সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে লেনিনবাদী বলশেভিক পার্টির ভূমিকা

সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ইউনিয়ন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রলেতারীয় একনায়কত্ব দ্বারা পরিচালিত প্রথম সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল ১৯২২ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯১ সালে ভেঙে যাবার আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে পরিচালিত বলশেভিক পার্টির, তৎকালীন নাম রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি, দ্বারা বাস্তবায়িত অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে। এই বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তাত্ত্বিক দর্শনের ভিত্তিতে প্রথম বাস্তব সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সৃষ্টি হয় ১৯১৮ সালে। ১৯১৮ হতে ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন।

১৮৯৮ সালে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং সে বছরকে পার্টি গঠনের বছর হিসেবে ধরা হয়। পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ১৯০৩ সালের ১৭ জুলাই লন্ডনে ৪৩ জন ডেলিগেটের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি জারের শীত প্রাসাদের সম্মুখে ১ লক্ষ ৪০ হাজার শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিলে জারের সিপাহিরা গুলি চালালে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হলো। কৃষক ও শ্রমিকদের মাঝে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসার হলও যা প্রথম রুশ বিপ্লব নামে পরিচিতি পেল। সে বছর ডিসেম্বরে বিদ্রোহ হলও এবং জারের স্বৈরতন্ত্র বিদ্রোহ দমন করল। ১৯০৫ সালের এপ্রিল মাসে লন্ডনে পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস বসে যাতে ২০টি বলশেভিক কমিটির ২৪ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হন। ১৯০৭ সালের মে মাসে লন্ডনে পঞ্চম পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ৩৩৬ জন ডেলিগেট এই কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯১৪ সালে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু হলে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পার্টিগুলো নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী সরকারের পক্ষে যোগ দিল। বিভিন্ন সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির মধ্যে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিলুপ্তি ঘটল। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলশেভিক পার্টির আহ্বানে পেত্রগ্রাদের শ্রমিকেরা একটি রাজনৈতিক সাধারণ ধর্মঘটের আয়োজন করে, তাতে যোগ দেয় দুই লক্ষের ওপর শ্রমিক নরনারী। এ ধর্মঘট হয়ে ওঠে এক পরাক্রান্ত রাজনৈতিক শোভাযাত্রায়। ‘স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হোক!’, ‘যুদ্ধ ধ্বংস হোক!’, ‘রুটি চাই!’ শ্লোগান নিয়ে শ্রমিকেরা পথে নামে। উত্থিত শ্রমিকদের সংগে যোগ দেয় সৈন্যরা, যুগের পর যুগ রাশিয়ার জনগণকে নিপীড়ন করে আসা স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটল। মার্চ মাসের ২ তারিখে বুর্জোয়াদের সাময়িক সরকার গঠিত হলও। আগের মতোই, কারখানাগুলোর মালিক থাকল পুঁজিপতিরা এবং গ্রামাঞ্চলে বড় বড় ভূস্বামী আর ধনী কৃষকদের নিপীড়ন চলতেই থাকল। সৈনিকেরা মরতেই থাকল ফ্রন্টে। ৪ এপ্রিল বলশেভিকদের সভায় লেনিন ‘বর্তমান বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতের কর্তব্য’ বলে একটি রিপোর্ট হাজির করেন। এই রিপোর্টটিকেই বলা হয় লেনিনের এপ্রিল থিসিস। নতুন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে পার্টির সঠিক নীতি নির্ধারণে এ থিসিসের ভূমিকা বিপুল। এই থিসিসে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের জন্য জমিন প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে সংগ্রামের প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা লেনিন হাজির করেন যাতে ক্ষমতা প্রলেতারিয়েত এবং প্রলেতারিয়েতের মিত্র কৃষকদের দরিদ্রতম অংশগুলোর হাতে যাবার কথা ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে লেনিন লিখলেন বলশেভিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে। ৭ অক্টোবর লেনিন পেত্রগ্রাদে ফিরে এলেন এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পক্ষে মত দিলেন। ৮ অক্টোবর তারিখে উত্তরাঞ্চলের সোভিয়েতগুলোর বিভাগীয় কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী বলশেভিকদের নিকট চিঠিতে লেনিন লিখলেন যে বলশেভিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে এবং অভ্যুত্থানের জন্য বাস্তব কর্মসূচি দিলেন। তিনি বললেন, “বিলম্ব হবে মৃত্যুর সমতুল্য।”

আরো পড়ুন:  ব্রেস্ত চুক্তি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত

১৬ অক্টোবর কালিনিনের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে দীর্ঘ আলোচনার পর সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পক্ষে সিদ্ধান্ত হলও। সিদ্ধান্তের পক্ষে ১৯ ভোট, বিপক্ষে ২ ভোট এবং ৪ জন ভোটদানে বিরত থাকলেন। কেন্দ্রীয় কমিটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির জন্য সকল সংগঠন, শ্রমিক ও সৈনিকদেরকে কার্যকরী ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালেন। আর লেনিন লৌহকঠিন উদ্যম ও অটুট বিশ্বাসে পার্টি বাহিনীগুলোকে সংহত করে তুললেন, তাদের প্রস্তুত করলেন যুদ্ধের জন্য। ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় লেনিন কেন্দ্রীয় কমিটির নিকট ঐতিহাসিক চিঠিতে লেনিন লিখলেন, “বিপ্লবীরা যেখানে আজই জয়লাভ করতে পারে, … সেখানে যদি তারা গড়িমসি করে তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেককিছুই হারাবার সম্ভাবনা, বস্তুত, সবকিছুই হারাবার সম্ভাবনা।” ২৫ অক্টোবর, নতুন তারিখ অনুযায়ী ৭ নভেম্বর, সকাল নাগাদ শীত প্রাসাদ ও পেত্রগ্রাদ সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর ছাড়া গোটা পেত্রগ্রাদ বিপ্লবী শ্রমিক সৈনিক ও নাবিকদের দখলে চলে এলো। সন্ধ্যায় শীত প্রাসাদে ঝটিকা আক্রমণে বুর্জোয়া ও জমিদারদের সরকারের শেষ ঘাঁটিটার পতন ঘটলো। সংক্ষেপে এই হচ্ছে বলশেভিকদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আসে ক্ষমতা সুসংহত করা এবং শান্তির প্রক্রিয়া চালানো। সোভিয়েত শক্তিকে সুসংহত করার জন্য পুরাতন বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে চুরমার করা এবং নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা প্রয়োজন ছিল। এছাড়া জাতিগত জাতিগত অত্যাচারের বিলোপ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ অধিকার উচ্ছেদ, সর্বপ্রকার আইনি ও বেআইনি পত্রিকা ও সংগঠনের দমন এবং বুর্জোয়া সংবিধানসভাকে ভেঙে দেয়া প্রয়োজন ছিল। দেশের জমিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করার পর সমস্ত বড় কারখানাকেও জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করার প্রয়োজন ছিল।

সবশেষে, যে যুদ্ধ সোভিয়েত শক্তিকে সুসংহত করার পথে সবচেয়ে বেশি বাধা সৃষ্টি করেছিল, সেই যুদ্ধেরও অবসান ঘটানো প্রয়োজন ছিল। ১৯১৭ সালের শেষভাগ হতে ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এই সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করা হলো। পার্টির সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলও এবং ব্রেস্ত-লিতভস্ক চুক্তি সম্পন্ন করা হলও। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে অক্টোবর বিপ্লব প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম করলো, বুর্জোয়া শ্রেণির কবল হতে উৎপাদনের উপকরণগুলো ছিনিয়ে নিল, পুঁজিবাদকে চূর্ণ করার পথে অগ্রপদক্ষেপ গ্রহণ করল, কলকারখানা ব্যাংক, জমি, রেলওয়ে, প্রভৃতিকে জনগণের সাধারণ সম্পত্তিতে পরিণত করল। ইতিহাসে প্রথম শ্রমিক ও কৃষকের মিলিত শাসনভার দিয়ে প্রলেতারিয়েতকে শাসকশ্রেণিতে পরিণত করল।

আরো পড়ুন:  কেজিবি ছিলো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা

১৯১৮ সাল হতে ১৯২০ সালের মধ্যে দেশে বিদেশিদের সামরিক হস্তক্ষেপ চলেছিল এবং গৃহযুদ্ধে বলশেভিক পার্টির দৃঢ় ভূমিকায় সকল বিদেশি আক্রমণ পরাজিত হলো। এই গৃহযুদ্ধ ও বিদেশি পুঁজিবাদের প্রথম সশস্ত্র আক্রমণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলও বলশেভিকদের নেতৃত্বে। গৃহযুদ্ধ ও বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের যুগে সোশ্যালিস্ট রেভলুশনারি, মেনশেভিক, নৈরাজ্যবাদী ও জাতীয়তাবাদীদের বিপর্যয় ঘটল এবং সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করল।

বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের সময় যুদ্ধ কমিউনিজম, পরবর্তীতে নয়া অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে অর্থনীতি প্রথমে রক্ষা পেল এবং পরে শক্তিশালী হতে থাকল। ১৯২০ সালে পুরো দেশে বিদ্যুতায়ন করার প্রক্রিয়া শুরু হলও। ১৯৩০ সালের ভেতরে ভারি শিল্প নিজ দেশের শক্তিতে দাঁড়াতে লাগল। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন গোটা দুনিয়াকে ফ্যাসিবাদের কবল হতে রক্ষা করল। দেশে দেশে নিপীড়িত জাতি ও জনগণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলল। মহামতি লেনিন ও স্তালিনের কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো যা একুশ শতকেও পৃথিবীর দেশে দেশে নিপীড়িত জনগণের চোখে এক অসীম প্রেরণার উৎস হিসেবে বিরাজমান।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক পুস্তক:

১. লেখার সময় সাহায্য নেয়া হয়েছে
(ক) সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা. লি. কলকাতা, ষোড়শ মুদ্রণ সেপ্টেম্বর, ২০১১;
(খ) এম. আর. চৌধুরী, মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের নয়_ সংশোধনবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের পতন, দি ডলফিন এন্টারপ্রাইজ, ঢাকা, ৩১ মার্চ, ১৯৯১; এবং
(গ) উৎপল দত্ত, প্রতিবিপ্লব, এম. সি. সরকার এন্ড সন্স প্রা. লি. কলকাতা, ভাদ্র ১৪০০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!