গ্যাস্টিক বা অম্ল অধিকাংশ মানুষের একটি সাধারণ সমস্যা হিসাবে দেখা দেয়। এটা মূলত খাদ্যাভ্যাসের কারণে দেখা দেয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা, শুকনা মরিচের তরকারি খাওয়া, তেল-মসলা বেশি খাওয়া ইত্যাদি কারণে অম্ল হয়। তবে ঔষধ ছাড়াও ঘরোয়া উপায়ে গ্যাস্টিক বা অম্ল থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
গ্যাস্টিক বা অম্ল কমানোর ঘরোয়া গুণাগুণ:
১. সেগুন গাছ: যে অশ্লপিত্ত রোগ শ্লেম্মাজনিত, সেই ক্ষেত্রেই ব্যবহার্য। এই রোগ হলে সেগুন গাছ-এর ( Tectona grandis) কাঠের গুড়া (করাত কাটাই) ১৫। ২০ গ্রাম ৪। ৫ গ্রাম জলে সিদ্ধ করার পর আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে সেই জল সমস্ত দিনে ৩। ৪ বারে অল্প অল্প করে খেতে হয়। এইভাবে ৩।৪ দিন ব্যবহার করলে ওটা সেরে যাবে। নইলে উপশম নিশ্চয়ই হবে।
২. তেতো পাট: আমরা একেই চলতি কথায় ‘অম্বল’ রোগ বলে থাকি। আজকাল এ রোগটায় শতকরা আশি জন ভুগছেন, বর্তমানকালে এর কবল থেকে রক্ষে ‘ পাওয়া অসম্ভবই বলা যেতে পারে, কারণ আমরা যেসব দ্রব্য আহার্য হিসেবে গ্রহণ করি সেগুলি সবসময় অকৃত্রিম থাকে না, আর যদিও হয় সেটা আমাদের শরীর গ্রহণ নাও করতে পারে, তাছাড়া স্বেচ্ছাকৃত অনেক বিরুদ্ধে দ্রব্যও আহার করি; এই বিরুদ্ধে বলতে সংযোগ বিরুদ্ধ হতে পারে, আবার কালবিরুদ্ধ হতে পারে। যাহোক, এর থেকে অগ্নিমান্দ্যও হতে পারে এবং হয়ও, সেই থেকে অম্লরোগের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে দু’বেলা আহারের আধ ঘণ্টা পরে অন্ততঃ আধ কাপ তেতো পাট ভিজানো জল খেতে হবে, তবে পাতা আধ ভাঙ্গা হলে ভাল হয়, এটা দেড় গ্রাম মাত্রার বেশী নেওয়ার দরকার নেই।
৩. ধুনিয়া: চলতি কথায় আমরা একে অম্বলের রোগ বলি। যাঁদের অল্প হয় অথচ বহিঃপ্রকাশ কম, সে রোগকে আমরা “চোরা অম্বল” বলি। এর ফলে অনেকের ঘুসঘুসে জ্বরও হয়, অরুচি হয়, প্রস্রাব কমে যায়, এসবের একটু, লক্ষণ দেখা দিলেই ধুনোর মিহি গুঁড়া ২০০ মিলিগ্রাম প্রত্যহ দু’বার করে ঠাণ্ডা জলসহ খেতে হবে। এর দ্বারা চোরা অম্বল কমে যাবে।
৪. কালমেঘ: এই ক্ষেত্রে কালমেঘ পাতার রস আধ চা-চামচ, তার সঙ্গে বড় এলাচের দানা চূর্ণ ২ টিপ নস্যির পরিমাণ মিশিয়ে সকালে খেলে এই দুটি রোগ উপশম হয়, তবে প্রয়োজনবোধে দু’বেলাই খাওয়া যায়। এটাও ঠিক যে, আহারাদির বাছবিচার না করলে এ অসুখের উপশমও হয় না। অম্লরোগের উপশমের অন্তরায় হলো যে কোন মিষ্ট দ্রব্য, এমনকি মিষ্ট ফলও ভাল নয়।
৫. হাড়জোড়া: এ রোগে যিনি আক্রান্ত হন, তার পরিণতিতে আসে গ্যাসট্রিক আলসার, ডিয়োডিনাম, আলসার প্রভৃতি অক্ষত রোগ। এক্ষেত্রে হাড়জোড়ার কচি পাতা ও ডাঁটা কুচিয়ে শুকিয়ে গুঁড়া করে নিতে হবে; সেই মিহি চূর্ণ দু’টিপ নস্যির মত এবেলা ওবেলা দু’বার ঠাণ্ডা জল দিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা দুই-তিন দিনের মধ্যে খুব ভাল উপকার পাওয়া যাবে। তবে যাঁদের এলার্জি আছে তারা ২/১ দিন খাওয়ার পর অস্বস্তি বোধ হ’লে আর না খাওয়াই ভাল।
৬. পিপুল: পিপুলের গুঁড়াতে চিনি মিশিয়ে এক মাস ধরে নিয়মিত খেলে অম্লাদিতে উপকার হয়।
৭. শুঠ: দুই গ্লাস ফুটন্ত জলে ১ চা চামচ শুঁঠের চূর্ণ মিশিয়ে কুড়ি পঁচিশ মিনিট ঢেকে রাখতে হবে। ঠাণ্ডা হলে কাপড়ে ছেঁকে নিতে হবে। প্রতিদিন অল্প করে এই জল খেলে গ্যাস ও পেট ব্যথা সারবে। এই জলে একটু সোডি বাই কার্ব মিশিয়ে নিলে এবং দিনে তিনবার করে পান করলে বদহজম, বদ (খারাপ) ঢেকুর ওঠা আর পেটে জমা হওয়া বায়ু দূর হয়। শুঠ চূর্ণ আর যবক্ষার সম পরিমাণে নিয়ে ঘিয়ে মিশিয়ে চেটে খেয়ে তারপর গরম জল পান করলে অজীর্ণতা সেরে যায় এবং খিদে পায় । শুঁঠ, আমলকী আর মিশ্রিত মিহি চূর্ণ করে এক সঙ্গে মিশিয়ে খেলে অম্লাদিতে উপকার পাওয়া যায় ।
৮. মেথি ও মৌরি: ২ চা চামচ মেথি ও ২ চা চামচ মৌরি একসঙ্গে নিয়ে তাওয়ায় সেঁকে নিতে হবে। অর্ধ কোটা করে এই মিশ্রিত মশলা ১ চা চামচ করে প্রতিদিন খেলে বায়ু, গ্যাস, বমিভাব, টক হেঁচকি আর টক ঢেকুর ওঠা ইত্যাদির প্রশমন হবে।
৯. জোয়ান বা যোয়ান: তাওয়ায় জোয়ান বা যোয়ান সেঁকে নিয়ে সম পরিমাণ সৈন্ধব নুন মিশিয়ে পিষে ফেলতে হবে। গরম জলের সঙ্গে এই চুর্ণ খানিকটা খেলে পেটের বায়ু দূর হয়।
১০. লেবু, জিরা: সম পরিমাণে ধনে-জিরা গুঁড়া একটু চিনি মিশিয়ে খেলে অম্বলের (অম্লপিত্ত) জন্যে খাওয়ার পরে যে বুক জ্বালা করে তার উপশম হয়। জিরা আর সৈন্ধব নুন সম পরিমাণে নিয়ে পাতিলেবুর রসে সাতদিন ধরে ভিজিয়ে রাখুন। রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে নিন। এই চুর্ণ সকাল ও সন্ধেবেলা খেলে গ্যাস সারে এবং হজম শক্তি বেড়ে যায়।
১১. নারকেল: এই প্রক্রিয়ার মুষ্টিযোগটা একটু, গোলমেলে, তবে এটা কোনো বৈদ্যের দ্বারা যদি তৈরী করিয়ে নিতে পারেন তো ভাল হয়; একটা ঝুনা নারকেলের (বড় সাইজের) মুখের দিকে ছ্যাঁদা করে, জল ফেলে দিয়ে তার মধ্যে শুক আকন্দপাতা ২৫ গ্রাম কুচি কুচি করে পুরে দিতে হবে, তারপর বাখারি চূর্ণ (শামুক বা ঝিনুক পুড়িয়ে যে চূর্ণ হয়) ১০ গ্রাম আর যোয়ান ২৫ গ্রাম ঐ নারকেলের খোলের মধ্যে পরে গায়ে মাটি-ন্যাকড়া জড়িয়ে, লেপে শুকিয়ে ঘুটের আগুনে পোড়াতে হবে; এমনভাবে পোড়াতে হবে—যেন নারকেলের খোলটা পুড়ে গিয়ে ভিতরকার শাঁস ও অন্যান্য জিনিসগুলি পুড়ে যায়। তারপর নারকেলের উপরকার পোড় খোলা অর্থাৎ মালাটাকে বাদ দিয়ে সেই পোড়া শাঁস সমেত অন্যান্য জিনিসগুলিকে একসঙ্গে গুড়া করে, ছেকে রাখতে হবে; এই চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় মধ্যাহ্নে ও রাত্রে দুইবেলা আহারের পর জলসহ খেতে হবে। এর দ্বারা অম্ল-অজীর্ণের দোষ নিশ্চয়ই কমবে, এমন-কি যাঁদের শুল ব্যথা ধরে—তাঁরাও এটা খেলে রেহাই পাবেন, তবে পথ্যাশী হওয়া দরকার অর্থাৎ খাওয়াদাওয়ার নিয়ম মেনে চলতে হবে।
১২. ভেন্না: ভেন্না বা রেড়ি গাছ কচিপাতা ৪ থেকে ৫ গ্রাম সিদ্ধ করে ছে’কে সেই জল খেলে ব্যথা কমে যায়।
১৩. বাসক: এ রোগে দীর্ঘদিন ভুগতে থাকলে আসে অম্লশূর, হৃদরোগ, ব্লাডপ্রেসার এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত। এই অম্লপিত্তকে বন্ধ করতে হলে ৭ থেকে ৮ গ্রাম বাসক ছাল ৪ কাপ আন্দাজ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে নিয়ে সেই জলটা দুই তিন বারে প্রতিদিন খেলে বিশেষ উপকার হয়।
১৪. আমলকী: একে আয়ুর্বেদের ভাষায় বলা হয় অম্ল রোগ। এ রোগে সহযোগীরুপে আত্মপ্রকাশ করে পিত্তবিকৃতি। সে ক্ষেত্রে শুষ্ক আমলকী ৩ থেকে ৪ গ্রাম এক গ্লাস গরম জলে পূর্ব দিন রাত্রে ভিজিয়ে রেখে পরদিন ভাত খাওয়ার সময় সাধারণ জলের পরিবর্তে এই জল খেতে হয়। তবে এই আমলকী কোনো ধাতুপাত্রে ভিজানো উচিত নয়। এর দ্বারা সেই পিত্তবিকৃতি নষ্ট হয়; এটি বহু, পরীক্ষিত।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১ আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ১ ও ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।