নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা রপ্ত করা যায় না — ইন্দ্র মোহন সিগদেল

ইন্দ্র মোহন সিগদেল হচ্ছেন নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (বিপ্লবী মাওবাদী)র কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিটব্যুরো সদস্য। তিনি ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সালে নেপালের তানাহুন জেলার কিহুনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮১ সালে কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষ করে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (চতুর্থ কংগ্রেস)-এ একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে তিনি জেলা কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীকালে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একীকৃত কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)র পলিটব্যুরো সদস্য ছিলেন। তার সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে অনুপ সাদি ও দোলন প্রভা।

অনুপ সাদি: এবারের ২০১৭ সালের নির্বাচন সম্পর্কে আপনার এবং আপনার পার্টির, মোহন বৈদ্য কিরণ অংশের দৃষ্টিভঙ্গিটা কি?

ইন্দ্র মোহন সিগদেল: এই নির্বাচনে যে ফলাফল এসেছে, এটাকে বলা যায় প্রতিক্রান্তি বা প্রতিবিপ্লব বা কাউন্টার রেভুলেশন। এই প্রতিবিপ্লব দিয়ে নির্বাচনটাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত যে সংবিধানটা বানালো সে সংবিধানটা ছিলো প্রতিবিপ্লবী সংবিধান ছিলো, গণসংবিধান ছিলো না; জনগণের সংবিধান ছিলো না সেটা। সে সংবিধানের যে জিনিসটাকে সাংবিধানিকভাবে এগিয়ে নিয়ে আসলো, সেটা একটা প্রতিবিপ্লবের নির্বাচন। আর পরের কথাটা হচ্ছে, মাওবাদিরা ১০ বছরের গণযুদ্ধের জায়গা থেকে এসেছিলো; যে বিপ্লবের ব্যানারটা বিশ্বকে দেখানো হয়েছিলো; সেটাতে নেপালের ও বিশ্বের নিপীড়িত জনগণ বেশি কিছু আশা করেছিলো; জনগণের ধারণা ছিলো বিপ্লবকে তাঁরা আরও এগিয়ে যাবে; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তাঁরা বিপ্লবী অবস্থানকে ছেড়ে দিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থায় যাচ্ছে। শুধু তাই নয় তাঁরা এমালের (UML)এর সাথে মাওবাদী কেন্দ্র (CPN – মাকে) পার্টি ঐক্য করতে চেয়েছে। সেটা কি? এমালে কি  বিপ্লবী হয়েছে বা মাকে কি প্রতিবিপ্লবী হয়েছে? আগে মাকেরা বলত এমালে একটা কাউন্টার রেভলুশনারি বা প্রতিক্রিয়াশীল দল কিন্তু এখন মাকে মনে করে তাঁরা বিপ্লবী হয়ে গিয়েছে ও তাঁরা একসঙ্গে বিপ্লব করবে।

সে হিসেবে এটা হচ্ছেঃ এমালে বিপ্লবী হয় নি, মাকেরা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গিয়েছে; সেকারণে তাঁরা ঐক্য করার চিন্তা করছে। নেপালে বিপ্লবের একটা অবস্থান ছিলো যদিও এখন প্রতিক্রিয়াশীলরা বিজয়ী হয়েছে। আগে একটা দ্বিধার মধ্যে ছিলো কি হবে কি হবে না? কারণ মাওবাদিদের সাথের জনগণের একটা বিশ্বাস ছিলও যে এরা কিছু করবে। কিন্তু এখন মাওবাদি কেন্দ্র ও এমালে যখন এক হওয়ার কথা উঠল তখন সেটা প্রতিক্রিয়াশীল দিকে চলে গেলো। তবে জনগণ এখনও তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বিষয়টাকে বেশি ভাবে বুঝেনি, যদি তা বুঝত তাহলে জনগণের মত তাদের দিকে এতো বেশি যেতো না।

আরো পড়ুন:  সিপিবির জাতীয়তাবাদ অভিমুখি বিচ্যুতিটি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির সংগে বিশ্বাসঘাতকতা

তাঁরা কিছু কথা বলে এগিয়ে আছে তাহলো, তাঁরা বলছে তাদের স্থিতিশীল সরকার (Stable Government) দেবে। নেপালে এর আগে এতো বেশি সরকার পরিবর্তন হয়েছে সেই সরকারের স্থায়িত্ব ছিলো আট মাস নয় মাস দশ মাস সময়ে সরকার বদল হয়েছে। তাই এ দল বলেছে তাঁরা স্থায়ি সরকার দিবে _ এই কথা বলে জনগণকে অনেকটা আকর্ষণ করেছে। এছাড়া পুরনো দল নেপালী কংগ্রেস তারা অনেক সময় পেয়েছিলো সরকার থেকে কাজ করার কিন্তু তারাও সে সমস্যার সমাধান করতে পারে নি।  নেপালী কংগ্রেসের ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়ার ফল হিসাবে মাকে ও এমালের বিজয়।

অনুপ সাদি: নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (বিপ্লবী মাওবাদি) UCPN-M অর্থাৎ আপনাদের দল ভবিষতে কি করবে?

ইন্দ্র মোহন সিগদেল: এবারের নির্বাচনে আমাদের দল অংশ গ্রহণ করেছিলো। তবে সেটা দলের নামে না একটি যুক্তফ্রন্ট তৈরি করে তার নামে। দল তাতে সমর্থন জানিয়েছিলো। তবে এবারের দেখা গিয়েছে দাম দাম দণ্ড ভেদ মানে টাকা পয়সা প্রচুর খরচ হয়েছে। এই নির্বাচনে অর্থ প্রচুর খরচ হয়েছে সেই সাথে গুণ্ডাগিরি ও অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এইসব মিলে আসল নির্বাচন হয় নি। যেমন এবারের নির্বাচনে অনেক জায়গায় প্রতিনিধি হয়েছিলো গুণ্ডা, ব্যাপারী, কন্টাকটার অর্থাৎ যাদের কাছে টাকা পয়সা বেশি আছে, তারাই বিজয়ী হয়েছে।  

আমরা বলতে চাই, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা রপ্ত করা যায় না, সেটার জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন; সেটা জানানোর জন্য আমরা এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। এজন্য আমাদের দলের যতটুকু শক্তি ছিলও, সেটাকে কাজে লাগিয়ে জনগণের কাছে গিয়েছি। আমরা মনে করি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে আমরা সেটাকে ব্যবহার করতে পেরেছি। আমরা মনে করি, নির্বাচন হচ্ছে ট্যাকটিকাল প্রসঙ্গ, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নয়। আমরা কখনো এটাতে অংশগ্রহণ করতে পারি আবার কখনো বয়কট করতে পারি। পূর্বে আমরা বয়কট করেছিলাম এবার অংশগ্রহণ করেছি। এই নির্বাচন তো শেষ হয়ে গিয়েছে এটা তো দেশকে কোনো অগ্রগতি দিতে পারে না সেটা সবাই জানে। এটাকে আমরা বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য, এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কাজে লাগাতে পারি। বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য এই নির্বাচন আমরা কাজে লাগাই।

আরো পড়ুন:  স্টাটগার্ট আন্তর্জাতিক সোসালিস্ট কংগ্রেস থেকে

অনুপ সাদি: এবারের নির্বাচনের আগে নেত্র বিক্রম চাঁদের অংশের হাজারখানেক নেতা এবং কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ইন্দ্র মোহন সিগদেল: তাঁদের দলকে আমরা (mlm) মার্কসবাদী লেনিনবাদী মাওবাদি পার্টি বলেই মনে করি। সেটা আসলে বিপ্লবী পার্টি। যদিও তাঁরা আলাদা দল আমরা আলাদা দল। আগে আমরা এক সাথেই ছিলাম তাঁরা এখন আলাদা দল করেছে। তবে তাঁরা এবার নির্বাচনকে বয়কট করেছে, আমরা এবার অংশগ্রহণ করেছি। এরপরও তাঁদের পার্টি বিপ্লবী আছে আমরা মনে করি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, বা বয়কট করা_ সেটা রাজনৈতিক কাজ। বিপ্লবের মতামত, নির্বাচনের পক্ষে বা বিপক্ষে মত দেওয়া সেটা যে কোনো পার্টির অধিকার। নির্বাচনকে বয়কট করার ফলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে সরকার ঠিক করে নি।

অনুপ সাদি: নেত্র বিক্রম চাঁদ অংশ কখনো কি আপনাদের সাথে ঐক্য কারা কথা বলে বা এ ধরনের কোনো আলোচনা আছে?

ইন্দ্র মোহন সিগদেল: জী, ঐক্যের সম্ভাবনা আমরা দেখি আর ঐক্য করার চেষ্টাও আমরা চালাব। কেননা এখন প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর একটা ঐক্যের হাওয়া চলছে যদিও তারা নিজেদের বিপ্লবী বলে। ফলে জনগণের ভেতরে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, জনগণ ভাবছে বামরা এক জায়গায় আসছে_ এটা ভাল। এটাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে, শ্রেণিসংগ্রাম দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে, বিপ্লবের কাজকে এগিয়ে নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। তার জন্য যারা বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থা বিরোধী শক্তি আছে, যেসব কমিউনিস্ট পার্টি আছে, তাঁদের সাথে ঐক্য করাটা এখন আমাদের দলের তাৎক্ষনিক জরুরী কাজ।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচনটাকে কীভাবে দেখা উচিত? এই নির্বাচন কি কোনো গণতান্ত্রিক অগ্রগতি আনবে?

ইন্দ্র মোহন সিগদেল: এমালে আগে থেকেই একটা প্রতিক্রিয়াশীল দল ছিলো। এমালে প্রতিক্রিয়াশীল দল ছিলো বলেই মাওবাদীরা গণযুদ্ধে গিয়েছিলো, কিন্তু এমালের সঙ্গে মাওবাদীদের ঐক্য হয়ে গেছে, এই নির্বাচনে তাঁরা বিজয়ে হয়েছে কিন্তু এ বিজয় থেকে জনগণ কিছুই পাবে না। … … এটার ফলে কোনো গণতান্ত্রিক অগ্রগতি হবে না। যে সংসদীয় ব্যবস্থা বর্তমান আছে সেটাকেই তারা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের যে নীতি আছে নব্য-উদারবাদ, তাকেই তারা এখানে প্রয়োগ করবে। ফলে এরা জনগণের পক্ষে কাজ করতে পারবে না। যে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা আছে, এই নির্বাচনে বিজয় তারই অংশ।

আরো পড়ুন:  গণউদ্যোগ বা জনপ্রিয় উদ্যোগ বা নাগরিক উদ্যোগ কাকে বলে

দোলন প্রভা: বাংলাদেশে সিপিবি এবং বাসদ বলছে যে নেপালে সমাজতন্ত্র হবে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে। বাস্তবে কোনো অর্থনৈতিক উন্নতি হবে কিনা?

ইন্দ্র মোহন সিগদেল: তারা বলছে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, কিন্তু সেটা আসলে মিথ্যা কথা। বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় যারা সরকারে আসছে, তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব না, সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করা বিলকুল অসম্ভব। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও স্বাধীনতা হিসেবে, কোনো হিসেবেই তারা কোনো ভাল কাজ করতে পারবে না। 

Leave a Comment

error: Content is protected !!