দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বা সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিক-এর কার্যক্রম ও ভূমিকা

শ্রমিক আন্দোলনে মার্কসবাদের বিজয়ের পক্ষে একান্ত ফলপ্রসূ ছিল প্রথম আন্তর্জাতিকের ক্রিয়াকলাপ, বিভিন্ন দেশে ব্যাপক প্রলেতারিয় পার্টি গড়ার জন্য যা জমিন তৈরি করেছিল। কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রকমিউনিজমের নানা শিক্ষা ও ধারার ব্যাপারে উনিশ শতকে মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের নির্মম সমালোচনা দ্বারা প্রলেতারিয়েতের মধ্যে মার্কসবাদ বিস্তারের পথ পরিষ্কার করেন।

শ্রমিক আন্দোলনে মার্কসবাদ বিজয়ের অকাট্য প্রমাণ হলও ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী দিনে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের উদ্বোধন কংগ্রেসে ইউরোপের প্রায় সব দেশ আর তার সংগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনার শ্রমিক সংগঠনগুলোর এক আন্তর্জাতিক সমিতি স্থাপন করা। প্রথম পর্যায়ে এঙ্গেলসের প্রভাবে এই আন্তর্জাতিক বিকাশলাভ করেছিল মার্কসবাদভিত্তিক এক প্রলেতারিয় সংগঠনরূপে, মার্কসবাদী ভাবধারা প্রচারে, শ্রমিক শ্রেণির শক্তি সঞ্চয়ে এবং বিভিন্ন শ্রমিক পার্টির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে। এই পর্যায়ে ইউরোপের অনেকগুলো সমাজতান্ত্রিক পার্টি বেশ বড় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃত ক্ষেত্রে ১৯০০ সালের প্যারিস কংগ্রেসে জার্মান সমাজ গণতন্ত্রী পার্টির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী ব্যুরো ব্রাসেলসে স্থাপিত হয়। এর ফলে সংগঠনের অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের প্রথম কংগ্রেসে ডেলিগেট উপস্থিত ছিলেন ৪০৪ জন এবং সংগঠনের যুগ্ম সভাপতি হন প্যারিস কমিউনের দুই নেতা এডওয়ার্ড ভেইল্যান্ট এবং উইলহেল্ম লিবকেন্ট।

১৮৯৬ সনে দলের নেতৃত্বের ভেতর মতবিরোধ চরমে ওঠে। সে বছর লন্ডনে অনুষ্ঠিত চতুর্থ কংগ্রেসে নৈরাজ্যবাদী ও সিন্ডিক্যালিস্ট অংশ বহিষ্কৃত হয়। এই কংগ্রেসে চেয়ারম্যান ছিলেন হেনরি হিন্ডম্যান। মার্কসবাদী অংশ গরিষ্ঠতা লাভ করে। মার্কস-এঙ্গেলস ছাড়া কাউতস্কি তখন আন্তর্জাতিকের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন আগস্ট বেবেল, এদুয়ার্দ বের্নস্তাইন, রোজা লুক্সেমবার্গ, ভ্লাদিমির লেনিন, লিও ত্রতস্কি, উইলিয়াম মার্কস প্রভৃতি। এই আন্তর্জাতিকে ছিলেন বেনিত্তো মুসোলিনিও।

১৯০৪ সনে আন্তর্জাতিক থেকে বের্নস্তাইনকে সংশোধনবাদী বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯১১ সনে রোজা লুক্সেমবার্গ এবং লেনিন যুদ্ধের বিরোধিতা করে প্রতিটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপ্লব চালিয়ে যাবার কথা বলেন। এই প্রশ্নে চূড়ান্ত মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯১৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক গঠিত হলে তার ধারাবাহিকতায় ১৯১৯-এ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দেয়া হয়। ১৯১২ সাল পর্যন্ত এই আন্তর্জাতিকের মোট কংগ্রেস হয় নয়টি। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিখ্যাত কার্যক্রমের মধ্যে আছে ১৯৮৯ সালে মে দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ ঘোষণা এবং ১৯১০ সালে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ ঘোষণা করা। এই আন্তর্জাতিক ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের প্রচারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে।

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট ইশতেহারের ১৮৯৩ সালের ইতালীয় সংস্করণের ভূমিকা

১৯২১ সনে ভিয়েনাতে এটি আবার পুনর্গঠনের চেষ্টা করা হয়। দু’বছর চেষ্টার পর বার্ন আন্তর্জাতিকের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন নাম গ্রহণ করা হয় শ্রমিক ও সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিক। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের আগে তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সনে এই সংগঠনই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বা সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিক বা সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (ইংরেজিতে Socialist International) নামে পরিচিত হয়।

প্রথম আন্তর্জাতিক যেমনি সংশোধনবাদ, শোধনবাদ, নৈরাজ্যবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে এবং সমস্ত রকমের সুবিধাবাদী, সংশোধনবাদী, নৈরাজ্যবাদী প্রভৃতিদের বর্জন করেই বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবেই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সর্বপ্রকারের সুবিধাবাদী, সংশোধনবাদী, নৈরাজ্যবাদী, জাতিদাম্ভিক-জাত্যাভিমানী, মধ্যপন্থী প্রভৃতিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে এবং এদের সংগে চূড়ান্তভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করেই বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। লেনিন খুব সঠিকভাবেই সমস্ত রকমের সুবিধাবাদীদের মার্কসবাদ-বিরোধীদের সংগে চূড়ান্তভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করেই তৃতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে মূল্যায়নে লেনিন বলেছেন,

“প্রথম আন্তর্জাতিক স্থাপিত হয় পুঁজির ওপর শ্রমিকদের বিপ্লবী হামলা প্রস্তুতির জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের বুনিয়াদ। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হলো এমন আন্তর্জাতিক প্রলেতারিয় আন্দোলনের সংগঠন, যা প্রসারে বাড়ছিল, ফলে বিপ্লবী মানের সাময়িক একটা হ্রাস, সুবিধাবাদের একটা সাময়িক প্রাবল্য না ঘটে যায়নি, শেষ পর্যন্ত যার পরিণতি হয় এ আন্তর্জাতিকের লজ্জাকর ভরাডুবিতে।”

তিনি আরও বলেন,

“দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হলো একগুচ্ছ দেশে আন্দোলনের ব্যাপক, গণ প্রসারের জমি প্রস্তুতির যুগ। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের কাজের সুফলগুলি গ্রহণ করেছে তৃতীয় আন্তর্জাতিক, তার সুবিধাবাদী, সোশ্যাল-শোভিনিস্ট, বুর্জোয়া ও ক্ষুদে বুর্জোয়া গাদ ছেঁকে ফেলে প্রলেতারিয় একনায়কত্ব কার্যকরী করতে শুরু করেছে।”

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ ও টিকা:

১. সমীরণ মজুমদার, মার্কসবাদ, বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, ১ বৈশাখ, ১৪০২, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫,

২. খারিস সাবিরভ, কমিউনিজম কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৭,

৩. ইংরেজি উইকিপিডিয়া।

৪. ভি. আই. লেনিন, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্য প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা- ১৪৩-১৪৮।

আরো পড়ুন:  সমাজতান্ত্রিক সমাজে জনশিক্ষার গুরুত্ব ও প্রকৃতি

৫. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৯৪-৯৬ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ১৩ জুলাই, ২০১৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!