প্রলেতারিয়েত শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা হচ্ছে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব (ইংরেজি: Proletarian Dictatorship) যা তারা সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ ও দৃঢ়করণের জন্য ব্যবহার করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা থেকে অপসারিত শোষকদের বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে এটি ক্রিয়া করে। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের প্রয়োজনীয় শর্ত হলো সমাজতন্ত্র গড়ার লক্ষ্যে পরিচালিত সমস্ত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শোষক শ্রেণিগুলো যেসব প্রতিরোধমূলক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে সেগুলোকে দমন করা। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সৃজনশীলতা। অর্থাৎ, নিপীড়ক ও নিপীড়িত শ্রেণিসমূহের মধ্যে সমাজের বিভক্তির অবসান ঘটানো; মানুষের উপর মানুষের শোষণের লোপ করবার অবস্থা সৃষ্টি। প্রলেতারিয়েত শ্রেণির ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সামাজিক সংগঠনগুলো যেমন শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন সমবায়, যুব সংগঠন ইত্যাদির মাধ্যমে। প্রলেতারীয় একনায়কত্বে নেতৃভূমিকা থাকে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির কমিউনিস্ট পার্টির।[১]
প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ ঘটাতে উত্তরণ পর্বে এক প্রয়োজনীয় জিনিস। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ নির্মাণের দিকে সমাজের রূপান্তর সাধন। কার্ল মার্কস লিখেছেন, পুঁজিবাদী সমাজ আর কমিউনিস্ট সমাজ, এই দুইয়ের মধ্যে রয়েছে একটি থেকে অপরটিতে বিপ্লবী রূপান্তরের এক পর্ব। তারই সহগামী থাকে একটি রাজনৈতিক উৎক্রমণ পর্ব যখন রাষ্ট্র প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।[২]
এ প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী একনায়কত্ব কমিউনিস্ট পার্টিকে উত্তরণ পর্ব ও পরবর্তীকালে বিজ্ঞানসম্মত পথে জটিল করণীয় কাজগুলো সমাধা করতে পথ দেখায়। কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্ব দেবার ফলে দল বহির্ভূত জনগণের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গঠনের কাজে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব দরকারি। সহজ কথায়, বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ধ্বংস ও নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত হয়েছে প্রলেতারিয়েতের উপর এবং এটি প্রয়োগ করা যাবে শোষকদের বিরুদ্ধে একনায়কত্বের মাধ্যমে। ফলে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের প্রয়োজন শোষকদের দমন করার স্বার্থে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যত সুদৃঢ় হয়, শ্রেণি প্রতিপক্ষকে দমনের কম কঠোর উপায় অবলম্বনের সুযোগও তত বাড়ে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে কথা উঠলেই আসে গণতান্ত্রিক সাম্যের কথা। কিন্তু বুলিবাগিশ ও সকল ধরনের সমাজগণতন্ত্রী ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা এই সত্য মেনে নেয় না যে গণতন্ত্র কখনোই শ্রেণি নিরপেক্ষ হতে পারে না। অর্থাৎ তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে শ্রমিক ও প্রলেতারিয়েতের শ্রেণিদৃষ্টিতে এক ধরনের একনায়কতন্ত্র, এটা তারা বুঝতে চায় না।
এছাড়াও বুলিবাগিশদের রাষ্ট্র সম্পির্কিত ধারনায় তারা রাষ্ট্রের শোষণ প্রক্রিয়াটিকে আড়াল করেন। বুলিবাগিশরা, বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা ও সকল সমাজ গণতন্ত্রীরা বুঝতে চায় না যে, রাষ্ট্র একটা যন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু নয়, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শ্রেণি শত্রুকে দমন করা এবং একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থ হাসিল করার সব রকমের সুযোগ সুবিধার বৈধতা দেয়া।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্ছেদ করে নতুন রাষ্ট্রের স্থাপন, শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক প্রভুত্ব বা প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের প্রশ্নটি বৈজ্ঞানিক কমিউনিজম তত্ত্বের প্রধান কথা। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব ছাড়া কমিউনিজম নির্মাণ অসম্ভব। সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব হলও বর্তমান বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্বের বিপরীতে প্রলেতারিয়েতের হাতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের কর্মনীতি প্রদান।
শ্রমিকশ্রেনীর একনায়কত্ব প্রসংগে লেনিন বলেন,
“বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রূপ অসাধারণ বিচিত্র, কিন্তু তাদের মূলকথাটা এক: এ সমস্ত রাষ্ট্রই কোনো না কোনোভাবে, এবং শেষ বিচারে অবধারিতভাবেই বুর্জোয়া একনায়কত্ব। পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উৎক্রমণে অবশ্যই রাজনৈতিক রূপের বিপুল প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য না দেখা দিয়ে পারে না, কিন্তু তাদের মূলকথাটা থাকবে অনিবার্যভাবে একটা: প্রলেতারীয় একনায়কত্ব”।[৩]
লেনিনের বক্তব্যকে যদি আমরা বিপরীতভাবে দেখি তাহলে বর্তমানে জারি থাকা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে দেখতে পাই যা মুলত শ্রমিকশ্রেণির উপর বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্ব যা শুধু আইন কানুন দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, বল প্রয়োগের উপর প্রতিষ্ঠিত। এবং এ শাসনের প্রতি আছে গুটিকয়েক বুর্জোয়ার সহানুভুতি আর সমর্থন। এক্ষেত্রে স্তালিনের বক্তব্য আরো পরিষ্কার। তার মতে,
“রাষ্ট্র হলো শ্রেণিশত্রুকে দমন করার জন্য শাসকশ্রেণির হাতে যন্ত্রবিশেষ। এই হিসাবে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের সংগে অন্য কোন শ্রেণির একনায়কত্বের তফাত নেই; কারণ শ্রমিকের রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের দমন করার যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য হলো এই যে, ইতিহাসে এ পর্যন্ত যত শ্রেণি-রাষ্ট্র হয়েছে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত জনসাধারণের উপর সংখ্যালঘু শোষকের একনায়কত্ব; আর শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব হলো সংখ্যালঘু শোষকের উপর শোষিত সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব।”।[৪]
সংক্ষেপে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব দরকার বুর্জোয়াদের প্রতিরোধ চূর্ণ করার জন্য, প্রতিক্রিয়াশীলদের মনে ভীতি সঞ্চারের জন্য, মজুরি-দাসত্বের অবসানের জন্য, বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জনগণের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য এবং প্রলেতারিয়েত যাতে তাদের প্রতিপক্ষদের বলপূর্বক দমিয়ে রাখতে পারে তার জন্য। সর্বোপরি প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব দরকার সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের জন্য।[৫]
তথ্যসূত্র:
১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১০০-১০১।
২. কার্ল মার্কস, গোথা কর্মসূচির সমালোচনা, মার্কস-এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ২৬-২৭।
৩. লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ৩৬।
৪. স্তালিন, লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, নবগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, এনবিএ, কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ২০০৯, পৃষ্ঠা ২৯।
৫. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৬৫-৬৯ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো।
রচনাকালঃ ২১ অক্টোবর, ২০১৪
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।