লন (ইংরেজি: Lawn) বা বাগভূমি হচ্ছে সৌন্দর্য তৈরির জন্য ঘাস আচ্ছাদিত ভূমি যা বাগান তৈরি করবার জন্য অবশ্যই দরকার। বাগানের গাছপালা ও অন্যান্য উপকরণ মিলিয়ে যদি একটি ছবি কল্পনা করা যায়, তাহলে লন হচ্ছে তার পটভূমি। এ পটভূমি যত সবুজ ও মসৃণ হবে বাগানের সৌন্দর্য ততো বৃদ্ধি পাবে।
সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়াও লনের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। বিশ্রাম নেয়া, খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য লন ব্যবহৃত হয়। উৎকৃষ্ট লন কার্পেটের মতো আরামদায়ক হবে। এজন্য কতকগুলো নিয়মকানুন অনুসরণ করে লন তৈরি করতে হয়। তৈরির সময় ভুল করলে পরে তা শোধরানো কষ্টসাধ্য।
বাগভূমি প্রস্তুত প্রক্রিয়া
সারাদিন সূর্যের আলো পড়ে এমন স্থানেই কেবল সর্বোৎকৃষ্ট লন তৈরি হতে পারে। আংশিক ছায়াতেও লন হতে পারে কিন্তু সার্বক্ষণিক ছায়াতে তা সম্ভব নয়। দোআঁশ মাটি লনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। প্রয়োজন হলে পূর্ব অধ্যায়ে বর্ণিত উপায়ে মাটির বুনট পরিবর্তন করে নেয়া যেতে পারে। বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির সময় যাতে পানি জমে না থাকে সেজন্য বাগানের অন্যান্য অংশের সাথে মিল রেখে সুষ্ঠু নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মার্চ-এপ্রিল মাস লন তৈরি শুরু করার সবচেয়ে উপযোগী সময়। প্রথমেই নির্বাচিত স্থানের ঘাস, ইট ও পাথরের টুকরো ইত্যাদি সবরকম আবর্জনা পরিষ্কার করে নিতে হবে। লনে নুড়ির উপস্থিতি পরবর্তীকালে ছাঁটাই যন্ত্র (mower) চালাতে অসুবিধার সৃষ্টি করে। লনের মাটি গভীর করে কর্ষণ করতে হয়, এতে ঘাসের শিকড় নীচের দিকে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়, ফলে শুষ্ক মৌসুমেও এটা সতেজ থাকে। কর্ষণের পর সেচ দিয়ে (বৃষ্টি না হলে) মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে কিছুদিন রেখে দিতে হবে। এ সময়ে মাটিতে অবস্থানরত আগাছার বীজ ও মুথা গজিয়ে উঠবে, তখন এগুলো উপড়ে ফেলে মাটি উলট-পালট করে দিতে হবে যাতে নীচে পড়ে থাকা বীজ উপরে এসে গজিয়ে যায়। এভাবে কয়েকবার করলে জমি আগাছামুক্ত হয়ে যাবে। আগাছার মধ্যে মুথা ঘাস (Cyperus rotundus) লন তৈরিতে সর্বাধিক অসুবিধার সৃষ্টি করে। এটা নির্মূল করতে পারলে পরবর্তীকালে আগাছা দমন সহজ হয়ে আসে। জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে মাটির সাথে কিছু জৈবসার, টি. এস. পি (প্রতি ১০০ বর্গমিটারে ২ কেজি) অথবা দ্বিগুণ পরিমাণ হাড়ের গুঁড়া এবং মাটি অম্ল হলে কিছু গুঁড়া চুন (প্রতি ১০০ বর্গ মিটারে ২০০-৩০০ গ্রাম) মিশিয়ে দিতে হবে। ঘাস লাগাবার আগে ভূমির লেভেল পূর্ব পরিকল্পনামতো ঠিক করে নিতে হবে। বৃহৎ লনের জন্য এ উদ্দেশ্যে চাপনযন্ত্র (roller) ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র লনের জন্য কাঠের ভারী খণ্ড দিয়ে চেপে মাটি সমান করা সম্ভব।
ঘাস লাগানোর প্রক্রিয়া
বাগভূমি বা লন তৈরির জন্য নানা রকমের ঘাস ব্যবহার করা যেতে পারে। যেসব ঘাস অল্প যত্নে সবল ও সুস্থ থাকে এবং যেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ সহজ ও কম ব্যয়বহুল সেগুলোই ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশের জন্য নিম্নোক্ত দুটি প্রজাতির ঘাস সবচেয়ে উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দূর্বাঘাস (Cynodon dactylon, Gramineae, Bermuda grass): দূর্বা সর্বাধিক ব্যবহৃত লনের ঘাস, সযত্নে তৈরি দূর্বার লন কার্পেটের ন্যায় মোলায়েম ও দেখতে আকর্ষণীয়। দূর্বাঘাসের একাধিক জাত রয়েছে, কোনো কোনোটার পাতা সরু ও চকচকে সবুজ। ছায়াময় স্থানে দূর্বার লন ভাল হয় না।
চাপা ঘাস (Axonopus compressus, Gramineae): বাংলাদেশে লনের জন্য এ ঘাসের বহুল ব্যবহার রয়েছে। ঢাকার রমনা পার্কের লন এ ঘাস দিয়ে তৈরি। কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অঙ্গনে এ দিয়ে লন তৈরি করা হয়েছে। এর পাতা ৪-৬ সেমি দীর্ঘ, ১-১.৫ সেমি চওড়া এবং স্বাভাবিকভাবে ছড়ানো থাকে। ঘাসটি ছায়াতেও ভাল জন্মে এবং ঘন ঘন ছাঁটাই না করলেও সুন্দর দেখায়। চাপা ঘাসের লনের রক্ষণাবেক্ষণ খুব সহজ।
মে-জুন মাস লনে ঘাস লাগাবার উপযোগী সময়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে অন্য সময়ও একাজ করা যেতে পারে। নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে ঘাস লাগানো হয়।
বীজ বুনে: দূর্বাঘাসের বেলায় কোনো কোনো সময় এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বীজ বুনার আগে প্রথমে মাটিতে আঁচড়া (raking) দিয়ে নিতে হয় এবং বুনার পরে আবার আঁচড়া দিয়ে মাটির সাথে বীজ মিশিয়ে দিয়ে রোলিং করে মাটি চেপে দিতে হয়। হেক্টর প্রতি ১৭-২০ কিলোগ্রাম বীজ লাগে। লনের সর্বত্র যাতে একই ঘনত্বে বীজ পড়ে সেজন্য পুরো জমি ও বীজ সমান কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিয়ে বুনা ভাল। চারা গজাবার আগে সেচের প্রয়োজন হলে ঝাঁঝরী দিয়ে সেচ দিতে হবে। চারা ৫-৬ সেমি উঁচু হলে ছাঁটাই শুরু করতে হবে এবং তারপর ক্রমান্বয়ে মোয়িং ও রোলিং করে লন গড়ে তুলতে হবে।
কাণ্ড রোপণ করে (dibbling): ঘাসের ৫ সেমি লম্বা কাটিং একাকী অথবা গোছায় ঘন করে রোপণ করতে হয়। রোপণের পরই একবার সেচ দিতে হবে। কাটিং বসে গেলে রোলিং ও মোয়িং করতে হবে।
চাপড়া বসিয়ে (turfing): মাটিসহ ঘাসের চাপড়া পাশাপাশি বসিয়ে জমি আংশিক বা সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়া হয়। লন তৈরীর এটা দ্রুততম পদ্ধতি, কিন্তু অনেক সময় আগাছাবিহীন চাপড়া যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে পুকুরের ও বাঁধের পাড় বাঁধতে সাধারণত এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
লন রক্ষণাবেক্ষণ করার পদ্ধতি
আগাছা দমন, সার প্রয়োগ, সেচ, মোয়িং (mowing), রোলিং (rolling) ও পোকা দমন লন রক্ষণাবেক্ষণের প্রধান করণীয় কাজ। লন তৈরির প্রাথমিক পর্যায়েই আগাছার উৎপাত বেশি হয়। ফুল ধরার আগেই সব আগাছা তুলে ফেলতে হবে। লনে বছরে দু’বার সার প্রয়োগ করা উচিত। এপ্রিল-মে মাসে প্রতি ১০০ বর্গ মিটারে আধা কেজি ইউরিয়া বা দ্বিগুণ পরিমান অ্যামোনিয়াম সালফেট এবং আধা কেজি মিউরেট অব পটাশ এবং বর্ষার শেষে উপরোক্ত দুটি সার ও তার সাথে কিছু পরিমাণ টি.এস.পি বা হাড়ের গুঁড়ো প্রয়োগ করা যেতে পারে। অম্ল মাটির বেলায় তিন বছর অন্তর ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করা উচিত। প্রয়োজনবোধে এর অতিরিক্ত যে কোনো সার যে কোনো সময় প্রয়োগ করা যায়। লনে সেচের কোনো সুনির্দিষ্ট সময় নেই, ঘাসের প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। প্রতিবার সেচ দেয়ার সময় মাটি ভাল করে ভিজিয়ে দিতে হবে। ঘন ঘন পাতলা সেচ দিলে ঘাসের শিকড় গভীরে প্রবেশ করে না, ফলে ঘাস দুর্বল হয়। রোলিং ও মোয়িং-এর কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই, প্রয়োজন বিবেচনা করেই এসব করতে হবে। মাটি বেশি ভিজা অবস্থায় রোলার চালানো উচিত নয়। লন তৈরি হয়ে গেলে বছরে দু’একবার পাতলা রোলিং যথেষ্ট। উঁই, পিঁপড়া ও উরচুঙ্গা অনেক সময় লনের সৌন্দর্য নষ্ট করে।
এগুলো দমনের পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে দেখুন।
দু’তিন বছর পর পর লন ভারি আঁচড়া দিয়ে আঁচড়িয়ে ঘাসের মরা ও দীর্ঘ কাণ্ড উপড়ে এক সেন্টিমিটার পুরু ভিটি বালুর একটি স্তর ছড়িয়ে ভাল করে রোলিং করে দিলে ঘাস সতেজ হয়ে উঠবে।
পুরাতন লন পুনরুজ্জীবিত করা
সঠিকভাবে তৈরি করে যত্ন নিলে একটি লন ১০-১৫ বছর আকর্ষণীয় থাকে। কিন্তু অনেক সময় অযত্নে লন দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। স্থানে স্থানে ঘাস মরে গেলে, আগাছা প্রাধান্য পেলে, ঘাসের সবুজ ভাব নষ্ট হলে লনের সৌন্দর্যহানি ঘটে। নষ্ট হয়ে যাওয়া লনকে আবার সজীব করে তুলতে হলে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ক) প্রথমেই সব আগাছা নিড়ানি দিয়ে তুলে ফেলতে হবে।
(খ) আড়াআড়ি আঁচড়া দিয়ে সব মরা ঘাস তুলে ফেলতে হবে।
(গ) কোনো অংশের ঘাস মরে গেলে সেখানে চাপড়া বসিয়ে নতুন ঘাস লাগাতে হবে।
(ঘ) পচা গোবর ও পলিমাটির মিশ্রণের (১:২ হারে মিশ্রিত) ২ সেমি পুরু একটি স্তর লনের উপর ছড়িয়ে দিয়ে রোলিং করে তা মিশিয়ে দিতে হবে।
(ঙ) রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ও সেচ দিয়ে ঘাসের সবুজ ও সতেজ ভাব ফিরিয়ে আনতে হবে।
লনের অবস্থা বেশি খারাপ হলে অথবা এর পুনরুজ্জীবন অত্যন্ত ব্যয়বহুল মনে হলে পুরাতন লন নষ্ট করে দিয়ে সেখানে নতুন লন তৈরি করা বিধেয়।
তথ্যসূত্র:
১. ড. মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ, ফুলের চাষ, দিব্যপ্রকাশ ঢাকা, দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ বইমেলা ২০০৩, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।