কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের জীবনে তত্ত্ব ও কর্ম সমান্তরালভাবে চলেছে। তত্ত্ব চর্চা ও বৈপ্লবিক ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপ ছিলো একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং সেগুলো পরস্পরকে সমৃদ্ধ করতো। ১৮৬৪ সালে ‘পুঁজি’র প্রথম খণ্ডের কাজ যখন শেষ হবার পথে, মার্কস তখন তাঁর কাজ থামিয়ে দিয়ে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করেন প্রথম আন্তর্জাতিক তথা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতি সংগঠনের কাজে। সেই বছর ট্রেড ইউনিয়ন নেতা জি. ওগডেন এবং ডব্লিউ. আর. ক্রেমার-এর উদ্যোগে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় দি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংমেনস এসোসিয়েশন। প্রথম আন্তর্জাতিকের সূচনা ঘটে একসারি দেশের শ্রমিক ও গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোর সভার মাধ্যমে এবং প্রথম সভাটি ২৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। এর কর্মসূচি ও সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নির্বাচিত এক সাময়িক কমিটির উপর। প্রায় আট বছর ধরে লন্ডনেই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিকের কেন্দ্র। কার্যকরী সমিতির সদস্য হন মোট ৩৪ জন। কার্ল মার্কস নেতা। তিনিই উদ্বোধনী ভাষণ দেন। বাকুনিন ছিলেন অন্যতম সংগঠক ও নেতা।
এই নতুন সংগঠনের সংবিধান ও প্রতিষ্ঠা ইশতেহার প্রণয়ন মার্কসের সামনে বিরাট জটিল ও দুরূহ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। সেসময় প্রলেতারিয়েতের নানা দলকে আকর্ষণ করে আন্তর্জাতিকের এক ব্যাপক গণসংগঠনে পরিণত করার দরকার ছিল। প্রলেতারিয় আন্দোলনের নানা লক্ষ্য পথকে এমনভাবে সূত্রায়িত করবার দরকার ছিল যাতে সেগুলো বিভিন্ন ধরনের গ্রুপের ধারাগুলোকে যৌথ কাজে সম্পৃক্ত করা যায়। সংবিধান রচনার সাথে মার্কস খেয়াল করেন যাতে কমিউনিজমের নীতিগুলো থেকে কোনো বিচ্যুতি না ঘটে এবং শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবশালী ক্ষুদে বুর্জোয়া উপাদানগুলো আন্তর্জাতিকে জোরদার হতে না পারে। প্রথম আন্তর্জাতিকের সংগঠন ও কাজের মুলে রাখা হয়েছিল তাঁর দ্বারা লিখিত সংবিধান ও ইশতেহার।
এই আন্তর্জাতিকে অংশ নিয়েছিল নানা সমাজতন্ত্রী অংশ, জার্মান সমাজ গণতন্ত্রী, ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, ওয়েনপন্থি, চার্টিস্ট, প্রুধোঁপন্থি, বাকুনিনপন্থি এমনকি পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি প্রভৃতি দেশের জাতীয়তাবাদীরাও। ইউরোপের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করাই ছিল এই আন্তর্জাতিকের লক্ষ্য। এটির পরিচালনার কাজ বাস্তবায়িত হতো সাধারণ পরিষদ দ্বারা। মার্কসের বিপুল দৈনন্দিন সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ব্যতীত আন্তর্জাতিকের প্রভাব গোটা দুনিয়ায় পড়তো না যা সেটি ফেলতে পেরেছিল। বছরের পর বছর তার নামযশ বাড়ছিল। আন্তর্জাতিকে এসে মিলেছিল অসংখ্য ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন।
১৮৬৯ সালে জার্মানিতে দেখা দেয় সমাজ-গণতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টি। সেই পার্টি ছিল প্রথম প্রলেতারিয়েতের পার্টি যা জাতীয় পরিসরে সংগঠিত হয়েছিল এবং ভিত্তিরূপে কমিউনিজমকে গ্রহণ করেছিল। সেটি ছিল মার্কস এবং এঙ্গেলসের শিক্ষার আরো একধাপ অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন একটি পৃষ্ঠা। এই আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছিল অন্যান্য দেশেও নানা গণপার্টি প্রতিষ্ঠার পথ ধরে। ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিকের লন্ডন সম্মেলনে এবং এক বছর পরে অনুষ্ঠিত হেগ কংগ্রেসে বিভিন্ন দেশে প্রলেতারিয় পার্টি গঠনের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটি মূল প্রশ্নে পরিণত হয়েছিল।
সেসময় আন্তর্জাতিকের কাজকর্মের পক্ষে পরিবেশের অবনতি ঘটছিল। শ্রমিক শ্রেণির ওপর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সর্বত্র আক্রমণ চালাচ্ছিল। বহু দেশে শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক দমন, বুর্জোয়া সংবাদ জগতে আন্তর্জাতিকের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে চলেছিল প্রবল কুৎসা। প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকের পক্ষে আর বৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। নানা প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দেবার ফলে ১৮৭৩ সালের শেষাশেষি নাগাদ বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিকের অস্তিত্বের অবসান ঘটে। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনকে মার্কস দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন জানান। এই বিষয়কে ঘিরে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বছরই ফিলাডেলফিয়াতে প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙে দেবার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম আন্তর্জাতিকের মোট সম্মেলন হয় সাতটি। ১৮৭২ সনে হেস সম্মেলনে বাকুনিনকে বহিষ্কার করা হয়। ১৮৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ভেঙে দেয়া হয়। এটির আন্তর্জাতিকের চরিত্র না ছিল পুরোপুরি কমিউনিস্ট, না ছিল পুরোপুরি সম-মতাবলম্বী। কমিউনিস্টদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের চেষ্টাই একমাত্র উল্লেখ্য।
প্রথম আন্তর্জাতিক ভাঙার পরে শ্রমিক আন্দোলনে উঠেছিল প্রত্যেক দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কর্তব্য। সাম্যবাদকে জীবনে বাস্তব রূপদানের ব্যাপারে প্রথম আন্তর্জাতিক এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের ভাবধারার প্রতি বিশ্বস্ততা, প্রলেতারিয়েতের ও তার শরিকদের সমস্ত শক্তির আন্তর্জাতিকতাবাদী একতা, পুরনো দুনিয়ার শাসকদের নির্যাতনমূলক রাজনীতির বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামে এই আন্তর্জাতিকের ভূমিকা চিরঞ্জীব।
সহায়ক গ্রন্থ:
১. সমীরণ মজুমদার, মার্কসবাদ, বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, ১ বৈশাখ, ১৪০২, পৃষ্ঠা ১০৩- ১০৪,
২. খারিস সাবিরভ, কমিউনিজম কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৮।
রচনাকালঃ জুলাই ১৩, ২০১৪
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।