গাছবেড়া বা হেজ (ইংরেজি: Hedge) হচ্ছে সারি করে উদ্ভিদ লাগিয়ে যে বেড়া তৈরি করা হয় তার নাম। একাধিক উদ্দেশ্যে এটা ব্যবহৃত হয়। বাগানের বা বাড়ি ঘরের সীমানা দেয়ালের বিকল্প হিসেবেই এর প্রধান ব্যবহার। বাগানের বিভিন্ন অংশ পরস্পর থেকে আলাদা করতে অথবা তারের বেড়া ও পাকা দেয়াল ঢেকে রাখার জন্যও এটা কাজে লাগানো হয়। উদ্দেশ্য অনুযায়ী হেজের উচ্চতা ২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। অনেক সময় বাগানের রাস্তা ও লনের মাঝখানে অথবা লনের চতুর্দিকে নিচু হেজ তৈরি করা হয়, এ জাতীয় হেজকে ঘেরা (border) বলা হয়। ঘেরা সাধারণত ২৫-৫০ সেমি উঁচু এবং স্থায়ী বা অস্থায়ী হতে পারে।
হেজের উপযোগী উদ্ভিদ
সাধারণত গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ দিয়ে হেজ তৈরি করা হয়, কিন্তু সব গুল্মই এ কাজের উপযোগী নয়। হেজ তৈরির গুল্মের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকবে।
(ক) অল্প যত্নে সজীব থাকার এবং রোগ ও পোকা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা।
(খ) অতিরিক্ত ছাঁটাই করলেও ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া।
(গ) গরুছাগলের খাওয়ার অনুপযোগী। কাঁটা ও বিষাক্ত অঙ্গ গরুছাগল সরিয়ে রাখে।
(ঘ) আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাওয়া।
হেজের উপযোগী গুল্ম বাংলাদেশে অনেক আছে। নিম্নে বর্ণিত কয়েকটি অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবী রাখে।
উঁচু হেজের উপযোগী উদ্ভিদ
Bambusa nana, Gramineae, (dwarf or Chinese bamboo): এটা একটি ক্ষুদ্রাকার বাঁশ, কাণ্ড চিকন (ব্যাস ২-৩ সেমি) ও হলুদাভ। গুড়ি চারা দিয়ে বংশবিস্তার। সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এর হেজ অত্যন্ত সুন্দর হয়।
Carissa carandas, Rubiaceae, করঞ্জা, করমচা: কিঞ্চিৎ কাটাময় গুল্ম, ডালপালা ঘন, পাতা গাঢ় সবুজ। শাখা কলম ও বীজ দিয়ে বংশবিস্তার। এর ফল ভক্ষণযোগ্য।
Duranta plumieri (syn: D. repens, D. macrophylla), Verbenaceae, দূরন্ত: অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু উদ্ভিদ, ছায়া ও আলোতে সমানভাবে জন্মে। এর কোনো কোনো জাতে কাঁটা থাকে। শাখা কলম বা বীজ দিয়ে বংশবিস্তার হয়।
Inga dulcis (Pithecolobium dulce), Leguminosae, Madras thorn, বাবুল কাটা: এটা একটি আদর্শ হেজের উদ্ভিদ, দেখতে সুদৃশ্য ও কষ্ট-সহিষ্ণু। পাতা উপবৃত্তাকৃতির, ২-৩ সেমি লম্বা, কাণ্ডে সরু ও তীক্ষ্ণ কাঁটা থাকে। গাছটি বাড়তে দিলে বৃক্ষে পরিণত হয়। এটা দেখতে তেঁতুলের মতো ভক্ষণযোগ্য ফল উৎপাদন করে। বীজ দিয়ে বংশবিস্তার।
Lawsonia inernme, Lythraceae, Camphire, মেহেদী, হেন্না: মেহেদীর কাণ্ড খসখসে কিন্তু পাতা সুদৃশ্য। শাখাকলম ও বীজ দিয়ে বংশবিস্তার। এর পাতায় রঞ্জক থাকে। হাত, পায়ের তালু ও দাড়ি রাঙ্গানোর জন্য এ রঞ্জক ব্যবহৃত হয়।
Vernonia elaegnifolia (Compositae) নামে একটি সুদৃশ্য লতানো উদ্ভিদ আছে যা দিয়ে কাঁটা তারের বেড়া ঢেকে রাখলে খুব সুন্দর দেখায়। এটার শাখা-প্রশাখা নীচের দিকে ঝুলে থাকে এবং নিচ্ছিদ্রভাবে বেড়া ঢেকে রাখে। ঢাকার সেনানিবাস। এলাকায় অনেক স্থানে এটা লাগানো হয়েছে।
নিচু হেজ ও বর্ডারের উপযোগী উদ্ভিদ
Acalypha spp.: এ গণের একাধিক প্রজাতি হেজের উদ্ভিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরা পাতাবাহারী উদ্ভিদ এবং অত্যন্ত কষ্ট সহিষ্ণু। একাদশ অধ্যায়ে এরকম দুটি প্রজাতির বিবরণ দেয়া হয়েছে।
Aerva sanguinea (Amaranthaceae), নুরিয়া: উদ্ভিদটি একটি গুল্মবৎ বীরুৎ, পাতা ক্ষুদ্র ও বেগুনী, শাখা কলম দিয়ে বংশবিস্তার। বাংলাদেশে অনেকেই এ দিয়ে ঘেরা তৈরি করে থাকেন কিন্তু এটা তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। নুরিয়া দিয়ে অক্ষর ও বিভিন্ন ডিজাইন তৈরি করা হয়।
Ixora coccinea (রঙ্গন): ফুলধারী গুল্মের অধ্যায় দেখুন।
Justicia gendarussa (Acanthaceae), বিশাল্লা: নিচু হেজ ও ঘেরা তৈরির জন্য এটা বাংলাদেশে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উদ্ভিদটির কাণ্ড কোমল, পাতা বল্লামাকৃতির ও চকচকে সবুজ। শাখা কলম দ্বারা বংশবিস্তার হয় ।
Lantana cannara var. depressa (Verbenaceae): অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু উদ্ভিদ। ল্যানটানার ডিপ্রেসা জাত খুব খাটো ও ঝোপালো এবং প্রায় সারা বছর সুন্দর ফুল ধারণ করে। ঘন ঘন ছাঁটাই না করলেও এটা ভাল দেখায়। বর্ণনার জন্য গুল্মের অধ্যায় দেখুন । চিত্র-২
Pedilanthes titliymaloides (Euphorbiaceae) ও ত্রয়োদশ অধ্যায় দেখুন।
বেড়া বা হেজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ
হেজের সৌন্দর্য ও স্থায়ীত্ব নির্ভর করে ব্যবহৃত উদ্ভিদ ও যত্নের উপর। হেজ লাগাবার জন্য প্রথমে নির্ধারিত স্থানে ৪০-৫০ সেমি চওড়া ও একই রকম গভীর খাদ (trench) খুঁড়ে এর মাটির সাথে কিছু গোবর বা আবর্জনা সার এবং প্রতি ১০ মিটারের জন্য এক কেজি টি. এস. পি মিশিয়ে খাদ আবার ভর্তি করতে হবে। ব্যবহার্য উদ্ভিদের জাত অনুযায়ী সরাসরি বীজ বুনে, চারা বা কলম রোপণ করে হেজ শুরু করা যায়। গাছ তিন সারিতে লাগানো উচিত। মার্চ-মে মাস গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। সারিতে গাছের দূরত্ব হবে ১৫-২৫ সেমি। লাগানোর কিছুদিন পরে গাছের গোড়ায় কিছু ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা প্রথম বারের মতো মাটি থেকে ১৫ সেমি উপরে ছাঁটাই করতে হবে, তখন কাণ্ডের আইক থেকে শাখা বের হলে সেগুলো ১০-১২ সেমি উপরে ছাটাই করতে হবে। এভাবে করতে থাকলে হেজ গোড়া থেকে ঘন হয়ে বাড়বে। হেজের উচ্চতা ও প্রস্থ আগে থেকেই নির্ধারিত থাকবে। লাগানো গাছের মধ্যে কোনটা মরে গেলে তৎক্ষণাৎ সেখানে নতুন গাছ লাগাতে হবে। হেজ পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয়ে গেলে নিয়মিত ছাটাই ও মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে সার প্রয়োগ করতে হবে। হেজের গোড়া সব সময় পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন যাতে সেখানে ইঁদুর ও পোকা মাকড়ের আস্তানা সৃষ্টি না হয়।
কোনো কোনো সময় হেজের গাছ বা আলাদাভাবে জন্মানো গুল্মের গাছ ছাটাই করে পশুপাখি বা অন্য বস্তুর আকৃতি দান করা হয়, এমনকি এ দ্বারা তোরণও তৈরি করা হয়। এ কাজকে টপিয়ারী (topiary) বলে। টপিয়ারী তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করা খুব সহজ নয়। এর জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রম প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
১. ড. মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ, ফুলের চাষ, দিব্যপ্রকাশ ঢাকা, দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ বইমেলা ২০০৩, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।