১.
প্রাচীন গাঢ় রাত চলে গেছে উড়ে উড়ে
অন্ধকার দেশে সেদিনের তুমুল হাওয়ায়,
জোয়ারের জল আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর কিনারায়,
সেদিনের রাতে শতেক বছর ধরে দিনবদলের
প্রতীক্ষায় ছিলো প্রতিদিনের ফোঁটা সব ফুল,
সেদিনের তুমুল হাওয়ায় উড়ে গেছে সব অহংকার,
ডাইনোসরের শরীরের মতো সেই অন্ধকার রাতের
ভুঙভাঙ হয়ে গেছে ঝড়ের আঘাতে প্রাচীন জীবাশ্ম,
সম্রাটের জমকালো পোশাক হাওয়ার আঘাতে হয়ে গেছে হাওয়া;
আর আমি তোমাদের আপ্যায়ন করি
যাদের মাথায় করে এনেছিলো মধ্যযুগের হাওয়া,
টেবিলে গরম কফি, মনোহর হাসিতে বন হরিণী
মন চুরি করেছিল রক্তিম চোখের উদ্দেশ্যবিহীন ইশারায়,
তীব্র মাতাল তোমরা হুকায় টান মেরে
তীব্র সুখে দেখেছো শতচ্ছিন্ন জাল বাসন্তীর শরীরে,
আর চোখের পাথরে ডুব দিয়ে লিখেছি আমি আকালের গান।
২.
কতিপয় আদিবাসি গ্রামীণ তরুণ প্রাকসভ্য যুগে
নেঙটি পরে হেঁটেছিল শিকারের খোঁজে
হৃদয়ে সামন্তপ্রভুর কন্যার ছবি—
মিরান্দাকে একবার বাগে পেলে হয়,
হাতে ছিলো তীর ও ধনুক— সভ্যতার প্রাচীন মাপকাঠি,
তোমাদের বিজ্ঞাপনি চোখে এখন
নিম্নবর্গিয় পঠনের চকচকে ডিগ্রিদায়ি স্কলারশিপ,
উড়োজাহাজে উড়ে নগর ভ্রমণ হবে,
দুদিন প্রাগৈতিহাসিক গ্রামে অবস্থান করে
নিম্নবর্গিয়দের মনগড়া অবস্থার প্রতিবেদন তৈরি হবে;
রাইট ভ্রাতৃদয়ের বান্ধবিদের কান্না দেখা হবে,
তোমাদেরই মতো যেহেতু তাদের চোখ ও গাল ছিল
গাল বেয়ে জল পড়েছিল,
আর তোমরা দেখেছিলে আকাশ হতে পৃথিবীর মুকুলের শোভা,
আমি শুধু বুক ঘঁষে মরি কবিতা লেখার বিজ্ঞাপনে
দাঁতের ফাঁকে ঠেস দিয়ে কলমের মাথা—
হাবভাব বড়ই গম্ভির— টাক মাথা, মগজের মধ্যে উকুন,
হয়েছি বস্ত্রহীন আমুল কংকাল শতাব্দির বাৎসরিক শীতে।
পৃথিবী মমতা মিশিয়ে মমি করে তোমাদেরও রেখে দেবে,
নয়া তন্ত্রমন্ত্র কোনো কাজে দেবে না,
তোমরা বারবার শিশু হবে বুড়ো হবে, বুড়ো হাবড়া নির্বোধ শিশু,
বুঝবে না— কে তোমাদের এনে দেবে তুমুল হাওয়া;
বোঝে শুধু চওড়া কাঁধঅলা ঝাঁকড়া চুলের এক
চলমান বিক্ষুব্ধ স্বাপ্নিক—
কাঁধে তার রাইফেল।
তোমাদের দুই কাঁধে জোয়ালের সারি;
তোমাদেরকে দুপায়ের মাঝখানের নড়বড়ে লাঙল চষতে,
উর্বরতা বাড়াতে আর ফসল ফলাতে লাগানো হয়েছে,
শুধু সেদিনের হাওয়া জানে হ্যামলেট কেন
মৃত শ্মশান বানালো ডেনমার্কের রঙিন শহর,
যে শহরে একদা এসেছিল
ঘুম কাতুরে মন চোরা এক ঘাটের মাঝি,
পিতৃমাতৃহীন সন্তানেরা তার হয়েছিল বড়,
গড়েছিলো প্রাসাদ ও অট্টালিকা, খুলেছিলো হারেমখানা,
সেখানে গানের আসর বসত, হেমন্ত গাইত গান
‘যদি পৃথিবীটা মৃতের দেশ হয়,’
সেই গান শুনে মার্কস লিখলো পুঁজি,
আর তারপর ঘটল বিশাল কারবার
ঘাটের মাঝির বড় ছেলে একদিন হাঁটতে বেরুল শহরে
অট্টালিকার জানালা দিয়ে তাকে এক রাজকন্যা
অপেক্ষা করতে বলল নিচে কিছুক্ষণ,
তরুণ দাঁড়িয়ে থাকল বহুদিন এবং অবশেষে একদিন
রাজকন্যা এসে তাকে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল।
৩.
সকাল বেলা হাওয়ার পর শুরু হলো ভাটা
আমার শুরু হলো পুনরাবৃত্তিক পথ চলা,
একই কথা বলা, সময় প্রতিকুল;
তাই লিখে যায় সত্য মিথ্যাবিহীন তোমরা ভাবো ভুল,
কচি লাউ মাচার মধ্যে কচি কদুর ফুল,
মাথার মধ্যে আমার কচি লাউয়ের মাচা;—
ফুল হবে ফল হবে কদু হবে,
ফুলের মধ্যে হবে পরাগায়ন,
ভ্রুণের বাস্তবিক ক্লাস
তোমরা সবাই মত্ত সেই ক্লাসে
আর সভ্যতার নিক্তিতে তখনো মাপা হয়
কে কোন কুশীলব কবেকার কোন স্বপ্নাশার?
আমি বরঙ আমার প্রেমিকার কানে কানে
ফিসফিসিয়ে বলবো
‘বরঙ কেটে পড়ি এই ফাঁকে মূল্যবিচারের আগে’।
ভাবি একবার মনে মনে,
কী সব ছাই ভম্ম লিখেছি কার জন্যে
কোন কুক্ষণে,
এসবের অর্থহীনতা কোথায় আঘাত হানে।
বরং তার সঙ্গে আমি চড়বো ঘোড়ার পিঠে
দুলদুলিয়ে যাব আমরা দ্বীপান্তরের মাঠে।
পাতা হবে বিছানা বালিশবিহীন রাতের শয্যা;
আমি আছি মরুভুমিতে তেতে
আমাকে ঠান্ডা করতে
সে সেঁক দেবে তপ্ত হৃদয়ের।
৪.
গভীর ঘুমে অচেতন আমি, বাকিরা সবাই জেগে
আমার স্বপ্নের বেয়াড়া গরুটা ক্রমদৃশ্য দেখায়ঃ
এক নড়বড়ে ঘরের অস্থায়ী বাসিন্দা আমি
বারবার মেরামত করি টুকিটাকি,
চকচকে কার্পেট কিনে মেঝেকে মোড়াই,
কাঠের বিকল্প কাঠ দিয়ে পালঙ্ক বানাই,
চর্তুদিকে আভিজাত্যের শিলামূর্তি,
মুদ্রণ অযোগ্য কিছু প্রাচীন মহাকাব্যিক খাতা,
চকমকে চটপটে সহকর্মি,
হেলেদুলে দুজনাতে সাজিয়েছি ক্ষণস্থায়ী ঝড়াক্রান্ত ঘর—
আমাদের নগর পম্পেই,
কচিকলাপাতা রঙ নিবিড়
আগুন লাভায় আমরা হারাব প্রাণ মহাবিশ্বের মাঝে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুরু হয় এক সিকি বমির জীবন,
জীবনের জমিনে দুধেল গাইয়ের মতো খুকখুকে
কাশি নিয়ে মরণের পার্শ্ববর্তি গাঁয়ে ধুমসে বুড়োর
চুকচুক দুধ খাওয়া;—
শেষ মুহুর্তে আবৃত্তি ও নাট্য অভিনয়,
পুনরায় যৌবন অর্জন;
ব্যর্থ মঞ্চে চটিজুতো সাজিয়ে রেখে
শানদারের কাছে পেটটাকে শান দেই;
শেষে হয় বোধোদয়— লিখছি একুশ বছর বয়সের গান,
আকাল ও স্মৃতির গান, নতুন দিনলিপি আর
রাষ্ট্রীয় বুটের তলায় চাপা পড়ে বের হওয়া
প্রাণের শেষ নিশ্বাসের গান, শুধু লড়ে যাওয়া দুটো লাইন;
যদিও জানি দুরন্ত হাওয়ার গানই শেষ কথা হয়।
০২.০১.২০০২
চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত অংকিত চিত্রটি নমপেনে বেসানতারা জাতকে অংকিত একটি মুরালচিত্র। এখানে বালিকা অমিত্তাড়াকে গ্রামের বালিকারা পিটিয়েছে এবং সে তার বুড়ো ব্রাহ্মণ স্বামীর কাছে অভিযোগ জানাতে গেছে। এখানে চিত্রটিকে নিচের ও উপরের দিকে সামান্য ছেঁটে ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।