আলোকায়ন বা আলােকিত যুগ বা আলোকায়নের শতাব্দী (ইংরেজি: Enlightenment) হচ্ছে ইউরোপের ইতিহাসে ভাবজগতে প্রাধান্য বিস্তারকারী বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক আন্দোলন যা জ্ঞান- বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে উপনিবেশে গণহত্যা ও দখলদারিত্বের ফল বয়ে এনেছিল। ইউরােপের ইতিহাসে সপ্তদশ শতাব্দীতে আধুনিক বিজ্ঞানের উত্থানের পর্ব থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের প্রারম্ভকাল অবধি সময় সাধারণত আলোকায়ন হিসেবে অভিহিত।
শিক্ষা ও মননজীবনে, ধর্ম ও রাজনীতির ক্ষেত্রে দণ্ডমুণ্ডের অধিকারী ব্যক্তিদের প্রতি প্রচলিত অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে সংশয়, মুক্তবুদ্ধি ও বিচারশক্তির বিকাশ, যুক্তিশীলতার প্রসার এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা ছিল এই আলোকায়ন শতাব্দীর লক্ষণ।
সেই সময় এক একটি দেশের স্থানীয় ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী লক্ষণগুলি ফুটে ওঠে। ফ্রান্সে রুসাে, ভলতেয়ার, মতেসকিয়্য, জার্মানিতে কান্ট, ইংল্যান্ডে লক, পেন প্রমুখের রচনাদিতে শতাব্দীর বুদ্ধি বিভাসিত আন্দোলনের বাণী ঘােষিত হয়। বিভাসিত শতকের রাষ্ট্রচিন্তায় যে সব যুগান্তকারী তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে সেগুলি ছিল মূলত উদারতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ, বিশ্বজনীন এবং স্বেচ্ছাতন্ত্রবিরােধী এবং মুক্ত চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার সহায়ক। ফ্রান্সে বিভাসিত ভাবাদর্শের প্রসারকল্পে নানাধরনের বিদ্বৎসংস্থা, অকাদেমী, সাঁল, কাফে এবং বিস্তর পত্রপত্রিকা ও রাজনৈতিক প্রকাশনার বিস্তার ঘটে।
পুঁজিবাদের বিকাশ ও বুর্জোয়া শ্রেণীর উদয় আলােকিত শতাব্দীর এক মস্ত পরিচয়। প্রথমে ইংল্যান্ড ও পরে ফ্রান্সে বুর্জোয়াশ্রেণী প্রভাবিত বিদ্বজ্জনেরা জগৎপ্রকৃতি, সমাজ ও মানবিক অস্তিত্ব সম্পর্কে এক নতুন জীবনাদর্শ তুলে ধরেন যার মূল উপাদান হলো ইউরোপীয় মুক্ত মানুষের যথার্থ মর্যাদা এবং তাদেরই ঐহিক সুখ। বিজ্ঞানচেতনা পুষ্ট যুক্তি, স্বাধীন বােধ ও বুদ্ধির আলােকে নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মের পীড়ন থেকে মুক্তি উৎসারিত হয়। সেই আলোকিত যুগ যে জগত তৈরি করে তা গোটা দুনিয়াকে পরাধীন করে, দিকে দিকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ দেশগুলোকে ইউরোপীয়রা দখল করে, কোটি কোটি মানুষকে ইউরোপীয়রা হত্যা করে। আলোকায়নের আরেকদিকে বর্বরতার এক নতুন কাঠামো দানা বাঁধে যাকে পরবর্তী দার্শনিকেরা পুঁজিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
আঠারাে শতক জুড়ে বুদ্ধিবাদের যে অগ্রগতি ঘটে, তার ভাবভূমি অনেকাংশে প্রস্তুত করেছিল লক, রুসাে, দালমবেয়ার, প্রমুখ দার্শনিকদের রচনাদি এবং দিদেরাের বিশ্বকোষ। উল্লেখ্য যে সর্ববিধ মননশীলতায় একতা দেখা গেলেও সমগ্র আলােকিত শতাব্দীর দর্শন একটি অখণ্ড, অবিভাজ্য ও সুসংবদ্ধ তত্ত্ব হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করেনি। অন্তর্নিহিত যে সুরটি অনুরণিত হতো সেটা ছিল সম্পত্তিধারী ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা যা বুর্জোয়া শ্রেণির মুক্তির অনুকূল। জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেখানে উৎপীড়ন, অনাচার, বর্বরতা ও যুক্তিহীনতা ছিল প্রবল সে-সব পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেছিলেন ওইসব দার্শনিকেরা। তাঁদের অবদান হলো বুদ্ধি, পরমতে সহনশীলতা এবং মানবতার পথকে সুগম করে তােলা।
দ্র, শিল্পবিপ্লব
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।