা করা। কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“শিক্ষা সাধারণভাবেই নির্ভর করে জীবনের পরিস্থিতির উপর”।[৩]

শিক্ষার বিষয়বস্তু, গঠন, সামাজিক কাজ নির্ধারিত হয় বিজ্ঞান ও উৎপাদন শক্তি বিকাশের মান, শ্রমের সামাজিক গঠন, জনসাধারণের সামাজিক শ্রেণিগত সম্পর্ক এবং সমাজের প্রাধান্যকারী মতাদর্শ দিয়ে।

আরো পড়ুন:  পাগলামী বা মানসিক রোগ হচ্ছে ব্যক্তির ক্রিয়াকর্মে নিয়ন্ত্রণক্ষমতার হ্রাস বা অভাব

সমাজতন্ত্রে সব ধরনের শিক্ষাই হবে অবৈতনিক। শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বনিম্ন থেকে সর্বউচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণের সরবরাহ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার একটি মহতী কীর্তি। সমাজতন্ত্রে শিক্ষা ‘পুঁজি লগ্নির ধরন’, ভবিষ্যৎ চাকরির ‘ব্যয়’ নয়; বরং শিক্ষা হলও স্বাধীন শ্রমজীবনের প্রস্তুতি লাভে সমাজের খরচায় সমস্ত বর্গের শিশু ও তরুণতরুণীদের জন্য সমান সুযোগ। সমাজতান্ত্রিক সমাজে একটি স্তর পর্যন্ত সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষার নৈর্ব্যক্তিক প্রয়োজন দেখা দেয় কেবল কারিগরি বা কর্মমুখী দিক থেকেই নয়, সামাজিক দাবি থেকেও। সে কারণেই তা কখনো সংকীর্ণ উপযোগিতাবাদী চরিত্র ধারণ করে না। সমাজতান্ত্রিক সমাজে বৈজ্ঞানিক-কারিগরি উন্নতি আর শিক্ষা ব্যবস্থার কাজকর্ম, দুইই এমন একটা ধারা নেয় যাতে জনগণ আর সমগ্র সমাজের স্বার্থ মেটে। মনে রাখা দরকার যে উৎপাদন বিকাশের মানের চেয়ে শিক্ষাকে এগিয়ে থাকতে হবে, কেননা লোকের শিক্ষার মূল বিষয়গুলো আয়ত্ত্ব করা হয় তার বাল্যকালে ও কৈশোরে, এই বয়সেই তাকে এমন জ্ঞান দিতে হবে যা প্রয়োজন ও পরিবর্তনসহ কাজ দেবে অন্তত ৫০-৬০ বছর।

সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা্কে জনগণকে তৈরি করে কেবল নির্দিষ্ট এক ধরনের শ্রমের জন্যই নয়; বরং সমাজতান্ত্রিক জনশিক্ষা ব্যক্তিকে তৈরি করে শ্রমের সম্ভাব্য পরিবর্তন, সক্রিয় সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, পরিবার ও সমাজে নানান ভূমিকায় অংশগ্রহণের জন্যও। সমাজতন্ত্রে এটা নিয়মসংগত বলে মেনে নেয়া উচিত যে শিক্ষার কাছে উৎপাদন ও কারিগরি দাবির চেয়ে সামাজিক দাবিটা খানিকটা এগিয়ে থাকে; এবং সমাজতন্ত্রে শিশু ও তরুণতরুণীদের সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রস্তুতির ব্যবস্থা করার সময় সামাজিক দাবির বিষয়টি বিবেচনায় থাকে। কার্ল মার্কস তাঁর গোথা কর্মসূচির সমালোচনায় দেখিয়েছেন যে,

“বিদ্যালয় সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংগে মিলিয়ে অন্তত টেকনিকাল (তত্ত্বগত এবং ব্যবহারিক) স্কুল দাবি করা উচিত ছিল”।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যালয়ে ছাত্রদের কারিগরি শিক্ষা, ললিতকলা চর্চা, দেহ গঠন, শরীরচর্চা ও ক্রীড়ার বিকাশে সহায়তা করা হয়। বৈজ্ঞানিক-কারিগরি বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্কের বিকাশ দাবি করে সাধারণ শিক্ষার বিষয়বস্তুর নিয়মিত নবায়ন। বিজ্ঞান ও উৎপাদনের কৃতিত্ব এবং সামাজিক বাস্তবতার দাবি অনুসারে শিক্ষার বিষয়বস্তু অনিবার্যভাবে বদলাতে থাকবে ভবিষ্যতেও। “প্রত্যেকটি লোকেরই স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত”_ এই কমিউনিস্ট আদর্শ অনুসারে সমাজের লক্ষ্য হবে নিজেদের সৃজনী শক্তি, সমর্থ আর গুণ প্রয়োগের জন্য, ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য নাগরিকদের বাস্তব সুযোগ প্রসার।

আরো পড়ুন:  সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ ব্যবস্থার বা সমাজের পার্থক্যরেখাগুলো কোথায় ও কীভাবে?

সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ শিক্ষার বিদ্যালয় হবে শ্রমমুখী বিদ্যালয়। তাতে প্রকাশ পায় সমাজতান্ত্রিক সমাজের শ্রমমূলক চরিত্র যেখানে শোষক শ্রেণি ও স্তর পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন। শ্রমমুখী বিদ্যালয়ের কথাটা উপস্থিত করেছেন বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠাতারা। কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষার দাবি মেনে এবং বয়সজনিত বৈশিষ্ট্যের কথা মনে রেখে আগেই শিক্ষার সংগে উৎপাদনী শ্রমের মিলন হলও আধুনিক সমাজ পুনর্গঠনের একটি প্রবল উপায়।”[৪]

শিক্ষা ও শ্রমের ঐক্য তেমন সমাজে স্থাপিত হতে পারে না যেখানে আছে শোষক, পরজীবী শ্রেণি। ভ্লাদিমির লেনিন লিখেছেন,

“সর্বজনীন উৎপাদনী শ্রমের সংগে সর্বজনীন শিক্ষাকে সংযুক্ত করতে হলে স্পষ্টতই সকলের ওপরেই উৎপাদনী শ্রমে যোগদানের কর্তব্য ন্যস্ত থাকা উচিত।”[৫]

পরজীবী শ্রেণিকে কর্মে যুক্ত করতে চিন্তার সংগ্রাম করতে শিক্ষকবাহিনীকে নিতে হবে বিপুল শিক্ষামূলক কর্তব্য। সাম্যবাদীদের মনে রাখা দরকার, সমাজতন্ত্র আকাশ থেকে পড়ে না, এটিকে তৈরি করে নিতে হবে। সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণে শিক্ষক ও মনীষীগণ প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, এই আশাবাদ সমাজতন্ত্রেরই শক্তি।[৬]

তথ্যসূত্র:

১. Vladimir Lenin, Collected Works, Vol. 2, Progress Publishers, Moscow, 1964, Page-481-82

২. আরো দেখুন, ভি. আই. লেনিন, জনশিক্ষা, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, তারিখহীন, পৃষ্ঠা- ১২০-২১।

৩. কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস; নির্বাচিত রচনাবলী, ষষ্ঠ খণ্ড; প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৬; পৃষ্ঠা-৪১৫

৪. Karl Marx, F. Engels, Collected Works, Vol. 19, Progress Publishers, Moscow, 1981, Page-31)।

৫. Vladimir Lenin, Collected Works, Vol. 2, Progress Publishers, Moscow, 1963, Page-473)।

৬ এম আর চৌধুরী, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রক্রিয়া, উত্তর কমলাপুর, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১০০-১০১। প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ১২৬-১৩০ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশিত। প্রবন্ধটির রচনাকাল ২৪-২৮ আগস্ট ২০১৪। 

Leave a Comment

error: Content is protected !!