ঈশ্বরের কৃপায় আজকাল আর কেউ দৈবরহস্যে বিশ্বাসী নয়। বিস্ময়কর দৈববাণী এখন রপকথার গল্প। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বটে। আর আজকাল যখন প্রায়ই লজ্জাকর হতাশা এবং এমন কি নৈরাশ্যও দেখা যায় তখন এমন একটি বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করা যাক যা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৮৭ সালে সিগিজমুন্ডে বর্কখেইম লিখিত ‘১৮০৬-১৮০৭ সালের জামার্ন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকদের স্মরণে’ (‘Zur Erinnerung für die deutschen Mordspatrioten 1806-1807″) পুস্তিকার মুখবন্ধে আসন্ন যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছিলেন। (এটা হল ১৮৮৮ সালে হটিঙ্গেন-জুরিখ থেকে ‘সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক লাইব্রেরি’ প্রকাশিত পুন্তিকা নং XXIV.)
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ত্রিশ বছরের বেশি সময় আগে এভাবেই ভাবী বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে বলেছিলেন:
‘…এক বিশ্বযুদ্ধ এবং যে-বিশ্বযুদ্ধের পরিসর ও হিংস্রতা স্বপ্নাতীত, তাছাড়া আর কোনো যুদ্ধই প্রাশিয়া-জার্মানির পক্ষে সম্ভবপর নয়। আশি লক্ষ থেকে এককোটি সৈন্য পরস্পরকে হত্যা করবে এবং এতে তারা সারা ইউরোপকে এতটা গ্রাস করবে যাতে সে শুন্য হয়ে পড়বে, যা কোন পঙ্গপালের ঝাঁক কখনো করতে পারে নি। ত্ৰিশ বছর যুদ্ধের (১) ধবংস তিন থেকে চার বছরের আয়তনে ঘনীভূত হবে এবং সারা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং চরম দারিদ্র্যের ফলে সৈন্যবাহিনী ও জনগণ উভয়ের মধ্যে ব্যাপক নৈরাশ্য দেখা দেবে। শিল্প, বাণিজ্য ও ঋণ ব্যবস্থার কৃত্রিম যন্ত্রের হতাশ বিশৃঙ্খলা ব্যাপক দেউলিয়াপনায় পর্যবসিত হবে। পুরনো রাষ্ট্রগুলি এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রীয় বিচক্ষণতা এমন পর্যায়ে অধঃপতিত হবে যে অনেকগুলি রাজমকুটই পথে গড়াগড়ি যাবে অথচ সেগুলি কুড়ানর লোক থাকবে না। কীভাবে এসব শেষ হবে এবং একক বিজয়ী হিসেবে কার অভ্যুদয় ঘটবে — কেউ তা আগে থেকে বলতে পারবে না। কেবল একটি ফলশ্রুতিই নিশ্চিত: ব্যাপক অবসাদ এবং শ্রমিক শ্রেণির চুড়ান্ত বিজয়ের পরিস্থিতির উদ্ভব।
অস্ত্রসঙ্গজায় একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থার চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছনো শেষ পর্যন্ত এই অনিবার্য ফলই ফলাবে। হে আমার প্রভু, রাজন্যবর্গ, রাষ্ট্ৰনেতা — আপনাদের প্রজ্ঞা পুরনো ইউরোপকে এই পর্যায়েই টেনে এনেছে। আর যদি এখন আপনাদের আর কিছুই করণীয় নেই, বাকী শুধু শেষ মহাযুদ্ধের নাচটাই শুর করা — এটা আমাদের পক্ষে ঠিকই মানানসই হবে (uns kann es recht sein)। যুদ্ধ হয়ত আমাদের কিছুকালের মতো পেছনে ঠেলে দেবে, ইতিমধ্যে দখল করা কতকগুলি অবস্থান ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু আপনাদের মুক্ত করা শক্তিগুলিকে আপনারা যখন আর বাগ মানাতে পারবেন না, ঘটনা তখন আপন নিয়মেই এগুবে: করুণ ঘটনার শেষে আপনারা ধবংস হবেন আর ততদিনে প্রলেতারিয়েত হয়ত-বা জয়ী হবে, কিংবা যে-কোনো অবস্থাতেই (doch) তাদের জয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস
লন্ডন, ১৫ ডিসেম্বর, ১৮৮৭,
এই ভবিষ্যদ্বাণীতে কী অপূর্ব প্রতিভাই না প্রকটিত! আর এই সঠিক, স্বচ্ছ, সংক্ষিপ্ত ও বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিশ্লেষণের প্রতিটি বাক্য চিন্তায় কত-না অশেষ সমৃদ্ধ! যারা আজ লজ্জাকরভাবে অবিশ্বাস, হতাশা ও নৈরাশ্যে আত্মসর্মপিত, তাদের পক্ষে এ থেকে কতকিছুই তো শেখা সম্ভব, যদি… যদি বুর্জোয়ার সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতে অভ্যস্ত বা এতে ভীত ব্যক্তিরা চিন্তা করতে পারে, চিন্তার মতো ক্ষমতাটুকু না হারায়!
এঙ্গেলসের কোনো কোনো পূর্বাভাস ভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে: ত্রিশ বছর দীর্ঘ উন্মত্ত সাম্রাজ্যবাদী ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে পৃথিবী ও পুঁজিবাদ অপরিবর্তিত থাকবে, এমনটি ভাবা চলে না। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো এই যে এঙ্গেলসের অনেকগুলি পূর্বাভাষই ‘অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা, এঙ্গেলস অত্যন্ত নিখুত শ্রেণিবিশ্লেষণ দিয়েছিলেন, আর শ্রেণিগুলি ও তাদের মধ্যেকার সম্পর্কগুলি তো অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।
‘… যুদ্ধ হয়ত ঠিকই কিছু কালের মতো আমাদের পিছনে হটিয়ে দেবে…’ ঠিক এই পথেই ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছে, কিন্তু এগিয়ে গেছে আরও দুরে, আরও মন্দাবস্থায় : ‘পেছনে হঠে যাওয়া’’ কোনো কোনো জাতিদম্ভী-সমাজবাদী ও তাদের মেরুদন্ডহীন। ‘আধা-বিরোধীরা, কমিউনিস্টপন্থীরা নিজেদের পশ্চাদপসরণ প্রশংসা করতে শুরু করেছে এবং সমাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ বিশ্বাসঘাতক ও বেইমান হয়ে উঠেছে।
‘….যুদ্ধ হয়ত ইতিমধ্যে আমাদের দখলকরা অনেকগুলি অবস্থান ছিনিয়ে নেবে…’ একগুচ্ছ ‘আইনসম্মত অধিকার শ্রমিক শ্রেণির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, পক্ষান্তরে সে পরীক্ষায় ইস্পাত হয়ে উঠেছে এবং বেআইনী সংগঠনের, বেআইনী লড়াইয়ের, নিজ শক্তিগুলিকে বিপ্লবী আক্রমণের জন্য তৈরি করার কঠিন অথচ কার্যকর শিক্ষালাভ করছে।’
‘…অনেকগুলি রাজমুকুটই পথে গড়াগড়ি যাবে…’ কয়েকটি রাজমুকুট ইতিমধ্যেই গড়াগড়ি গেল। আর এগুলিরই একটি হলো অন্যতর ডজনখানেক মকুটের সমতুল্য: সমগ্র রাশিয়ার স্বৈরাচারীর চূড়ামণি — নিকোলাই রমানাভের মুকুট।
‘…কীভাবে এসব শেষ হবে, কেউ তা আগে থেকে বলতে পারবে না’ … ‘চার বছর যুদ্ধের পর এই না-বলতে পারাটা, বলা যায়, আরও দুরূহ হয়ে উঠেছে।
‘…আমাদের শিল্প, বাণিজ্য ও ঋণ ব্যবস্থার কৃত্রিম যন্ত্রের হতাশ বিশৃঙখলা…’ যুদ্ধের চতুৰ্থ বছরের শেষে পুঁজিপতিদের দ্বারা যুদ্ধে জড়ান অন্যতম অতিবৃহৎ ও অনগ্রসরতম রাষ্ট্র, রাশিয়ার ক্ষেত্রে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় কি বুভুক্ষা বাড়ছে না আর অন্যান্য দেশেও তেমনি কাপড় ও কাঁচামালের অভাব আর উৎপাদনযন্ত্রের অবক্ষয়ে কি অনুরূপ অবস্থায় পৌছনোর পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে না?
এঙ্গেলস কেবল বৈদেশিক’ যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ফলাফলগুলির কথাই বলেছেন। তিনি অভ্যন্তরীণ, অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের কথা বলেন নি, যা ব্যতিরেকে ইতিহাসের একটিও বিরাট বিপ্লব ঘটে নি এবং যা ব্যতিরেকে কোনো অলঘুচিত্ত মার্কসবাদীর পক্ষেই পুঁজিতন্ত্রের থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তর কল্পনা করা সম্ভবপর নয়। একটি বৈদেশিক যুদ্ধের পক্ষে পুঁজিতন্ত্রের ‘কৃত্রিম যন্ত্ৰে’ ‘হতাশ বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি ছাড়া কিছু, সময়ের জন্য এগিয়ে চলা সম্ভবপর হলেও এমন ফলশ্রুতি ছাড়া গৃহযুদ্ধ মোটেই কল্পনীয় নয়।
‘নোভায়া জিজন’ দল, মেনশেভিক, দক্ষিণপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি ইত্যাদির মতো যারা নিজেদের ‘সমাজতন্ত্রী’ বলাটা অব্যহত রেখেছে বিদ্বেষের সঙ্গে এই ‘হতাশ বিশৃঙ্খলার’ অভিব্যক্তি দেখায় আর সবকিছুর জন্য বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত, সোভিয়েতরাজ ও সমাজতন্ত্রে রূপান্তরের ‘ইউটেপিয়াকে’ দোষী সাব্যস্ত করে তাদের আহাম্মকী, মেরুদন্ডহীনতা কতই-না স্পষ্ট, বুর্জোয়াকে দেয়া ওদের ভাড়াটে সৈনিকবৃত্তির কথা আর না-ই বা বললাম। ‘বিশৃঙ্খলা’ বা খাঁটি রুশ শব্দ ‘রাজরুখা’ তো যুদ্ধেরই সৃষ্টি। বিশৃঙ্খলা ছাড়া সত্যিকার যুদ্ধ অসম্ভব। বিশৃঙ্খলা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অপরিহার্য শর্ত ও অনুষঙ্গ — গৃহযুদ্ধও অসম্ভব বটে। বিশৃঙখলার ‘প্রেক্ষিতে’ বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের নিন্দাজ্ঞাপনের একটাই অর্থ: নীতিহীনতা প্রদর্শন এবং কার্যত বুর্জোয়ার পক্ষসমর্থন।
‘…দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং চরম দারিদ্র্যের ফলে সৈন্যবাহিনী ও জনগণ উভয়ের মধ্যে ব্যাপক নৈরাশ্য…’
এঙ্গেলস, কত সরল ও স্বচ্ছ ভাবে এই প্রশ্নাতীত সিদ্ধান্তে পৌছন যা প্রত্যেকের কাছেই বোধগম্য হয়ে উঠবে যে অনেক বছরের তীব্র ও উদ্বেগপূর্ণ যুদ্ধের বিষয়গত ফলাফল অন্যভাবে সমৰ্থ। আর ওইসব অসংখ্য ‘সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট’ ও ভুয়ো ‘সমাজতন্ত্রীরা’ বিস্ময়কর পরিমাণ আহাম্মক, যারা এই সরলতম ধারণাটিও বুঝতে চায় না বা বুঝতে পারে না।’
সৈন্যবাহিনী ও ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষের হতাশা না ঘটিয়ে বুহ বছর স্থায়ী একটি যুদ্ধ চালানো কি বোধগম্য? অবশ্যই না। দীর্ঘ যুদ্ধের এমন ফলাফল পুরো একটি প্রজন্মের উপর না হলেও কয়েক বছর লোকেরা, নিজেদের ‘সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট’ ও ‘সমাজতন্ত্ৰী’ হিসেবে পরিচয়দাতা বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ছিঁচকাঁদুনেরা নীতিভ্রষ্টতার দেখা দেয়ার জন্য বা বিশেষত নীতিভ্রষ্টতার চরম ক্ষেত্রে তা দমনের জন্য গৃহীত অনিবার্য কঠিন ব্যবস্থাকে বিপ্লবে দোষারোপকারী বুর্জোয়াকে সমর্থন দেয়, যদিও এটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে, এটা ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধেরই ফলে এবং দীর্ঘ লড়াই ছাড়া, নির্যাতনামূলক কয়েকটি কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া যুদ্ধের এই ফলাফল থেকে কোনো বিপ্লবই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না।
‘নেভায়া জিজন’, ‘ভপেরিওদ’ (২) বা ‘দিয়েলো নারোদা’ পত্রিকার মিষ্টি-কথার লেখকরা প্রলেতারিয়েত ও অন্যান্য নির্যাতিত শ্রেণিগুলিকে একটি বিপ্লব ‘তাত্ত্বিকভাবে’ অনুমোদন করতে পারেন যদি কেবল সেই বিপ্লব স্বর্গ থেকে নেমে আসে এবং মাটিতে জন্মায় না, বিকশিত হয় না। — যে-মাটি চার বছরের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের হত্যাকাণ্ডে আমাদের জনগণের রক্তে ভেজা, যে-হত্যাকান্ডে লক্ষ লক্ষ মানুষ ধবংস হয়েছে, সন্ত্রস্ত হয়েছে, নীতিভ্রষ্ট হয়েছে।
তারা শুনেছে ও ‘তত্ত্বে’ স্বীকার করেছে যে বিপ্লব প্রসবের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটামাত্র তারা লজ্জাকরভাবে ভীত হয়ে পড়ে আর তাদের ভীত গোঙানিতে প্ৰতিধ্বনিত হতে লাগল প্রলেতারিয়েতের আক্রমণের বিরুদ্ধে বুর্জোয়ার কুটিল সোরগোল। সাহিত্যে প্রসবের বর্ণনা স্মরণ করুন, যেখানে লেখকের লক্ষ্য হলো প্রসবষন্ত্রণার তীব্রতা, ব্যথা ও অসহ্যতার সত্যিকার ছবি আঁকা, যেমনটি আছে এমিল জোলার ‘ La joie de vivre’ (জীবনের আনন্দ) বা ভেরোসায়েভের ‘ডাক্তারের নোটগুলি’ বইয়ে। মানুষের ক্ষেত্রে সন্তানপ্রসব নারীকে প্রায় নিষ্প্রাণ, রক্তরঞ্জিত মাংসস্তূপে পরিণত করে, তাকে অত্যাচারিত পীড়িত ও যন্ত্রণায় উন্মত্ত করে তোলে। কিন্তু যে ‘ব্যক্তি’ প্রেমে ও প্রেমের পরিণতিতে, নারীর মাতৃত্বে রূপান্তরে কেবল এটাই দেখে, সে কি মানুষ্যপদবাচ্য? এজন্য কে প্রেম ও প্রসবকে অস্বীকার করে?
প্রসব যন্ত্রণা কম বা বেশি হতে পারে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মার্কস ও এঙ্গেলস সর্বদাই বলেছেন যে, পুঁজিতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তর অনিবার্যভাবেই দীর্ঘ প্রসব যন্ত্রণার অনুষঙ্গী হবে। আর একটি বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণক্রমে এঙ্গেলস সহজ ও স্বচ্ছ ভাবে এই প্রশ্নাতীত ও সুস্পষ্ট ঘটনার কথা বলেছেন যে যুদ্ধ পরবর্তী ও সংশ্লিষ্ট বিপ্লব (এবং ততোধিক, আমাদের অংশটি যোগ করা যাক, যুদ্ধের সময় শুরু হওয়া বিপ্লব এবং যা বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে উদ্ভূত ও সেখানেই নিজেকে চালিয়ে নিতে বাধ্য) হলো বিশেষ মারাত্মক ধরনের এক প্রসবের ঘটনা।
স্পষ্টত এটা বুঝেই এঙ্গেলস বিশ্বযুদ্ধে মরণোম্মুখ পুঁজিতন্ত্রজাত সমাজতন্ত্র সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্কভাবে কথা বলেন। তাঁর ভাষায়: “কেবল একটি ফল (বিশ্বযুদ্ধের) একান্তভাবেই নিশ্চিত: ব্যাপক ক্লান্তি এবং শ্রমিক শ্রেণির চুড়ান্ত বিজয়ের পরিস্থিতির উদ্ভব।”
আমরা যে-মুখবন্ধটি দেখছি সেটার শেষে এই চিন্তা এমন কি আরও স্বচ্ছভাবে ব্যক্ত হয়েছে: “…এই করুণ ঘটনার শেষে আপনারা (পুঁজিপতি, জমিদার, রাজন্যবর্গ ও বুর্জোয়া রাষ্ট্ৰনেতারা) ধবংস হবেন আর ততদিনে প্রলেতারিয়েত হয়ত-বা জয়ী হবে, কিংবা যে-কোন অবস্থাতেই তাদের জয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।”
মারাত্মক প্রসবষন্ত্রণা বিষম ব্যাধির বা মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই বাড়ায়। কিন্তু যেখানে প্রসবে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে সেখানে পুরনো সমাজের গর্ভজাত নতুন সমাজের মৃত্যু ঘটতে পারে না। সম্ভাব্য যা কিছু ঘটতে পারে তা হলো জন্মটি অধিকতর যন্ত্রণাদায়ী, দীর্ঘতর হতে পারে, শ্লথ হতে পারে বিকাশ ও বৃদ্ধি।
যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নি। ব্যাপক ক্লান্তি ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। শর্তাধীনে যুদ্ধের যে-দুটি সরাসরি ফল সম্পর্কে এঙ্গেলস পূর্বোভাস দিয়েছিলেন (ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির বিজয় বা সকল প্রতিবন্ধ সত্ত্বেও এটা অনিবার্য হয়ে উঠার পরিস্থিতির উদ্ভব) সে সম্পর্কে এখন ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি উভয়টিই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
একটিতে, পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলির অনগ্রসরতম একটি দেশে শ্রমিক শ্রেণির বিজয় ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। দৃষ্টান্তহীন যন্ত্রণা ও চেষ্টায় অন্যগুলিতেও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, যা এই বিজয়কে ‘যে-কোনো অবস্থাতেই অনিবার্য করে তুলবে।
‘সমাজতন্ত্রী’ ছিচকাঁদুনেরা গোঙরাক, বুর্জোয়া উন্মত্ত ও ক্রুদ্ধ হোক। কিন্তু যারা না দেখার জন্য চোখ বুজে আছে আর না শোনার জন্য কান বন্ধ করেছে কেবল তারাই জানতে পারে না যে সমাজতন্ত্রে গর্ভবতী বৃদ্ধা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের প্রসব যন্ত্রণা সারা দুনিয়ার সর্বত্রই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশ, যা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বগিতে ঘটনাপ্রবাহে সাময়িকভাবে এগিয়ে গেছে, সে এখন প্রসবের প্রথম পর্যায়ের বিশেষ তীব্র যন্ত্রণাটা ভোগ করছে। পূর্ণ নিশ্চয়তা ও চুড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যৎ মোকাবিলার মতো সঙ্গত কারণ আমাদের অবশ্যই আছে। এটা আমাদের জন্য কয়েকটি প্রাগ্রসরতর দেশে সমাজতান্ত্ৰিক বিপ্লবের নতুন বিজয় ও নতুন মিত্ৰ সৃষ্টি করছে। আমরা গর্বিত হতে এবং নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবতে পারি যে, ভাগ্যক্রমে এটা পৃথিবীর একাংশে প্রথমে আমাদের ভাগেই পড়েছে। — সেই বুনো জানোয়ার, পুঁজিতন্ত্র, যা দুনিয়াকে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে আর মানবজাতিকে বুভুক্ষায় ও নীতিভ্রষ্টতায় এনেছে, এবং যে নিশ্চিতই অচিরে ধবংস হবে, মরণকালে সে যতই দানবীয় ও ক্ৰোধে হিংস্র হয়ে উঠুক।
২৯ জুন ১৯১৮
৩৬ খণ্ড ৪৭২-৪৭৮ পৃঃ
টিকাঃ
১. ত্রিশবর্ষ যুদ্ধ (১৬১৮-১৬৪৮) হচ্ছে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর পৃথক পৃথক জোটের মধ্যে দ্বন্দ্ব অসংগতি প্রকোপনের ফলে সংঘটিত প্রথম সারা ইউরোপীয় যুদ্ধ। জার্মানি হয়ে উঠল এই সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্র। ওয়েস্টফালিয়া শান্তি চুক্তি দিয়ে এই যুদ্ধ শেষ হয়, তাতে পাকাপোক্ত হয় জার্মানির রাষ্ট্রিক খণ্ড-বিখন্ড অবস্থা।
২. ভপেরিয়দ বা অগ্রগামি হচ্ছে ১৯১৭-২০ অবধি মস্কো থেকে প্রকাশিত মেনশেভিক সংবাদপত্র।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।