জাপান এশিয়ার উন্নত পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শোষণমূলক গণনিপিড়ক রাষ্ট্র

জাপান প্রাচ্যের উন্নততর পুঁজিবাদী দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে জাপানের অর্থনীতি বহু বছর পিছিয়ে পড়ে এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের উৎপাদনে তার অংশভাগ প্রায় চার গুণ হ্রাস পায়। অতঃপর জাপানের অর্থনীতিতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয় এবং শিল্পোৎপাদনের হারে সে সকল পুঁজিবাদী দেশকে অতিক্রম করে যায়। ১৯৬৯ সালে মোট জাতীয় উৎপাদের পরিমাণের দিক থেকে সে পুঁজিবাদী বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এবং শুধু পশ্চিম জার্মানিকেই নয়, সুইডেন, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালিকেও হটিয়ে দেয়।

একটি উন্নত পুঁজিবাদী দেশ হিসাবে জাপান বিশ্বে লৌহ, ইস্পাত, প্লাস্টিক, নাইট্রজেন সার, কৃত্রিম আঁশ ও রবার, বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, মোটরগাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, কাপড়-কাচা কল, সিনেমা ও ফোটো ক্যামেরা উৎপাদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। জাহাজ নির্মাণ ও রেডিও উৎপাদনে সে পৃথিবীর অগ্রগণ্য দেশ৷ বহ, দেশেই জাপানী পণ্য বিক্রি হচ্ছে এবং সেখানে বর্ধমান মাত্রায় জাপানী পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটছে।

অন্যান্য প্রধান পুঁজিবাদী দেশের সঙ্গে জাপানের একটি পার্থক্য রয়েছে। সে খনিজ সম্পদে খুবই দরিদ্র এবং প্রধানত আমদানিকৃত কাঁচামাল ও জ্বালানি উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় শুধু অর্থনীতির পুনর্গঠনই নয়, কিভাবে তার পক্ষে বিকাশের এত উচ্চস্তরে পেছনে সম্ভব হলো ?

যুদ্ধের পরপরই জাপানকে তার সামরিক খরচা দ্রুত হ্রাস করতে হয়। এতে অর্থনীতিতে সুফল ফলে : সে শিল্পসংস্থাগুলিকে পুনরায় সুসজ্জিত করার সঙ্গে সঙ্গে অধুনাতম প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং যুদ্ধোত্তর কালীন জাপানের দ্রুত অথনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই অনুষঙ্গটি খুবই সহায়ক হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে শিল্পদ্রব্যাদির জন্য মার্কিনী ফরমাশের ব্যাপারটি সবিশেষ উল্লেখ্য। কেবল আক্রমণাত্মক কোরীয় যুদ্ধকালেই এসব সরবরাহ থেকে জাপানের একচেটিয়ারা বিপুল মুনাফা অর্জন করে।

জাপান বিপুল জনশক্তির অধিকারী। তার ১২ কোটির বেশি মানুষ অর্থনীতির সকল শাখার উপযোগী সুশিক্ষিত কর্মীর একটি প্রধান উৎসস্থল। দেশে সামন্তবাদের জেরগুলির অবসানসুচক কৃষিসংস্কারের ফলেও জাপানের শিল্পোন্নয়ন দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

এক্ষেত্রে জাপানের শাসকচক্রের অনুসত সামাজিক কৌশলের সক্ষম পদ্ধতির ভূমিকাটিও গুরুত্বপূর্ণ। বুর্জোয়ারা শ্রমিক শ্রেণীকে কিছু কিছু সুবিধা দেয়, তাকে মুনাফার নানাধরনের ‘শরিক’ করে এবং এসঙ্গে মেহনতিদের শোষণ তীব্রতর করে তোলে। একজন জাপানী শ্রমিক আজও মার্কিন শ্রমিকের মাত্র এক-ষষ্টমাংশ মজুরি পায়। নারী-পুরুষ এবং বয়স ভেদেও মজুরির বিরাট পার্থক্য রয়েছে। নারীকর্মীর বেতন সেখানে পুরুষের অর্ধেক, অথচ দেশে ভাড়াটে শ্রমিকের এক-তৃতীয়াংশই নারী। একই কাজে বয়স্কদের চেয়ে তরুণ কর্মীদের বেতন ৫০-৬০ ভাগ কম।

আরো পড়ুন:  এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি হচ্ছে কৃষিভূমিতে সামাজিকতার ফলস্বরূপ সমাজে বিরাজিত নিশ্চলতা

সর্বশেষে বহুসংখ্যক ছোট ও মাঝারি সংস্থা একচেটিয়াদের ফরমাশ অনুসারে কাজ করে এবং সেগুলিতে মোট শ্রমিকের প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মরত আছে ও তারা মারাত্মকভাবে শোষিত হচ্ছে। এইসব কারণে জাপানী একচেটিয়ারা বিপুল মুনাফা লুটে ও উৎপাদন বাড়াতে পারে।

অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদন খরচা এবং তৈরী পণ্যের অত্যুচ্চ মানের প্রেক্ষিতে জাপান বর্ধমান সামর্থ্যের সঙ্গে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

জাপানের বৃহদায়তন আধুনিক শিল্পই তার অর্থনীতির বুনিয়াদ। তার শিল্পোৎপাদের মূল্য কৃষিজাত সামগ্রীর প্রায় পাঁচ গুণ। জাপানের শিল্প থেকে জাতীয় উৎপাদের প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপন্ন হয়ে থাকে।

জাপানী শিল্পে একচেটিয়ারা তাদের মুখ্য অবস্থান পুনপ্রতিষ্ঠিত ও সংহত করেছে। পৃথিবীর এক শ বৃহৎ একচেটিয়া সংস্থার ১০টিই জাপানী। এদের মধ্যে মিৎসুই, মিৎসুবিসি ও সুমিতমোর ফিনান্সিয়াল একচেটিয়া দলগুলিই বৃহত্তম। এদের প্রত্যেকের লগ্নির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারের বেশি।

উৎপাদন ঘনীভবন ও পুঁজি কেন্দ্রীকরণের সঙ্গে জাপানী শিল্পের কাঠামোগত পরিবর্তনও ঘটেছে। মানুফ্যাকচারিং শাখা, বিশেষভাবে ভারী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অংশভাগ সেখানে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মিকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েরও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু অন্যান্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশের তুলনায় জাপানের শিল্পোৎপাদনে এর অংশভাগ আজও উল্লেখযোগ্য নয়।

জাপানী যন্ত্রনির্মাণ শিল্পের বহু শাখার মধ্যে জাহাজনির্মাণই প্রধান। জলে ভাসানো জাহাজের সামর্থের হিসাবে (বছরে রেজিস্ট্রিকৃত মোট প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ টন) জাপান অন্যান্য সকল দেশের মোট উৎপাদনের বেশি জাহাজ তৈরি করে।

জাপানের জাহাজনির্মাণ শিল্প পৃথিবীর বৃহত্তম সুপারট্যাঙ্কার ও আত্যন্তিক কার্যকর অন্যান্য জাহাজ তৈরিতে বিশেষীকৃত হচ্ছে। জাহাজনির্মাণ শিল্পের মোট সামর্থ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মিৎসুবিসি নিয়ন্ত্রিত। ওসাকা-কোবে, নাগাসাকি, টোকিও-ইয়োকোহামায়ই বৃহত্তম শিপইয়ার্ডগুলি অবস্থিত।

জাপানের বিদ্যুৎ-ইঞ্জিনিয়রিং ও ইলেকট্রনিক পণ্য এবং প্রিসিসন যন্ত্রনির্মাণ শিল্পের চাহিদা বিশ্ববাজারে অত্যধিক।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশের বর্ধমান সামরিকীকরণের প্রেক্ষিতে জাপান এখন তার বিমানশিল্পকে কৃৎকৌশলগত দিক থেকে পনেসজ্জিত করার সঙ্গে সঙ্গে রকেট উৎপাদন শুরু করেছে। পারমাণবিক অস্ত্রনির্মাণে ব্যবহার্য প্লটোনিয়ামের উৎপাদনও সেখানে সংগঠিত হচ্ছে।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশ পুঁজিবাদ অনুসারী সাম্রাজ্যবাদ পীড়িত শোষণমূলক নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র

লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদন জাপানের ভারী শিল্পের অন্যতম প্রধান শাখা। আমদানিকৃত কাঁচামালের সাহায্যে সে এখন বছরে প্রায় ১১ কোটি টন ইস্পাত উৎপাদন করছে। অঙ্কটি ব্রিটেনের উৎপাদনের পাঁচ গুণ। তার প্রাচীনতম তাম্রশিল্প এবং নবতম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প উভয়েরই বিকাশ ঘটছে। সীসা, দস্তা, নিকেল ও অন্যান্য লৌহেতর ধাতুর উৎপাদনও জাপানে বাড়ছে।

তৈলশোধন, তৈল-রাসায়নিক এবং বহুলাংশে বিদ্যুৎ শিল্প আমদানিকৃত তৈল ব্যবহার করে। তার শোধনাগারগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্য প্রাচ্য ও বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকে আমদানিকৃত ২৬ কোটি টন পর্যন্ত অশোধিত তৈল শোধন করতে পারে। তৈলশোধনের উপজাত থেকে জাপান প্লাস্টিক, রাসায়নিক আঁশ, কৃত্রিম রবার ও আকরিক সার তৈরি করে। জাপানে বার্ষিক উৎপন্ন মোট বিদ্যুতের দুই-তৃতীয়াংশ তাপশক্তি স্টেশনে ও অবশিষ্ট জলবিদ্যুৎ স্টেশনে উৎপন্ন হয়। সে এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্টেশনও নির্মাণ করছে।

ভারী শিল্পের তুলনায় দেশের হালকা ও খাদ্য শিল্পের উৎপাদন মন্থর গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাপানের ঐতিহ্যবাহী মৎস্যশিপ কতৃক দেশের জন্য সংগৃহীত ১ কোটি টন মাছ এবং ভাত দিয়েই দেশের জনগণ তাদের মল খাদ্যচাহিদা মেটায়।

কৃষিসংস্কারের ফলে পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথবতী জাপানের কৃষি এখন ব্যাপকভাবে আধুনিক কৃষিযন্ত্রপাতি ও সার ব্যবহার শুরু করেছে। কৃষির প্রধান শাখা হিসাবে ধান (বার্ষিক উৎপাদন ১৩ কোটি টন) ও শাকসঞ্জি উৎপাদনে বিশেষীকৃত। দক্ষিণের দ্বীপগুলিতে ব্যাপকভিত্তিক ফলবাগান গড়ে তোলা হয়েছে। বাথান ও পশুখাদ্যের অভাবে জাপানে পশুপালন বিকশিত হয় নি। সে প্রাণীজ খাদ্য ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য দ্রব্যাদি আমদানি করে।

উৎপাদনের আত্যন্তিক অসম বণ্টন জাপানের অর্থনৈতিক ভূগোলের বৈশিষ্ট্য এবং তা প্রধানত কয়েকটি সীমিত শহর ও অঞ্চলের মধ্যেই ঘনীভূত।

হনসুর মধ্যাঞ্চলীয় শিল্পবেষ্টনী জাপানের সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ শিম্পাঞ্চল। টোকিও থেকে অসাকা অবধি বিস্তত দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলেই বৃহত্তম শিল্পকেন্দ্রগুলি অবস্থিত। রাজধানী টোকিও (জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি) জাপানের শিল্প, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান কেন্দ্র। ইয়োকোহামার সঙ্গে খাল সহ যুক্ত টোকিও একটি বিরাট বন্দর এবং এটি তার ৩৩ শতাংশ আমদানি ও ৫০ শতাংশ রপ্তানির আশ্রয়।

আরো পড়ুন:  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হলো পাশ্চাত্যের দ্বারা নিপীড়িত অঞ্চল

ওসাকা, কোবে ও কিওতো সহ দক্ষিণ-পশ্চিম হনসতে এক বিরাট শিম্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। হিরোসিমা ও নাগাসাকিও (শেষোক্তটি কেউস, দ্বীপে) এই অঞ্চলভুক্ত। বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমায় বিধস্ত এই দুটি শহরই এখন পুনর্গঠিত হয়েছে। উত্তর কেউস দ্বীপে কয়লা ও ধাতু শিল্পের একটি ভিত্তি রয়েছে।

জাপানের উত্তর-পূর্বে অংশে হনসু দ্বীপের উত্তরে এবং হোক্কাইডো দ্বীপে শিল্প গড়ে উঠছে। শেষোক্ত দ্বীপটিতে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত খনিজ ও জলবিদ্যুত সম্ভারের প্রেক্ষিতে এর শিল্পোন্নয়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি জাপান যুদ্ধোত্তরকালের কঠোরতম অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। এটি মেহনতি মানুষের জীবিকার মানের উপর প্রবল আঘাত হানে। বর্ধমান শ্রেণীবিভক্তি এবং কোটি কোটি মানুষের শোষক একচেটিয়াদের হাতে বিপুল সম্পদ সঞ্চয় শ্রেণীবিরোধ বৃদ্ধি করছে ও ধর্মঘট আন্দোলনে প্রেরণা যোগাচ্ছে। জাতীয় উৎপাদের। মোট পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান দখলকারী জাপান কিন্তু মাথাপিছু জাতীয় আয়ের হিসাবে পৃথিবীতে ষষ্টদশ স্থানে অবস্থিত।

তথ্যসূত্রঃ

১. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ২০৮-২১২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!