এসেছি দুজন একইপথে দুভাবে—
তোমার জন্মক্ষণে উঠেছিল বেজে ভোরের পাখির ডাকের
মতো আনন্দের কলরোল,
আর আমার জন্মক্ষণে এক অনন্ত ছাইচাপা কান্না
চলেছিল বয়ে কলকলে এ্যাম্বুলেন্সের মতো;
আমি এক পোড়াকপালি।
আমার কচিপাতার সাথে বেড়ে উঠেছে কিছু প্রাণি
যারা বেওয়ারিশ পুকুরের কচুরিপানার মতো কাটায় জীবন,
মুখ রক্তহীন নীলাভ জন্ডিসাক্রান্ত রোগির বাঙলা পাঁচের মতো,
এড়িয়ে চলে তারা সবাই আমাকে,
আমি যে পোড়ারমুখি,
মা বাবার গলার ঘ্যাগ— অবিক্রীতদাসি।
অন্তরঙ্গ ভাবিনি কাউকে
কাউকে ভাবিনি অভিন্ন হৃদয়ের দোলা,
শুধু হৃদয় যন্ত্রণাকে বুকে লালন করেছি তেল নুনে মেখে,
প্রকাশ হয়নি কভু আবেগের দুর্বলতা,
তবু একদিন হঠাৎ এসে গেল বসন্ত বাতাস,
সহজাত কিশোরী বেলায় আকাঙ্ক্ষার আবেদন ঠিকঠাক বুঝিনি বলেই
গ্রহণ করেছিলাম আমার প্রথম প্রেম, প্রথম যৌবন।
কীভাবে বাঁজলো বাঁশি, কীভাবে ভাঙলো বাঁশি ভাবতে অবাক লাগে,
ভাবনার কোলাহলে নিত্যদিনের জঞ্জালে
হারিয়ে ফেলেছি বহুবার নিজের ঠিকানা,
আমি পরিশ্রান্ত ঘৃণাবাহী প্রাণি
নিজেকে কখনো প্রবোধ দিতে শিখিনি
ভুলিনি তারপর আর কারো কথার ছলনে,
মা বাবা ভেবেছে পরিত্যাগেই মুক্তি আমার— অবধারিত।
আত্মহত্যার মধু আমি কতদিন খেতে গেছি
রশি হাতে নিয়ে মাঠের মৌচাকে—
কে আর এজগতে কার খোঁজ রাখে?
আমি খোঁজ রেখেছি সবার
আমার মৃত্যু ও আগুন গোলার।
বারো বছর বয়সে ছেড়েছিলাম নিজ গাঁ,
সেই গাঁও পারিনি ভুলতে, পারিনি ভালোবাসতে;
যে গাঁ দিয়েছে অবহেলা আর ঘৃণার পাহাড়,
এরপর কত পথ বিপথ কুপথে
দিলাম পাড়ি আবেগ উত্তেজনাহীন চলার নিয়মে।
ঘড়ির কাঁটার সাথে বালিশে মাথা গুঁজে
চোখের পানির সাথে খুঁজেছি
ঈশ্বরের পেচ্ছাবের মিল ও অমিল—
সে কখনো তাকায়নি গোগ্রাসি চোখ তুলে;
আমার অপরিচিত পরিচিত বন্ধু ও কর্মিরা
আমার পাশে এসেছে প্রতিরাতে,
আমাকে তুলে নিয়ে বসিয়েছে বারান্দার সোফায়
দেখিয়েছে পকেটের কুয়েতি দিনার
অন্ধকারের বুকে চুমু খেয়ে ঘোষণা করি ‘এ পৃথিবীর সবাই আমার’।
এখন শরীরকে যন্ত্রণা দিয়ে সুখ পাই
বুক কেটে রক্ত চেটে দেখি
তাতে পাপের তিক্ত স্বাদ আছে কী না,
মোড়কে মোড়ানো আমি
চব্বিশ বছরের নির্মলা;
রাতের খাবারে আসে
সেদ্ধ অসিদ্ধ নোনতা বা আলুনি মাংস কাবাব
কিন্তু তের বছর আগে যখন
পাঁচজন এসে খেলো কুমারি কাবাব
তারপর কান্নার পিরামিড
বুকের পাঁজরে চেপে বসে আছে;
জীবনকে বর্ণিল রঙে রাঙিয়েছে চারপাশে আমার পড়শীরা;
আমি ছিলাম শুধুই দর্শক;
আমার চোখে লেগে থাকে সাতরঙা রঙধনু রঙ,
ঠোঁটে হাসি, সাজসজ্জা বেচাকেনার খাটে,
নিত্যদিনের হাটে।
চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত অংকিত চিত্রটি রিচার্ড নিউটনের (১৭৭৭-১৭৯৮) আঁকা চিত্র নারীর আনন্দের অগ্রগতি (Progress of a Woman of Pleasure) যেখানে একজন নারীর অনেক মুহূর্ত ফুটিয়ে তোলেন। শিল্পী চিত্রটি আঁকেন ১৭৯৪ সালে। এখানে চিত্রটির কেবল একটি মুহূর্তকে ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।