এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি (ইংরেজি: Asiatic mode of production) হচ্ছে কৃষিভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় ভারত এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্য এশীয় সমাজে একটি সুদীর্ঘকালব্যাপী বিরাজিত নিশ্চলতা। কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় ব্রিটেনের বৈদেশিক নীতির সমালােচনাসূত্রে লিখিত কয়েকটি প্রবন্ধে (১৮৫৩) ‘এশীয় উৎপাদন-পদ্ধতি’ প্রত্যয়টির সূত্রপাত করেন যার মমার্থ হলো কৃষিভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় ভারত এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্য এশীয় সমাজে একটি নিশ্চলতা বিরাজ করে।[১]
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বংশানুক্রমিক শাসন থাকার ফলে সামরিক সংগ্রাম, রাজনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয়নি। মার্কসের মতে, সমগ্র এশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানার অধিকারের অনুপস্থিতি, যেহেতু এখানে গ্রামীণ কৌম গোষ্ঠীগুলি ছিল স্বায়ত্তশাসিত, ফলে আঞ্চলিক থেকে সাম্রাজ্যিক সমস্ত রাজাই ছিলো একচ্ছত্র মালিক।[২]
এশীয় সমাজের গতিহীনতার পশ্চাতে প্রাচীন গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা লক্ষিত হয়, যেখানে কৃষি ও কুটিরশিল্পের সমন্বয়ে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা (ইংরেজি: Autarky) দেখা যায়। স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের অধীন গ্রামীণ জীবন থেকেছে স্বনির্ভর। সীমিত শ্রমবিভাজনসহ ঐতিহ্যগতভাবে ভােগ্যপণ্য উৎপাদিত হয়; সেখানে নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি অনুসরণের অবকাশ নেই। কার্ল মার্কস গ্রামের কাঠামোর বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখা দেবার পর লিখেছেন
“শ্রমপরায়ণ পিতৃতান্ত্রিক ও নিরীহ সামাজিক সংগঠনগুলি … … শান্ত-সরল গ্রাম-গোষ্ঠীগুলি যতই নিরীহ মনে হোক, প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের তারাই ভিত্তি হয়ে এসেছে চিরকাল, মনুষ্য-মানসকে তারাই যথাসম্ভব ক্ষুদ্রতম পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে, তাকে বানিয়েছে কুসংস্কারের অবাধ ক্রীড়নক, তাকে করেছে চিরাচরিত নিয়মের ক্রীতদাস, হরণ করেছে তার সমস্ত কিছু মহিমা ও ঐতিহাসিক কর্মদ্যোতনা।”[৩]
এশীয় উৎপাদন-পদ্ধতি প্রত্যয়টির তাৎপর্য হলো উৎপাদন-শক্তি বিকশিত হয়ে উৎপাদন-সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটানাের প্রধান মার্কসীয় তত্ত্বের সঙ্গে এটি সঙ্গতি বজায় রাখে না। মার্কস প্রত্যক্ষ করেন যে এশীয় উৎপাদন-ব্যবস্থায় একই পদ্ধতি ওই সকল কৃষিজীবী ও কুটিরশিল্পী নিরন্তর একভাবে চালিয়ে যায়। সেগুলির বিকাশ ঘটলেও আবার একই জায়গায়, একই নামে ও প্রকারে গড়ে ওঠে। সেই কারণে মার্কস মনে করতেন যে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের প্রয়ােজনে এশীয় সমাজে বিপ্লব অপরিহার্য, কারণ তার মাধ্যমে সমাজের উৎপাদন-ব্যবস্থায় যে গতিশীল পরিবর্তন দেখা দেয় সেটি মার্কসীয় ইতিহাস-তত্ত্বকে কার্যকর করে তােলে।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৭।
২. অনুপ সাদি, মার্কসের প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র এবং বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি প্রসঙ্গে, ২৪ মার্চ ২০১৮, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, https://www.roddure.com/encyclopedia/marxist-glossary/bases-of-bangladeshi-despotism/
৩. কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসন, ১০ জুন ১৮৫৩, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বারো খণ্ডে, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৪২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।