বহুজাতিক আসামে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আস্ফালন প্রসঙ্গে

আসাম হচ্ছে বিস্তারবাদ বা সম্প্রসারণবাদী ভারতের সর্বশেষ খেলার ময়দান। এখন আসাম রাজ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী অসমীয়া এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা মিলেমিশে নিপীড়ন নির্যাতন চালাচ্ছে জনগণের উপর। ভারতীয় জনগণ, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শত্রু বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি আসামে ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস’ বা এনআরসি তৈরি করার নামে আসামে গণহত্যার ষড়যন্ত্র করছে। একইভাবে ভারতের জনগণের শত্রু আরেকটি পার্টি কংগ্রেস গত প্রায় সত্তর বছরে কয়েক লাখ জনগণকে হত্যা করেছে।

গত তিন হাজার বছর ধরে দিল্লি আর উত্তর ভারত মিলে বাংলাসহ পূর্বের দেশগুলোকে শোষণ করছে। ১৯৪৭ সালে দিল্লি ও বোম্বাইয়ের পুঁজিপতিরা দাঙ্গা লাগিয়ে বাংলাকে ভাগ করেছে। সাহায্য করেছিল কলকাতার কিছু শিল্পপতি। আসল কথা হচ্ছে পূর্বের দেশসমূহকে লুট করার জন্যেই পূর্বের দেশসমূহের জনগণকে বিভক্ত করা হয়েছে এবং শাসন করা হয়েছে “Divide and Rule Policy”র নীতি অনুসরণ করে।

গত শতক থেকেই এই পূর্বের দেশসমূহকে লুটের ব্যাপারে এখনকার বিজেপি এবং আগের কংগ্রেসের মধ্যে বিন্দুমাত্র ফারাক নেই। আর এই কাজে গত অর্ধ শতক ধরে সহায়তা করে চলেছে ভারতীয় জনগণের শত্রু সংশোধনবাদী ভুয়া কমিউনিস্টদের দুটি দল সিপিআই এবং সিপিএম। সেই ভাগ করো এবং শাসন করো নীতিতে কাজ করে এইবার আসামে সমস্যা তৈরি করেছে কংগ্রেস এবং বিজেপি।

পূর্বদেশ ঐতিহাসিক কাল হতেই প্রাকৃতিক সম্পদে বলিয়ান। এই সম্পদ লুটের জন্যই হাজার বছর ধরে পশ্চিমের পথ দিয়ে এসেছে লুটেরারা। লুট করে নিয়ে গেছে পূর্বদেশের জাতিসমূহের সম্পদ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বা তারও আগে থেকেই এই লুট চলছে। কখনো তা মহাভারত গঠনের নামে কখনো দক্ষিণ এশিয়া গঠনের নামে, কখনো সার্ক গঠনের নামে।

সুলতানী আমল থেকে বাংলাসহ পার্শ্ববর্তী সব অঞ্চল লুট হয়েছে দিল্লির দ্বারা। পূর্বদেশসমূহকে লুটের প্রক্রিয়ায় আফগান পাকিস্তানের সাম্রাজ্যমদমত্তরা পর্যন্ত জড়িয়েছে, সেই লুট একদা লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছেছে।

আরো পড়ুন:  আসামে বাঙালি বিতাড়নের মুষল পর্ব

আধুনিক আসামের ইতিহাস

মূল নিবন্ধ: আসামের ইতিহাস

আধুনিক আসামের ইতিহাস শুরু হয়েছে আসামে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিস্তারের পর থেকে। আসামে উপনিবেশিক যুগের সূচনা হয়েছিল ১৮২৬ সালে ইয়াণ্ডাবুর চুক্তির পরে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এবং ১৯৪৭ সালের পরে ব্রিটিশদের পরিবর্তে দিল্লির নয়া-উপনিবেশিক যুগে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে পূর্বদেশের একটি অংশের, মূলত কলকাতার পুঁজিপতিরা যোগ দিয়েছে দিল্লি সাম্রাজ্যের সাথে। বোম্বাই, দিল্লি আর করাচীর পুঁজিপতিরা দাঙ্গা বাঁধিয়ে পূর্বদেশকে লুট করার চক্রান্তে সেসময় সফল হয়েছে। এরপর বহুবার তারা বারবার পূর্বের দেশসমূহে দাঙ্গা লাগিয়েছে, অরুনাচল, আসাম ও মনিপুরে গণহত্যা চালিয়েছে।

সর্বশেষ দিল্লি আর পশ্চিমাদের চক্রান্ত সমস্যা তৈরি করেছে আসাম আর আরাকানে। আরাকানকে এখন লুট করছে সাংহাই, বেইজিং, কুনমিং, দিল্লি এবং রেঙ্গুনের পুঁজিপতিরা। আরাকানে রোহিংগাদের উপর চলমান গণহত্যায় নরেন মোদি যে লাফ মেরে এই গণহত্যাকে সাহায্য করতে রেঙ্গুন সফরে গিয়েছিল গত বছর তা নিপীড়িতরা নিশ্চয় ভোলেনি।[১]

আসামে নাগরিকপঞ্জি এবং বহুজাতিক আসাম

মূল নিবন্ধ: আসামে এনআরসি হচ্ছে জনগণকে দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করার ষড়যন্ত্র

আসামে “অসমিয়াদের সঙ্গে আছে প্রচুর বাঙালি, হিন্দিভাষী, বড়ো জনগোষ্ঠী, ডিমাসা-কার্বি-মিশিং-আহোম-মৈতৈ-মণিপুরি-বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি-মারা প্রভৃতি ক্ষুদ্র জনসমাজ।”[২] আসামে শুধু অহোম জাতির লোকই নেই, আছে বাঙালি। এছাড়াও আসামে আছে ভুটিয়া, আকা, দাফলা, আপা তানাঙ্গ, মিরি, আবর, মিশমি, খামতি, সিংফো, মিকিরি, নাগা, গারো, লুসাই, খাসিয়াসহ আরো অনেক জাতি।[৩] অর্থাৎ আধুনিককাল থেকেই একটি বহুজাতিক দেশ।

বহুজাতিক এই আসামে উগ্রজাতীয়তাবাদী মতাদর্শ প্রসার পেতে শুরু করে ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর আমলে। অসমীয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীরা দিল্লির বিরোধীতা বাদ দিয়ে দরিদ্র বাঙাল খেদাও আন্দোলন শুরু করে যার পরিণতিতে আসামে বিভিন্ন জাতির জনগণের মধ্যে বৈরিতা বাড়তে থাকে।

আসামে নিপীড়িত জনগণের উপর নির্যাতনের খতিয়ান

১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে মাত্র ছয় ঘণ্টায় আসামের নগাঁও জেলার ১৪টি গ্রামে ১০,০০০ মানুষ হত্যা করা হয়।[৪] বঙ্গাল খেদা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রায় ৫ লক্ষ বাঙালিকে আসাম থেকে খেদানো হয় যারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছেন।[৫] দিল্লির বিস্তারবাদের সমর্থক আসামের অনেকগুলো রাজনৈতিক সংগঠন। প্রধান সংগঠন হচ্ছে কংগ্রেস এবং বিজেপি, সাথে যুক্ত হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী মিথ্যাচারী উলফা। গত ২ নভেম্বর ২০১৮ পাঁচজন সাধারণ ক্ষমতাহীন মানুষকে হত্যা করেছে গণশত্রুরা।[৬] চেঁচাবেন শিলাদিত্য,[৭] আর খুন হবেন ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ, তা চলবে না। যে কোনো খুনি, তা উলফা বা কংগ্রেস বা বিজেপি যেই হোক না কেন, বিভীষণদের নিশ্চিহ্ন করেই আসামকে এগিয়ে যেতে হবে।

আরো পড়ুন:  ভারত ছাড় আন্দোলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে স্বাধীনতার দাবিতে সৃষ্ট বামপন্থীদের আন্দোলন

বাংলা আর আসামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৯৪৭ সালের দাঙ্গায় মারা গেছে লাখখানেক মানুষ, আসামের দাঙ্গায় অন্তত দশ হাজার। এখন যদি বিজেপি আসামে দাঙ্গা লাগাতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তাহলে আমাদের কথা হচ্ছে, মারা গেলে মানুষ মারা যাক গৃহযুদ্ধের ময়দানে, কিন্তু কোনো নিরীহ মানুষকে ১৯৪৬ বা ১৯৮৩’র সালের মতো কচুকাটা হতে দেয়া যাবে না।

আসাম এবং বাংলার সাথে যোগাযোগ আছে কয়েকশ বছর ধরে, যদিও সেসব নানা উত্থান পতন দ্বারা লিপিবদ্ধ। তবে ১৮৪২ সালে সমগ্র আসাম ব্রিটিশের অধীন আসে। পরে ১৮৭৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আসামকে বাংলা থেকে পৃথক করা হয়।[৮] আর ঐতিহাসিকভাবে এই ইতিহাস ভুলে যাওয়া চলবে না, ধুবড়ী, গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড়, বঙ্গাইগাঁও জেলা ১৮২৫ সাল পর্যন্ত ছিল পুরানো রংপুর জেলার অন্তর্গত। করিমগঞ্জ, কাছাড়, হাইলাকান্দি জেলা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিল সিলেটের অন্তর্গত।

আধিপত্যবাদী জাতিদম্ভী শাসকদের বিস্তারবাদী এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে চাই পূর্বদেশের নিপীড়িত সকল জাতি ও জনগণের নিবিড় ঐক্য। এই শোষণ এবং লুটের হিসাব পূর্বের দেশসমূহের জনগণের কড়ায় গণ্ডায় হিসাব মিটিয়ে নেয়া দরকার। পূর্বদেশের জনগণের উচিত পশ্চিমাদের এই অন্যায়কে বানচাল করে এগিয়ে যাওয়া। পূর্বদেশের নিপীড়িত জাতি ও জনগণ এক হও।

তথ্যসূত্র:

১. অমিতাভ ভট্টশালী, “মিয়ানমার সফরে নরেন্দ্র মোদী, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কি অবস্থান নেবে ভারত?”, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বিবিসি বাংলা, লিংক: https://www.bbc.com/bengali/news-41137584
২. তপোধীর ভট্টাচার্য, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮, “আসামে বাঙালি বিতাড়নের মুষল পর্ব”, দৈনিক প্রথম আলো, আন্তর্জাতিক পাতা, প্রিন্ট সংস্করণ। লিংক http://www.prothomalo.com/opinion/article/1401831/
৩. শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, আসামের ইতিহাস, পপুলার এজেন্সি, কলিকাতা, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ১৫১-১৬১।
৪. Genesis of nellie massacre and assam agitation, Indilens news team, Retrieved 10 November 2015. link:https://www.slideshare.net/umain30/genesis-of-nellie-massacre-and-assam-agitation
৫. Bhaumik, Subir (2008). Samir Kumar Das (ed.). Blisters on their Feet (PDF). Sage. p. 303. ISBN 978-81-7829-819-1. https://web.archive.org/web/20140305182014/http://203.128.31.71/articles/076193653X.pdf
৬.অমিতাভ ভট্টশালী, “ভারতের আসামে গুলি চালিয়ে পাঁচ বাঙালীকে হত্যা” ২ নভেম্বর ২০১৮, বিবিসি বাংলা, লিংক: https://www.bbc.com/bengali/news-46066566
৭. খবর, দেশ, ৩১ অক্টোবর ২০১৭, “অসমে হিন্দু বাঙালিরা নন, বাংলাদেশি মুসলমানরাই হুমকি : শিলাদিত্য”, দৈনিক যুগশঙ্খ, লিংক: https://www.tdnbangla.com/news/national/hindus-of-assam-are-not-bengali-bangladeshi-muslims-threat-says-shilaidatya/ শিলাদিত্য আসামের বিজেপির নরপিশাচ রাজনীতিবিদ ও গণহত্যাকারী।
৮. শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, আসামের ইতিহাস, পপুলার এজেন্সি, কলিকাতা, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ১৪৬।

আরো পড়ুন:  ভাঙায় কোন বাহাদুরী নাই --- সম্পাদকীয়, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১

1 thought on “বহুজাতিক আসামে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আস্ফালন প্রসঙ্গে”

  1. অধিপত্যবাদী এই জাতীয় মানসিকতা বাদ দিয়ে পাহাড় ও সমতলে শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে৷

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!