কামিনী রায় (অক্টোবর ১২, ১৮৬৪ – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯৩৩) কবিতা লিখেছিলেন বাঙালির রাজনীতি সূচনা হওয়ার প্রথম বছরগুলোতে, যখন নারীরা ঘর হতে বেরই হতে পারেনি। বাঙালির বা ভারতের প্রথম অনার্স পাস নারী গ্রাজুয়েট তিনি। কামিনী রায় প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণ করেই নিজেকে প্রচলিত পথে বিলীন করেননি; একটি অসাধ্য সাধনে তৎপর হয়েছিলেন, লিখতে শুরু করেছিলেন কবিতা যা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজও।
তিনি জন্মেছিলেন বরিশাল জেলার বাসণ্ডা গ্রামে ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর। তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক উপন্যাসিক চণ্ডিচরণ সেনের কন্যা। কর্মজীবনে বেথুন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। মারা গেছিলেন ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর।
কামিনী রায় কবিতা লেখার শুরুতেই মধ্যযুগের নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং মহাজগতকে পরস্পর বিরুদ্ধ শব্দ দ্বারা চিনতে শিখেছিলেন। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটির নাম ছিলো আলো ও ছায়া। পৃথিবীকে ও তার বস্তুসমূহকে সাদা-কালো, আলো-আঁধার, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি বিপরীত শব্দ দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এবং পরপর বিপরীত শব্দগুলো দ্বারা কবিতার বাক্য গঠন করেছিলেন। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে; যেমন— ‘কেউ হাসে, কাঁদে কেউ/…..দুঃখে-সুখ রয়েছে বাঁচিয়া’, ‘জীবন ও মরণের খেলা’, ‘ভাসাইয়া ক্ষুদ্র তরী, দিবালোকে, অন্ধকারে’, জীবন-মরণ একই মতন’, ‘মুক্তবন্দি’ ইত্যাদি অনেক ধরণের বাক্য তিনি ব্যবহার করেছেন। বাঙালি প্রায় সব কালেই সবকিছুকে এরকম পরস্প র-বিরুদ্ধ ভাব দ্বারা ব্যাখ্যা করেছে যা দ্বান্দ্বিক হলেও যান্ত্রিকতা-দোষে দুষ্ট ও অবৈজ্ঞানিক; সাদা-কালোর মাঝেও অনেক স্তর রয়েছে; মানুষ শুধু ভালো বা মন্দ নয়, সে আরো অনেক কিছু; আলো-অন্ধকার নিয়েই মানুষের জীবন নয়, জীবনের নানা দিকে রয়েছে বৈচিত্রের বর্ণিল সমাহার। এরকম বিস্তৃত জায়গাতে মানুষকে কামিনী রায় দেখেছেন সাদা চোখে একদেশদর্শি মানুষের চিন্তার মতো।
কামিনী রায়ের কবিতায় বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমন আশা-নিরাশা, হর্ষ-বিষাদ, অবসাদ, আর্তনাদ, সুখ-দুঃখ, স্বর্গ-মর্ত, ভয়, আলো-আঁধার, অশ্রু, জীবন-মরণ, মলিন, শোক, বেদনা, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদির দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি জীবনের ইতি ও নেতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে তিনি জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, দুঃখ, বিষাদকেই প্রধান বিষয় করে তুলেছেন।
কামিনী রায়ের ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনের কারণেই তার কবিতায় এসেছে হতাশার সুর যা শোকাশ্রয়ি অশ্রুসংগীত হয়ে বেজে উঠেছে; একদিকে মধ্যযুগ প্রভাবিত পরমাত্মার সংগে জীবাত্মার মিলনের চেতনা, অন্যদিকে স্বামী বা প্রভু নামক ভাতারের পদতলে নিজেকে বিলীন করে ধন্য হবার বোধ, মা নামক ধারণার নিচে বলি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সন্তানের মঙ্গলের জন্য সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকা; এই চারটি ক্ষেত্রে বাস্তবিক ব্যর্থতাই কামিনী রায়কে করে তোলে মর্ষকামি। প্রথমে ১৯০৯ সালে দূর্ঘটনায় স্বামী মরেছে, তার চার বছর পরে মরেছে পুত্রসন্তান অশোক, ১৯২০ সালে মারা গেছে কন্যা লীলা; হতাশার পর হতাশায় নিমজ্জিত তিনিও কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) মতো চলে গেছেন ঈশ্বরের কাছে; লিখেছেন ‘হে ঐশ্বর্যবান,’ কেড়ে নিলে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ দান তব_প্রাণের সন্তান’। ভাবখানা এমন যেন সন্তানই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধন; একজন বাঙালি ভিখারিনী বা অভাবি নারীর যেমন সন্তানকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে তেমনি তিনিও একইরকম ভেবেছেন এবং এই উক্তি দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে বাঙালির সামগ্রিক ব্যর্থতার পরিপূর্ণ রূপের খণ্ডিত অংশ।
কামিনী রায়ের চিন্তার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মধ্যযুগিয় অলৌকিকতা, ঈশ্বরমুখিনতা, আধ্যত্মিকতা; সকল কর্মের কেন্দ্রে তিনি আকাশের ওইপারের অদৃশ্য শক্তির প্রকাশ দেখেছেন; যেমন— ‘তুমি শক্তিমান/দিতে পার, নিতে পার;’, ‘দুঃসহ এ জ্যোতির মাঝার অন্ধবত ঘুরিয়া বেড়াই’; এসেছে পুনর্জন্মের কথাও, ‘ক্ষুদ্র দীপ যদি নিভে যায়,/… কে বলিতে পারে/ জ্বলিবে না সে যে পুনরায়?’ ‘কোথায়’ কবিতায় জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে ঈশ্বর, পৃথিবীতে ঘন আঁধার, তার উপরে দুঃখের বিধান; পরবাসি কবি তাই ভাবেন ঈশ্বর পার করবে তাঁকে দূর্বল হাত ধরে, নিয়ে যাবে তাকে ‘আলোকধামে’।
‘হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর,/ দুঃখিনী জন্মভূমি,— মা আমার, মা আমার’— এই দুঃখিনী জন্মভূমির জন্য যে আত্মত্যগের ব্রত, তাই বারবার প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতায়। মৃত্যুকে তিনি জীবনের অংশরূপেই দেখেন এবং তাই নির্ভীকভাবে কামনা করেন; লিখেছেন ‘মরিব জন্মভূমির জন্যই’।
দেশপ্রেম অবশ্যই প্রয়োজন এবং তা হওয়া উচিত যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু বাঙালির দেশপ্রেমের সংগে যুক্তিহীন আবেগের আধিক্য ও অতিরিক্ত আত্মত্যাগের প্রবণতা বাঙালির ক্ষতির কারণ হয়েছে। বাঙালি আত্মত্যাগ করেছে প্রচুর, কিন্তু সংগ্রামের অর্জনগুলোকে নিজেদের কাছে রাখতে পারেনি। এরকম সীমাবদ্ধতার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার কিছু কবিতায়। তিনি নিজেকে ‘জগতের পায়ে বিসর্জন’ দিতে চাইলেও বিসর্জনের শক্তি তাকে চাইতে হয়েছে দেবতার কাছে। একটি ক্ষুদ্র ব্রত সম্পন্ন করার ‘আকাঙ্খা’ তিনি সারা জীবন করতে চেয়েছেন, কিন্তু চরিতার্থতার পথ খুঁজে পাননি। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত নির্মাল্য কাব্যের যে ‘আকাঙ্খা’ সেটিই সুস্পষ্ট হয়েছে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘দীপ ও ধূপ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে। তার বহু আগেই প্রথম গ্রন্থের ‘সুখ’ কবিতাটিতে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন নিজের স্বার্থ বলি দিয়ে ‘পরের কারণে’ ‘এ-জীবন মন সকলি দাও’ এবং নিজের কথা ভুলে যাওয়াকেই ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ সুখ বলে। তার ‘দীপ ও ধূপ’ কাব্যগ্রন্থের নামটিই প্রকাশ করে শুধু আলো জ্বালালেই হবে না, সুগন্ধও ছড়াতে হবে। সেই সুগন্ধই ‘নব জাগরণ’-এর গান হয়ে ঘোষণা করে ‘জীবনের ইহকুলে যাহা করণীয়/ কর আজ …. মান দাও মানবেরে— সে যে বরণীয়/। মনে তার দাও জ্ঞান, অন্ন মুখে তার’।
ভারতাত্মা জেগেছিলো এ-পৃথিবীর সকলের আগে। আমরা এখন দেখছি সেই একদা জাগ্রত ভারত আজ পরাধীন। যে ভারতীয়রা একদা সকলকে ভাষা দিয়েছিলো সেই ভারতীয়রা এখন নিজেদেরকে শাসন করতে পারে না; ইউরোপীয় বেনিয়ারা এসেছে ভারতকে লুট করতে, আর ভারত-সন্তানেরা ডুব দিয়েছে অন্ধকারে। সেই অন্ধকার সময়ে কামিনী রায় ঘোষণা দেন কবিতায় ‘জ্ঞানে, প্রেমে, কর্মে দৈন্য হবে অবসান’; এরকম দৃপ্ত উচ্চারণ আপ্লুত করে আমাদের। ‘মান দাও মানবেরে’- কথাটির সংগে চণ্ডিদাসের সবার উপরে মানুষ সত্য কথাটির মিল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই ভারতীয়রা ‘ক্ষুধার পীড়নে আর পর পদাঘাতে’ থাকতে পারে না, তারা জেগে উঠবেই।
উনিশ শতকে বাংলা ভাষা হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে, এমনি সময়ে এসেছে জাতি গঠনের প্রসঙ্গ। তখন দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন হাজার হাজার বঙ্গ-সন্তানের; সেই দামাল সন্তানদের মায়েদেরকে উদ্দেশ্য করে কামিনী রায় বলছেন হে মায়েরা, তোমাদের সন্তান শুধু তোমাদের নয়, শতেক মায়ের ছেলে সে, ‘দেশের তরে, দশের তরে’ সেই সন্তান। সেই সন্তানের জয় মানেই উঠন্ত একটি জাতির জয়। অতএব সন্তানকে দেশের কাজে পাঠাতে কোনো মায়েরই দ্বিধা কাম্য নয়। তাই তো আমরা বিশ শতকে পাচ্ছি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫)-কে যিনি ভারত মাতাকে মুক্ত করতে সারা পৃথিবীর পথে ছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৭০-১৯২৫)-কে কারাগারে দেখে স্বপ্নের দেশের কল্পফুল দিয়ে কবি কামিনী রায় লেখেন কবিতা ‘বন্দিমুক্তি’। ‘নব সূর্যোদয়’ দেখা যায় বাঙালির দুটি মহত মানুষের কারা প্রকোষ্ঠের সহাবস্থানে। বাঙালির প্রাণের সন্তানেরা লড়ছে, ভবিষ্যত আসছে ভারতের সামনে, সাহসে অটল সেই নেতাই তো প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনে দেবার; আর কবি জনগণের কাতারে নেমে লেখেন ‘মাঝি-মাল্লা, তাঁতি জোলা সবাই আমার’।
আধ্যাত্মিকতা দ্বারা প্রভাবিত হবার কারণে সর্বদাই কামিনী রায় সহজ আশাবাদি, যদিও দুঃখে তিনি যথেষ্ট পুড়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন, একতায় বলিয়ান ভারতসন্তান আসছে, নারী-শিশুরা ‘উন্নত কামনা ভরে’ উল্লাসে গাইছে বিজয়ের গান। বাঙালির সহজ-সরল অনুভূতি যেমন— অভিমান, সুখ, দুখ, আনন্দ, বেদনা, অন্ধকার, বিষাদ, বিসর্জন, অশ্রু, সংকীর্ণতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করলেও তিনি শেষ দুটি গ্রন্থে আশাবাদি হয়ে গেছেন এবং সেই বই-দুটোর কবিতাগুলোতে সমাজ ও রাজনীতিমনস্কতা তুলে ধরেছেন।
শেষ কালে কী তিনি সংশয়ী হয়ে উঠেছিলেন? ‘দুর্বলের ক্রন্দন’ কবিতায় তিনি লিখছেন ‘তুমি নাকি ধর্মরাজ?/… দূর্বৃত্তের দিবে মান সম্ভার,/ পুণ্যাত্মারে দিবে লাজ? পক্ষপাতী ধর্মরাজ’। এখানে মনে হবে ধর্মরাজের প্রতি আস্থা দৃঢ় থাকেনি; কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটি তা নয়। তিনি সেই নিদ্রিত দেবতাকে জাগতে বলেছিলেন? অনেকটা রামপ্রসাদ সেনের (১৭২০-১৭৮০) মতো, মা কালীর প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না, আবার তাকে অবিশ্বাসও করতে পারছেন না; শেষ পর্যন্ত দেবতার পদতলেই আত্মসমর্পণ করছেন। ‘বিশ্বের পালক’ যে কাজের জন্য দেশ সেবককে পৃথিবীতে এনেছেন সেই কাজ সুচারুরূপে করিয়ে নেয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করেছেন।
নারীমুক্তির আকুতি আছে কিন্তু কীভাবে নারীমুক্তি হবে তার কোনো কর্মসূচি নেই তার কবিতায়। তিনি বিপ্লবী তো ননই, এমনকি সংস্কারকও নন; তবে তিনি পরিবর্তন আনতে চান, বৈষম্য ও নির্যাতনকে সহনশীল পর্যায়ে নামাতে চান। তিনি লিখেছেন, ‘দাসত্বের ভেঙে হাতকড়া/ শাসনের ছিঁড়ে দড়ি-দড়া/ ছুটিয়াছে মুক্তি অনুরাগে/ যজ্ঞের বেদির পুরোভাগে’; কিংবা পুরুষকে তিনি অনুরোধ করছেন, ‘খুলিয়া শৃঙ্খল ভাঙিয়া পিঞ্জর,/ শিখাও চলিতে ধরি তার কর’ এবং তিনি একইসাথে পাষণ্ড পুরুষকে প্রশ্ন করছেন ‘স্বদেশি বধুরে অপমান করে,/ তখন পাওনা লাজ?’। তিনি পুরুষদেরকে আরো বলছেন ‘হে ভণ্ড ধার্মিক’ তোমায় ‘ধিক শত ধিক’। ‘নবীনা জননীর প্রতি’ কামিনী রায় বলছেন তোমরা এমন সন্তান জন্ম দাও যারা ‘কাটিয়া পাথর, দলিয়া কাঁটা’ দূরারোহ গিরিতে আরোহন করবে। ঠিক একইভাবে প্রায় তিন দশক পরে কুসুম কুমারী দাশ (১৮৮২-১৯৪৮)ও চেয়েছিলেন ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ ।
প্রচলিত বাঙালি নারীর সংসারকামনাকে তিনি কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন এবং বিবাহের পর তিনি ঘোষণা করেছিলেন ‘সংসারই আমার কবিতা’; এই কথা বলার পর ছেড়ে দিয়েছিলেন কবিতা লেখা। স্বামীর মৃত্যুর পর আবার শুরু করেন কবিতা লেখা এবং এই কবিতাতেই তিনি দেখাচ্ছেন ‘সংসার মরীচিকাময়ী’; তদুপরি মানুষ আশার ছলনে পুড়ছে মরে। গৃহহীন এই মানুষ গৃহের সন্ধান করছে আজীবন কিন্তু সংসারে ও গৃহে থাকতে সংসার বা গৃহের মূল্য বুঝতে পারছে না। কামিনী রায়ের কাছে সংসার সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাই মহত। সংসার যে অ-সুখের— এই জ্ঞান হয়েছে স্বর্গীয় প্রেমকে অপাত্রে দান করে।
কামিনী রায়ের প্রেম নম্র, লাজুক, নরম, কোমল। প্রেম তাকে অনুরাগী, অভিমানী ও ভক্তিবিহবল করে তুলে ‘প্রিয় দেবপ্রতিমারে’ ছোঁয়ার আকাঙ্খা জাগায়। প্রেমে তিনি বিদ্রোহীও নন, তীব্র আবেগহীনও নন; তিনি প্রেমের সাথেই দেখেছেন যন্ত্রণা, হাহাকার, অশ্রু, কণ্টকের স্তুপ। এই প্রেমের মূলভাবে তিনি সর্বত্রই মধ্যযুগের আধ্যাত্মিকতা দ্বারা প্রভাবিত। প্রেমিক প্রেমিকাকে পরিত্যাগ করলেও হঠাত প্রেমিকের মনে স্মৃতি জেগে উঠবে— এইটুকুকেই সারাজীবনের সফলতারূপে জেনেছেন ও বুঝেছেন আমাদের এই কবি। ‘যবে ছিল ভালোবাসা’ কবিতায় কবির অস হায় অনুভূতি, ব্যাকুল আকাঙ্খা, পুরুষের মনে ঠাঁই পাবার উন্মত্ত কামনা ফুটে উঠেছে। ‘মুগ্ধ প্রণয়’ কবিতায় দেখা যায় প্রেমিক গড়লো চারুমূর্তি, দেবতা সেই প্রতিমায় জীবন দিলো; এই প্রতিমা যদি নারীরূপ হয় তবে নারীও বিধাতার প্রেমে দেবী হতে পারে। আমরা তো ভাবতে পারি, কামিনী রায়ের নিজ জীবনের ব্যর্থতা তাকে দেবী হবার আকাঙ্খায় নিয়ে গেছে। ‘যমুনা কল্পনা’য় কবি যমুনার জল দেখেন, সেই জলের শব্দ শোনেন, যে শব্দ আসলে প্রেমের স্মৃতি, বিরহের গান; সেই যমুনার জলে ভোরে স্নান করে পুণ্য অর্জন করেন, সেই জলপান করে বিশ্বের প্রেমই যেন পান করেন। যমুনার কল্পনা আসলে প্রেমেরই কল্পনা যেখানে ডুব দিয়ে পৃথিবীর বাঁধন সহসা খুলে যাবে।
সেই রকম বাঁধা কী আসলে আছে? তদুপরি হতাশ জীবনে স্বার্থপরের মতো আমাদের কখনো ভুল করে মনে হতেই পারে আমাকে কেন্দ্র করেই তো ঘুরছে পৃথিবী, সেই পৃথিবী ছেড়ে ব্যক্তিগত প্রেম যমুনায় ডুব দিয়ে অচরিতার্থ জীবনকে চরিতার্থ করি;_যা আসলে আরেকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ‘কোথা ছিনু আসিনু কোথায়’ কবিতায় দেখি বের হবার ডাক শুনেও বের হতে ভীত এক কবিকে। বাইরের ঝড়, বৃষ্টি, বজ্র, রৌদ্র কবির কানে ব্যথা দিতে পারছে না। নিজের ঘর ভেঙে গেছে, আর নিজের ঘর ভেঙেছে বলেই অন্ধত্বের পর দৃষ্টি এসেছে; কবি ‘আঁধারের সুখ’ চান না, বরং দেখতে চান ‘প্রিয়তমের মুখ’ যে মুখ ঘর ভাঙার দুঃখকে ভুলিয়ে দেবে, যে মুখ দেবে সাহস।
আলো ও ছায়া (১৮৮৯) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ— যাতে নিঃসঙ্গতা, জীবন সম্পর্কিত প্রশ্ন, জগতবোধ, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি খাপছাড়াভাবে ফুটে উঠেছে। এ-বইটিতে কবি অত্যন্ত জটিল ও অদৃশ্য অনেক কিছুকে নিয়ে ভাবিত থেকে কবিতা লেখার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রকৃতি দেখে তিনি জীবন ও মরণের সমাধান খুঁজে পাননি; তিনি জগতে সুখের উৎসব দেখেছেন অথচ তার মন কাঁদে; এ-কান্না তিনি থামাতে চাইছেন, কেননা জগতের সর্বত্র সবকিছুই গাইছে গান, যে গান দীপ ও ধূপ (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে হয়ে গেছে ভারতমাতার নবজাগরণের গান। গোটা দেশ ঘুরে তিনি দুঃখ পেয়েছেন; কিন্তু নিজের মনের মধ্যে অবতরণ করে পেয়েছেন অবাক করা জগত। নিজেকে ভুলে নিজের মনের মধ্যে পেয়েছেন ‘সৌন্দর্য সাগর’ যেখানে মগ্ন থেকেছেন এবং পেয়েছেন সুখ, পেয়েছেন ‘নির্বাণ’।
গোটা দেশ ঘুরে দুঃখ পেলেও সেই ‘দুঃখ পথে’ কোলাহলময় ‘ঘন জনতার মাঝে’ সারাদিন থেকেও পুর্ণতা পাননি। অবাক হয়েছেন নিজের মনের সাথে একলা বসে কথা বলে; হৃদয়ের নিভৃতকক্ষে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। এই একলা বসে মনের সাথে কথা বলাই নিজেকে আবিষ্কার, নিজের শক্তিকে চেনা; যে শক্তির বলে তিনি চিহ্ন রেখেছেন বাংলা কবিতায়। তিনি লিখেছেন ‘যে ভাষা নতুন ভাষা’ তার ‘প্রাণের ভিতরে ভাসে’ সেই বাংলা ভাষা এক ‘মধুর আলো’ ‘আঁখির উপরে হাসে’। এই বাংলা ভাষা শুধু কামিনী রায়ের কাছেই মধুর নয়, আমাদের কাছেও অনেক মধুর, যাকে ঠিক বোঝা যায় না, যা আমাদের ওপরে সর্বদা ক্রিয়া করে চলে।
কামিনী রায়ের ‘পুণ্ডরীক’ ও ‘মহাশ্বেতা’ কবিতা দুটি খুব বেশি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) প্রভাবিত। এবং তার সমগ্র কাব্যই বেশ খানিকটা মধ্যযুগের ভাবধারা নিয়ন্ত্রিত। তদুপরি নারী হয়েও তিনি কবিতা লিখেছিলেন সেই সময়ে যখন নারীরা চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি। তার কবিতায় যেমন তার জীবনের ব্যর্থতার চিহ্ন ফুটে উঠেছে তেমনি তা প্রকারান্তরে বাঙালিরই সামগ্রিক ব্যর্থতার চিহ্ন। তবুও আমরা তাকে যেমন আমাদের ঐতিহাসিক ব্যর্থতার সাথে স্মরণ করবো তেমনি তাকে তার কবিতার জন্যও স্মরণ করবো।
আরো স্মরণ করবো তার একটি অমর কবিতা, যে কবিতাটি বাঙালিরা শত বছর ধরে মুখস্ত করে চলেছে; কবিতাটির নাম ‘পাছে লোকে কিছু বলে’। আমরা জানি এই কবিতাটি আমরা আরো বহুদিন মনে রাখবো। যেমনি মনে রাখবো তার প্রবাদের মর্যাদা পাওয়া নীতিকথামুলক কবিতার চারটি লাইনঃ
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবণী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রবন্ধটি মিজান রহমান সম্পাদিত কামিনী রায় : জীবন ও সাহিত্য, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, গ্রন্থে সংকলিত এবং প্রবন্ধটির রচনাকাল ২০০৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।