জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা

জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা বা অমৃতসর গণহত্যা (ইংরেজি: Jallianwala Bagh massacre) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ সনে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সামরিক অধিনায়ক নরপিশাচ জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি বন্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা বা অমৃতসর গণহত্যা নামে বিখ্যাত। জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে এ ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড বলেও পরিচিত।

তখন ভারতবর্ষ বর্বর ইংরেজ শাসনের অধীনে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকেই ভারতের উদীয়মান ধনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খা জাগরিত হতে থাকে। এই আকাঙ্খার সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায়। গোড়ার দিকে এ প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল ইংরেজ শাসনাধীনে ন্যায়বিচার এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ। কিন্তু ইংরেজ শাসনের তরফ থেকে, এ দাবির কোনো পূরণ ঘটে না। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শত্রু বর্বর নরপিশাচ ইংরেজ শাসকেরা বলতে থাকে, ভারতবর্ষ অনুন্নত দেশ। ভারতবর্ষের মানুষ স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার উপযুক্ত নয়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের নিজস্ব প্রয়োজনে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাপর ঘটনার প্রভাবে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে এবং দেশবাসীর চেতনায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে বৃহৎ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র রেলপথ স্থাপিত হতে থাকে। টেলিগ্রাফ তারও বসানো হয়। কিছু কিছু শিল্প কারখানা স্থাপিত হতে থাকে। বিশেষ করে কাপড়ের কলের স্থাপনা ও বিস্তার ঘটে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনার প্রভাবও ভারতবাসীর চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করতে থাকে। ১৯০৫ সালে একদিকে রাশিয়ার মতো বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তি ক্ষুদ্র জাপানের মতো এশিয়া শক্তির নিকট রুশ-জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়। অপরদিকে রাশিয়ার ভেতরে নির্যাতিত জনসাধারণ সামন্ততান্ত্রিক জার সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লাবাত্মক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব পর্যদুস্ত হলেও পৃথিবীর পরাধীন জাতি এবং নির্যাতিত মানুষের উপর এর প্রভাব কম ছিল না।

সেই সময় পুঁজিবাদী দুনিয়ার অর্থনৈতিক সংকটও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৃহৎ বৃহৎ ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মধ্যে এশিয়া-আফ্রিকার অনুন্নত দেশকে দখল করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেবার নতুন প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ শুরু হয়। এরই ফলে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়। জার্মানির বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ড এই যুদ্ধে জড়িত হয়। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের জন্য ভারতীয়দের সৈন্যবাহিনীতে গ্রহণ করার জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়। পরাধীন ভারতবাসীর মনের সন্দেহ এবং অনিচ্ছা দূর করার জন্য ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে যে, এই যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে সকল জাতির শৃঙ্খলমুক্তি এবং স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান। এরূপ ঘোষণায় বিশ্বাস করে ভারতবাসীরাও যুদ্ধে যোগদান করতে থাকে। অবিভক্ত ভারতের গণশত্রু মোহনদাস গান্ধী এই সময়ে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতে তাঁর কর্মস্থল স্থাপন করে। তাঁরই উদ্যোগে প্রচুর সংখ্যক ভারতাবাসী সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের মরণ ডেকে আনে।

আরো পড়ুন:  বিস্তারবাদ বা সম্প্রসারণবাদ গঠিত হয় রাষ্ট্রের নীতিগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে

কিন্তু ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হলেও ভারতবাসী ইংরেজদের শাসনের নীতিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পায় না। যারা যুদ্ধে যোগদান করেছিল তাদেরকেও সৈন্যবাহিনী ভেঙ্গে বেকার করে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধশেষের মন্দা অর্থনীতিতে আঘাত করে। বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুর্ভিক্ষাবস্থা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা-মহামারীতে এককোটির অধিক মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভারতবাসীর মনে সন্দেহ এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমন অবস্থায় ইংরেজ সরকার একদিকে যেমন মণ্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার বলে কিছু সীমাবদ্ধ শাসন সংস্কারের ঘোষণা করে তেমনি অপরদিকে রাওলাট বিল পাশ করে ইংরেজবিরোধী সকল রকম বিক্ষোভ ও প্রতিবাদকে নির্মমভাবে দমন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাওলাট আইনের অধীনে বিনা কারণে গ্রেপ্তার, অন্তরীন এবং সংক্ষিপ্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণহীন বিচার ও বন্দিত্বের বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

এরূপ অবস্থায় ভারতশত্রু গান্ধী সত্যাগ্রহ বা অহিংস পন্থায় এই দমনমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদের কথা ঘোষণা করেন। ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে পাঞ্জাবে যাওয়ার পথে গান্ধীকে গ্রেপ্তার হয়। এর প্রতিবাদে আহমেদাবাদের শিল্পশ্রমিক এবং পাঞ্চাবের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ধর্মঘট এবং বিক্ষোভের নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। সরকার গান্ধীকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তথাপি বিক্ষোভ ক্ষান্ত হয় না। এই বিক্ষোভ প্রধানত পশ্চিম ভারত এবং পাঞ্জাবে কেন্দ্রীভূত ছিল। ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে সরকারি দপ্তর এবং যানবাহন আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। শ্বেতকর্মের ইউরোপীয় অফিসার ও অধিবাসীও জনতার ক্রোধের পাত্র হয়ে উঠে। তারাও আক্রান্ত হতে থাকে।

১৩ এপ্রিল দুজন রাজনীতিক নেতাকে অমৃতসরে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে জনতা সামরিক ছাউনি লক্ষ্য করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। ছত্রভঙ্গ জনতা শহরে ঢুকে রেলওয়ে স্টেশন ও দুটি ব্যাঙ্ক আক্রমণ করে ভষ্মীভূত করে। চারজন ইউরোপীয় অধিবাসী জনতার আক্রমণে নিহত হয়। একজন মহিলা মিশনারী নিখোঁজ হয়। সাময়িক ছাউনির ইংরেজ অধিনায়ক জেনারেল ডায়ার ক্ষিপ্ত হয়ে শহরে সবরকম জনজমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি উদ্যানে বেশ কিছু লোক সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে জমায়েত হয়। উদ্যানটির মাত্র একটি নিষ্ক্রমণ পথ ছিল।

আরো পড়ুন:  খোকা রায় ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী যুগান্তর দলের সদস্য, সাম্যবাদী নেতা এবং বাঙালি বিপ্লবী

জেনারেল ডায়ার এই জমায়েতের সংবাদ পেয়ে একদল গুর্খা এবং বালুচ বাহিনী এবং সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে উদ্যানের মুখে হাজির হন। তাঁর হুকুমে উদ্যানের মুখ সাঁজোয়া গাড়ি দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তারপর কোনোরকম হুঁশিয়ারী না দিয়ে সমবেত নিরস্ত্র জনতার উপর বিরামহীনভাবে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সর্বমোট ১৬০৫ রাউণ্ড গুলি বর্ষিত হয়েছিল। উদ্যানটি জনতায় পূর্ণ ছিল। হতচকিত প্রাণরক্ষার জন্য পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পালায়নের কোনো পথ ছিল না। নিজেদের প্রাণরক্ষার চেষ্টায় হুড়োহুড়িতে এবং অবিরাম গুলিবর্ষণে চার শতাধিক লোক ঐ স্থানে নিহত হয়। সরকারী হিসাব সাধারণত কমের দিকে থাকে। সরকারি হিসাব মতে ৩৭৯ জন নিহত এবং ১২০০ জন আহত হয়। ডায়ারের এই চণ্ডনীতি পাঞ্জাব সরকার সমর্থন করে।

১৫ এপ্রিল পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করা হয়। এই সময় অমৃতসর এবং পাঞ্জাবের অীধবাসীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। যে স্থান থেকে ইংরেজ মহিলাযাত্রী নিখোঁজ হয়েছিল সে স্থানে সকল মানুষকে চার হাত পায়ে পশুর মতো হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হয়। সান্ধ্য আইনের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম, ইংরেজ সামরিক অফিসারকে হাত তুলে সালাম না জানানো ইত্যাদি অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের দণ্ড দেওয়া হতে থাকে। দেশব্যাপী প্রতিরোধের ঝড় ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতিপূর্বে ইংরেজ সরকারের নিকট থেকে যে ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন সে খেতাব একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে তিনি বর্জন করেন। দেশব্যাপী প্রতিবাদের ফলে সরকার যদিও ‘হাণ্টার কমিশন’ নামে তদন্ত কমিশন এই ঘটনার উপর নিযুক্ত করেছিলেন এবং তদন্ত কমিশনের সাধারণ সমালোচনামূলক রিপোর্টের ভিত্তিতে জেনারেল ডায়ারকে দ্বায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয় তথাপি কমিশনের নিকট ডায়ারের সদম্ভ উক্তিই যে ইংরেজ সরকারের মনোভাব প্রকাশ করেছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না।

নরপিশাচ জেনারেল ডায়ার নির্দ্বিদায় বলেছিলো, “আমি যখন গুলিবর্ষণ শুরু করি তখন বিরামহীন ভাবেই করি। জনতা ছত্রভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত আমি গুলিবর্ষণ থেকে বিরত হইনি। কারণ আমার মতে এই পরিমাণ ছিল ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ। আমার হাতে সেদিন যদি সৈন্য অধিকতর থাকত হা হলে নিহত ও আহতদের সংখ্যা অবশ্যই অধিকতর হতো। কারণ, কেবল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা নয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রয়োজন ছিল উপস্থিত এবং অনুপস্থিত পাঞ্জাবের সকলের মনে উপযুক্ত বাধ্যতাবোধ সৃষ্টি করা।”

আরো পড়ুন:  মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী নেতা

ঐতিহাসিকগণ মনে করেন ১৯১৯ সারের অমৃতসর হত্যাকাণ্ড তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মাত্র তুলনীয়। এই সময় থেকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি পরিকর্তন সংঘটিত হয়। এখন থেকে ভারতবাসীর স্বাধীনতা আন্দোলন আপসহীনতার পথ গ্রহণ করতে থাকে। বলা চলে, জেনারেল ডায়ার সেদিন তার কামানের গর্জনে কেবল ইংরেজ বর্বরতাই ঘোষণা করেন নি, তিনি ভারতে ইংরেজ শাসনের অন্তিম কালেরও ঘোষণা করেছিলেন।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৪৯-৫২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!