মহাকাব্য ইলিয়াড’এ হেলেনের যে-অবস্থান সেটা ধ্বংসাত্মক। কিন্তু হোমারের (আনু ৯০৫ খৃঃ পূঃ) হেলেন ধ্বংসকামী অন্যসব মেয়েদের মতো নয়, স্বতন্ত্র । গ্রীক উপকথায় পুরুষের চোখে-দেখা ভয়ঙ্কর নারীমূর্তি বেশ কিছু আছে। যেমন মেডুসা। তিন বোন তারা। তাদের চোখের দিকে যদি কোনো পুরুষ তাকায় তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটি পরিণত হবে পাথরের স্তূপে, যদি মেডুসারা তেমন ইচ্ছা করে। গ্রীকদের আরেকটি উপকথায় আছে শার্সি। স্বামীঘাতকিনী। রাজত্ব করে এক দ্বীপে। মায়াবিনী এই নারী জাদু জানে, পুরুষ মানুষকে কাছে পেলে তাদেরকে কাবু করে ফেলে এবং পরিণত করে হীন পশুতে। জলপরীদেরও খবর পাই, বিশেষত তিনজনের, যারা অর্ধেক পাখি অর্ধেক মানবী; গান গায় মায়াবী সুরে ও স্বরে, নাবিকদের পথ ভুলিয়ে নিয়ে আসে পাহাড়ের কাছে, যাতে জাহাজসহ তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। গ্রীকদের রচিত কাহিনীতে খবর আছে এমাজনীয় মেয়েদেরও। এরা মায়াবিনী নয়, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা এবং ভয়ঙ্কর পুরুষবিদ্বেষী। তাদের জীবনে সন্তান প্রজনন ও যুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা ভিন্ন অন্য কোনো ব্যাপারে পুরুষের প্রয়োজন নেই। বক্ষের ডান স্তন কেটে এরা সমান করে নিয়েছে, যাতে ধনুক ধরতে সুবিধা হয়।
হেলেন এদের সকলের থেকে ভিন্ন। হেলেন অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল এবং বিপজ্জনক। অন্যের সে বিপদ ঘটায়, নিজেও বিপদে পড়ে। ক্ষয় হয়ে যায় প্রদীপের মতো।
ইলিয়াড’এ একদিকে আছে এন্ড্রোমাকি, অন্যদিকে হেলেন। দুই রাজপুত্রের দুই বধূ। ট্রয়ের প্রধান রাজকুমার হেক্টর, এন্ড্রোমাকি তার স্ত্রী। গৃহিণী, সন্তানবৎসল, স্বামী অন্তপ্রাণ। স্বামীকে যুদ্ধে যেতে দিতে চায় না এন্ড্রোমাকি, কেননা সে বিপদের আভাস পেয়েছে। এন্ড্রোমাকির বিপরীতে হেলেনের অবস্থান। হেলেন রাজপুত্র প্যারিসের স্ত্রী। প্যারিস হেক্টরের ৪৯ জন ভাইয়ের একজন। কিন্তু প্যারিসই সবচেয়ে বিতর্কিত, সর্বাধিক আলোচিত। তার জন্যই যুদ্ধ বেঁধেছে।
হেলেনকে পুরুষই সৃষ্টি করেছে, যেমন সৃষ্টি করেছে এন্ড্রোমাকিকে। একজন মাতা অন্যজন প্রেয়সী, শর্মিলা ও উর্মিমালা। কিন্তু যে-কোনো উর্মিমালার তুলনাতেই অসামান্য এই নারী। সুন্দর, এবং সুন্দর বলেই ধ্বংস করে। তার জন্য লড়াই বাধে। দশ বছর চলে সেই যুদ্ধ। কতো বীর মারা যায়; নিহত হয় হেক্টর, প্রাণ দেয় একিলিস। কতো অশ্রু, কতো আত্মবিসর্জন। ট্রয় পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো ওই বহ্নিশিখাতেই।
অপরাধটা কার? অপরাধ তো হেলেনের নয়। তার জন্মের জন্য সে দায়ী নয়, তার রূপের জন্যও নয়। হেলেন জিউসের কন্যা, তাই অতিমানবী—সৌন্দর্যে। তার মা লিডাও সুন্দরী ছিল । লিডা একদা স্নান করছিল জলে; দেবরাজ জিউস তার নগ্ন সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দেখা দিলো রাজহাঁসের ছদ্মবেশে। হাঁসের সঙ্গে রমণীর মিলনে অনিন্দ্যসুন্দরী হেলেনের জন্ম । জিউস তার জন্ম দিয়েছে, তাকে রূপও দিয়েছে, কিন্তু তার দায়িত্ব নেয় নি। দেবতাদের রাজাই হোক আর যাই হোক, হাজার হলেও পুরুষ তো । জিউস যেমন লোলুপ হয়েছিল হেলেনের মাতা লিডার প্রতি, তেমনি লোলুপতা মর্তের দুই বন্ধুও দেখিয়েছে কন্যা হেলেনের প্রতি। হেলেনের বয়স তখন মাত্র নয়। ওই বয়সের মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল দুই যুবক—বন্ধু তারা একে অপরের থিসিউস ও পিরিথৌস। তারপর যখন বয়স হয়েছে তখন গ্রীসের সাতাশ জন রাজপুত্র পাণিপ্রার্থী হয়েছে হেলেনের। হেলেন বেছে নিয়েছে স্পার্টার রাজা বীর মেনেলাউসকে।
সুখে আছে হেলেন তার স্বামীর সঙ্গে। একটি কন্যার মাতা সে। কিন্তু সুন্দর যেহেতু, তাই তার বিপদ কমে না।
তিন দেবীর মধ্যে এক সৌন্দর্য-প্রতিযোগিতা হয়েছে। হীরে, এথিনী ও এফ্রোদিতি— তিনজনের প্রত্যেকেই নিজেকে মনে করে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। কার চোখে? আবার কার— পুরুষের। পুরুষদেরই একজন বিচারক। প্যারিস, ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিসই ঠিক করে দেবে কে তাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দরী। এখনও তো তাই নিয়ম, পুরুষই বিচার করে নানা রকমের গজ-ফিতা ধরে। তিন দেবীর প্রত্যেকেই ঘুষ দিতে চাইলে পুরুষটিকে। হীরে বললো, আমি দেবো ঐশ্বর্য। এথিনী বললো, আমার কাছে আছে জ্ঞান। এফ্রোদিতি বললো, দেবো আমি সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে।
প্যারিস এফ্রোদিতিকেই দিলো সেই সোনার আপেলটি, যার গায়ে লেখা ছিল, ‘সেরা সুন্দরীর জন্য।’ বিনিময়ে পেলো সে মেনেলাউস-পত্নী হেলেনকে। তারপরে যুদ্ধ। শেষে প্রলয়। পুরুষেরই কাজ, সবটাই । হেলেন হচ্ছে অজুহাত ও ভুক্তভোগী।
অথচ ওই ব্যক্তিমানুষটির কথা শুনি না আমরা। পুরুষের কল্পনা হেলেনের সৌন্দর্য, তার লেলিহান শিখা, এসব নিয়ে ব্যস্ত। হোমারের আড়াই হাজার বছর পরে ইংরেজ কবি ডব্লু বি ইয়েটস খুব মর্মস্পর্শী কবিতা লিখেছেন একটি। না, হেলেনকে নিয়ে নয়। নিজের প্রেমিকা মড গনকে নিয়ে। কিন্তু হেলেনকে তিনি নিয়ে এসেছেন। হেলেন আসেই, হেলেন থাকেই। ইয়েটস তাঁর কবিতার নাম দিয়েছেন, ‘দ্বিতীয় ট্রয় নেই যে পোড়াবে।’ মড গন নামের সুন্দর মেয়েটি খুব জ্বালাতন করেছে কবিকে; তা ওই কাজ তো সে করবেই; সুন্দরী রমণী, আগুনের মতো, তার জন্য তো দ্বিতীয় একটা ট্রয় নেই যে সে পোড়াবে। ইয়েটসের একটি উপমায় সকল পুরুষের ভয় প্রতিফলিত। ‘ওই রমণী যেন টানটান ধনুক’; অর্থাৎ সে কিনা তীর ছুঁড়তে পারে— যে কোনো মুহূর্তে আহত করতে পারে পুরুষকে।
এটাই কাজ হেলেনের। কাজ ট্রয় পোড়ানো। যে মেয়ে প্রেয়সী ও সুন্দরী—তার আর কী করবার আছে জনপদ ধ্বংস করা ছাড়া? পুরুষেরই ধারণা এটা, চিরকালের পুরুষের; এবং মেয়েদেরও ধারণা, পুরুষের কারণে।
২.
কতটা সুন্দর ছিল এই হেলেন? যতটা কল্পনা করা যায় তার চেয়ে বেশি। না, কল্পনায় আসবে না। হোমার, অসামান্য যিনি যুদ্ধ ও কাহিনী বর্ণনায়, তিনিও হেলেনের রূপের কোনো বর্ণনা দেন নি। বোধকরি খাটো করতে চান নি তাকে মূর্তিমান করে। অনির্বচনীয় রেখে দিয়েছেন সেই অনিন্দ্য সুন্দরীকে।
তবে প্রতিক্রিয়া দেখি, দেখে কল্পনা করতে পারি আমরা কেমন ছিল ওই নারী। নিজে নিজেই কল্পনা করি, মিশিয়ে দিই আপন মনের মাধুরী। যুদ্ধ চলছে বছরের পর বছর ধরে, ধ্বংসের আশঙ্কা; এরই মধ্যে একদিন বিরতি ছিল, বলা যায় ক্ষণিকের। হেলেন তখন হেঁটে আসছিল ট্রয় নগরের তোরণের দিকে। নগরের বৃদ্ধরা রাজপথে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিল নিজেদের মধ্যে। হেলেনকে দেখে তারা চোখ নামিয়ে নিল। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললো একে অপরকে—‘এই তো সেই মেয়ে। কিন্তু কে আছে এমন পাষাণহৃদয় যে ট্রোজান ও গ্রীকদের বদনাম করবে এমন একটি নারীর জন্য এতো দীর্ঘ সময় ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বলে? এ মেয়ে তো মানবী নয়, দেবীর মূর্তি, যদিও মাটিতে-গড়া।’ তাদের কথা ওইটুকুই, বাকিটা বুঝে নেবার দায়িত্ব আমাদের।
হোমারের দু’হাজার বছর পরে ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটকে ডক্টর ফস্টাস বলছেন শুনি হেলেনকে, ‘এই কি সেই মুখ যার জন্য হাজার জাহাজ সমুদ্রে ভেসেছে, পুড়ে ছাই হয়েছে অতিউচ্চ ট্রয়?’ তারও চারশ’ বছর পরে আরেক ইংরেজ কবি টেনিসন স্বপ্নে দেখেছেন হেলেনকে । দেখলেন মর্মর পাথর কেটে-গড়া যে-কোনো মূর্তির চেয়ে শান্ত একটি নারী। কবি বলছেন, “দীর্ঘকায় দেবীদের মতো। অতিপ্রাকৃতিক রকমের ফর্সা। লজ্জা এসে মিশেছে তার সৌন্দর্যের সঙ্গে। দেখে একেবারে বাকহারা হয়ে গেছি আমি। সেই নারী তাকালো আমার দিকে ঘুরে, মৃত্যুহীন তার দু’চোখ তারার মতো জ্বলজ্বল করছে দুঃখ; খুব ধীরে বললো সে—‘আমি খুব সুন্দর ছিলাম, আমার নাম জানতে চেয়ো না তুমি। আমার জন্য বহুজন যুদ্ধ করেছে এবং ধ্বংস হয়ে গেছে। যেখানে গেছি আমি সেখানেই ধ্বংস নিয়ে এসেছি’।” শুনে কবি বলছেন, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে বলুন। ইচ্ছে করে আমিও প্রাণ দিই, আপনার জন্য।’
লজ্জা তো হেলেনের নয়। লজ্জা রাজপুত্র প্যারিসের, লজ্জা দেবী এফ্রোদিতির, যারা দায়ী তার এই পরিণতির জন্য। কিন্তু হেলেন যেহেতু মানুষও, তাই তার লজ্জা আছে । আছে আরো বহুবিধ মানবিক অনুভূতি, যাদের খবর কেউ রাখে না, হোমার রাখেন। তিনি মহাকবি, খবর তাঁকে রাখতে হয়। কিন্তু ‘ইলিয়াডে’ তো তিনি গার্হস্থ্য জীবনের কথা বলছেন না, ব্যক্তিজীবন সেখানে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক; তার মহাকাব্য যুদ্ধের, সেখানে শক্তি পরীক্ষা চলছে বীরের সঙ্গে বীরের, যাতে জড়িত হয়ে পড়েছে দেব-দেবীরা অধিকাংশই, নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না দেবরাজ জিউসও। তবু এরি মধ্যে চকিতে দেখি আমরা হেলেনকে, শুনি তার মৃদুকণ্ঠ। হোমার নাটকের লেখক নন, লেখক তিনি মহাকাব্যের। জীবনের নানা মাত্রাকে তিনি নিয়ে এসেছেন তাঁর লেখায়।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রায় পালিয়ে এসেছে প্যারিস। ফিরে এসে দেখা করেছে হেলেনের সঙ্গে। প্যারিসের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহাবীর হেক্টর এসেছেন, সঙ্গত কারণেই তিরস্কার করেছেন কনিষ্ঠ প্যারিসকে। জবাবে প্যারিস বলছে, ‘হেলেনও আমাকে ওই কথাই বলেছিল। শান্ত কণ্ঠে বলেছিল আমার কি কর্তব্য। যাচ্ছি, ভাই আবার আমি ফেরৎ যাচ্ছি যুদ্ধে।’
এইবার হেলেন বলেছে তার মনের কথা, নিজের মতো করে বলেছে, ‘হেক্টর, ভাই আমার, আমি লজ্জাহীন এক নারী। আমি হচ্ছি অমঙ্গল, আমি ঘৃণ্য। হায়, আমার জন্মমুহূর্তে কেন ঝড় উঠলো না। ঝড় কেন উড়িয়ে নিয়ে গেলো না আমাকে পাহাড়-পর্বতের ওপর দিয়ে। নিক্ষেপ করলো না কেন সমুদ্রে। দেবতারা ষড়যন্ত্রকারী, তারা আমাকে সাহায্য করে নি। আমার কারণেই এসব ঘটেছে।’
দ্বিতীয়বার শুনি তার কণ্ঠস্বর, ভিন্ন এক পরিপ্রেক্ষিতে। দেয়াল-ঘেরা ট্রয় নগরের দ্বারপ্রান্তে হেলেন ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে, তার বৃদ্ধ শ্বশুর প্রায়ামের পাশে । তখন সাময়িক যুদ্ধবিরতি চলছে। প্রায়াম বললেন, ‘এসো মা, আমার পাশে বসো। ওই যে দেখো গ্রীক বীরদেরকে দেখা যাচ্ছে। ওদের মধ্যে তোমার স্বামী রয়েছে, আছে তোমার ভাই, আছে বন্ধু। দেখ তো চিনতে পারো কি না।’ হেলেন বললো, ‘বাবা, আমার কেন মৃত্যু হয় নি, আপনার পুত্রের সঙ্গে এখানে আসার আগে? আমি স্বামীর শয্যা ছেড়ে এসেছি, ছেড়ে এসেছি একমাত্র কন্যাকে, ফেলে এসেছি বন্ধুদের।’ তারপর একে একে চিনিয়ে দিলো সে গ্রীকদের। বললো না শুধু একজনের কথা, স্বামী মেনেলাউসের কথা। লজ্জায় তার চোখ খুঁজে বেড়ালো তারই সঙ্গে ভূমিষ্ঠ-হওয়া যমজ দুই ভাইকে। না, তারা নেই। তবে কি তারা আসে নি? নাকি এসে লুকিয়ে আছে, সঙ্কোচে, বোনের কথা স্মরণ করে?
হেলেন এখানে অগ্নি নয়, প্রেয়সী নয়, জলভারে নত সে, অন্যমূর্তি তার, মাতার কাছাকাছি। সেই ভিন্ন রূপেই আবার দেখি তাকে। শেষবার, ওই মহাকাব্যে। হেক্টর নিহত হয়েছে, যুদ্ধেক্ষেত্রে। তার লাশ নিয়ে চলে গেছে গ্রীক বীর একিলিস। ট্রয় নগরীতে ক্রন্দনের রোল। কাঁদছে মাতা, কাঁদছে স্ত্রী, কাঁদছে ভ্রাতৃবধূ হেলেন। চোখের পানিতে একাকার হয়ে বিলাপ করে বলছে সে, ‘হেক্টর, ট্রয়ে আমার ভাইদের ভেতর আপনাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম । রাজপুত্র প্যারিস আমাকে নিয়ে এসেছে, এনে বিয়ে করেছে । (হায়, তার আগেই কেন আমার মৃত্যু হয় নি।) আজ উনিশ বছর আছি এই নগরে, উনিশ বছর আমি আমার দেশের বাইরে, এই সময়ে শুধু আপনার কাছ থেকেই কোনো দিন একটি কঠিন কি বক্র উক্তি আমি শুনি নি। একটিও নয়, কখনো নয়। রাজবাড়িতে অন্যরা আমাকে অপমান করেছে। আপনার ভাইরা, বোনেরা, ভাইদের ধনী স্ত্রীরা, আপনার মাতা; সবাই। কেবল আপনার পিতা আমাকে দেখেছেন তার আপন মেয়ের মতো। আর আপনি, ভাই আমার, সর্বদা প্রতিবাদ করেছেন। এই দেখুন, তাই তো আমি কাঁদছি, আপনার জন্য। কেউ আমাকে ছেড়ে কথা বলে নি। কাঁদছি আমার নিজের জন্যেও। এই নগরে তো আমার বান্ধব বলতে আর কেউ রইলো না। সবাই তো আমাকে দেখে শিউরে ওঠে।’
৩.
প্রেয়সী নয়, মাতা হিসেবে হেলেনকে দেখি আমরা হোমারের দ্বিতীয় মহাকাব্য ‘অডিসি’তে । ওই কাব্যের তৃতীয় সর্গে অডিসিয়ুসের পুত্র টেলেমেকাস মেনেলাউসের দরবারে এসেছে তার হারানো পিতার খোঁজে। যুদ্ধ তখন শেষ হয়ে গেছে। জীবিত যারা, ফিরে গেছে নিজ নিজ দেশে। অডিসিয়ুস ফেরেন নি, যেমন ফেরে নি আরো কেউ কেউ।
মেনেলাউস ফেরত পেয়েছে তার স্ত্রী হেলেনকে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। হেলেন এখন প্রেয়সী নয়, মাতা। তার সন্তানদের বিয়ে হয়ে গেছে। সন্তান জন্মের বয়স পার হয়ে গেছে দেখে মেনেলাউস এক দাসীর গর্ভে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে; যা থেকে বুঝি আমরা পুরুষশাসিত ওই দাস-সমাজে নারীর মর্যদাটা ছিল কোথায় ও কতটা।
অন্তঃপুর ছেড়ে সেদিন হেলেন এসেছে রাজদরবারে। কি ঘটছে দেখতে। চোখ পড়েছে অডিসিয়ুসের পুত্রের ওপর। তাকে এর আগে কখনো দেখে নি হেলেন। কি করে দেখবে, ওর যখন জন্ম হেলেন তো তখন শত্রুর দেশে। কিন্তু অডিসিয়ুসকে চেনে সে। টেলেমেকাসকে দেখে হেলেনের মনে হয়েছে নিশ্চয়ই অডিসিয়ুসের পুত্র হবে । মাতা হেলেনের চোখে সেই সত্য ধরা পড়েছে অডিসিয়ুসের সহযোদ্ধা মেনেলাউসের চোখে যা ধরা পড়ে নি।
পরিচয় ও মিলনের এই দৃশ্যে শোকাভিভূত সকলেই। হেলেন নিজেও। কিন্তু হেলেনকে দেখছি দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে পরিস্থিতির। যে মদ্যপান করতে দেওয়া হয়েছে সবাইকে তাতে গোপনে ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছে সে। ওষুধ কিছু নয়, বেদনানাশক। মিসরের এক মহিলা অনেক কয়টা উপকারী জিনিস উপহার দিয়েছিল হেলেনকে, এই বেদনানাশক তাদেরই একটি । হেলেন জানে শোকের স্মৃতি ও দুঃখ সহ্য করা কঠিন হবে, সবার পক্ষেই । তাই ওই ওষুধ খাওয়ানো। ফল হয়েছে। শান্ত হয়েছে সবাই। বিলাপ না-করে, ধীরে ধীরে স্মরণ করেছে ঘটনা। মেনেলাউস বলেছে অডিসিয়ুসের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার কথা। মনে পড়েছে তার ট্রয়ের ঘোড়ার ঘটনা।
সেই কাহিনীতে হেলেন এসে যায়। প্রলয় শিখা হিসাবে নয়, ভিন্ন মূর্তিতে। অডিসিয়ুস তার প্রকাণ্ড সেই কাঠের ঘোড়া তৈরি করার আগে সরেজমিনে দেখার জন্য ট্রয় গিয়েছিলেন। ছদ্মবেশে। ক্ষুধায় কাতর, জীর্ণশীর্ণ এক ভিক্ষুককে দেখা গেছে ট্রয়ের রাজপথে। কেউ তাকে চেনে নি। কিন্তু হেলেন চিনে ফেলেছে ঠিকই। তখন হেলেনের কাছে নিজের পরিকল্পনাটি বলেছেন অডিসিয়ুস। এই ঘটনা হেক্টরের মৃত্যুর অনেক পরে ঘটেছে। যুদ্ধের শেষ অবস্থায়। ততদিনে প্যারিসের প্রতি হেলেনের মোহ গেছে কেটে। অডিসিয়ুস জানিয়ে গেছেন ঘোড়া তৈরি করবেন, ঘোড়ার ভেতর গ্রীক বীরেরা সবাই বসে থাকবে, ঘোড়া যদি ট্রোজানরা নগরের ভেতরে টেনে আনে, তবেই কাজ হয়ে যাবে, হাতেনাতে দেখিয়ে দেবেন অডিসিয়ুস, কি করা যায়।
তারপর সত্যি সত্যি ঘোড়া এলো নগরে। রাতের অন্ধকারে হেলেন এসে দেখলো গ্রীকদের সেই অশ্বকে। কাঠের ঘোড়াটির চারদিকে সে তিন তিন বার ঘুরে গেলো। ঘোড়ার গায়ে হাত বুলালো এবং গ্রীক স্ত্রীদের গলা নকল করে স্বামীদের নাম ধরে ধরে ডাকলো। আরেক নারী তখন সে, বিপদেও পরিহাসপ্রবণ।
টেলেমিকাসকে পেয়ে মেনেলাউস পুরোনো দিনের গল্প বলে। হেলেন বলে না। হেলেনের অন্য দায়িত্ব আছে। যত্ন নিতে হবে অতিথিদের। সে তা-ই নেয়।
এই হচ্ছে হেলেন। অন্য সবার কাছে শুধুই অগ্নিশিখা, ধ্বংসের দূত, প্রেয়সী ইত্যাদি; কিন্তু হোমারের কাছে সে মাতাও।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন গ্রন্থের এই লেখাটি নেয়া হয়েছে লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উক্ত বইয়ের ১৩-১৮ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে। বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করে বিদ্যাপ্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০০-এ। অশোক পুস্তকালয়, এপ্রিল ২০১১, কলকাতা থেকে বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়। আমরা এই লেখাটি অশোক পুস্তকালয় প্রকাশিত সংস্করণ থেকে রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশ করেছি। গ্রন্থে প্রবন্ধটির নাম ছিল “হোমারের হেলেন”। বর্তমান শিরোনামটি রোদ্দুরের দেয়া।
“জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি” এবং “বাঙালীর জাতীয়তাবাদ” গ্রন্থের লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য এবং প্রগতিশীল মার্কসবাদী আন্দোলনে প্রভূত অবদান রেখে এই লেখক এখন জীবন্ত কিংবদন্তি। ২৩ জুন, ১৯৩৬ তারিখে জন্মগ্রহণ কারী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত।