কচি কলাপাতারঙ নবীন গাছের পাশে ঘুমাচ্ছিল
এক মাঝ বয়সী পার্থিব ভ্যানচালক
হঠাত ঘুম ভাঙলো স্বাপ্নিক উত্তেজনায়,
দুর্বার চেঁচালো ‘আমি তোকে খুন করব’
নাক মুখ দিয়ে মিনিট খানেক ট্রাক-ইঞ্জিনের মতো গোঁ গোঁ শব্দ,
তারপর চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার ঘুমালো অন্ধ কুঠুরিতে;
চৈত্রের দুপরে ভ্যানের উপরে শুয়ে আছে, এক মরা লাশ যেন
দক্ষিণে মাথা, দখিনা বাতাস, আউলা আকাশ
গায়ে ছিটের শার্ট, সস্তা লুঙ্গি, নেই কোনো বুজরুকি;
জীবনটা ভেঙেচুরে হয়ে গেছে বয়স্ক মাকড়শার ঝুল,
তবুও নিজে বাঁচার ও অন্যকে মারবার তীব্র তেজে কাঁপছে শরীর,
দুপায়েই মরা কোষ, লেপ্টে আছে পুরোনো ময়লা;
বাম পা ঝুলে আছে ভ্যান হতে নৈশব্দের সীমানায়,
ভ্যানে লেখা, দেশ বাঁচান, মারা যান, গাছ লাগান;
দেশ বাঁচানোর কত চেষ্টা, শুধু মানুষেরাই মাটি হয়ে যায়।
দূরে এক ঠেলাগাড়ির অতিপ্রাকৃতিক নিরন্ন শ্রমিক
ঢুলতে ঢুলতে পড়লো ঘুমিয়ে জোড়াদিঘির পারে;
গায়ে গেঞ্জি, কাঁধে গামছা, পরনে লুঙ্গি,
হয়তো আমার গাঁয়েই তার বর্ণহীন বাড়ি,
(আমি বাড়ি যাইনি ছাব্বিশ বছর,
হে প্রগাঢ় অন্ধকার, আমিও বেঁচে থাকব),
নিচে পড়ে আছে সময়ের ক্রমচাপে ক্ষয়ে যওয়া
পা ও আঙুলের চাপে পড়া ব্যথিত সেন্ডেল
ঠেলা গাড়ির উপরে পড়ে আছে দুই গাছি দড়ি
শ্রমিকের অমূল্যধন,
মালামাল বাঁধতে কাজে লাগে দড়ি আর একটি জীবন
কয়েকটি সাইকেল চলে গেল পায়ের উপর পা তুলে,
রিকসায় দুলেদুলে চলে গেল সম্ভবত এক উঠতি আলাপের নারী
তাকে বিদায় জানালো এক ব্যক্তিগত গাড়ি,
গাছ হতে খসে পড়লো কয়েকটি হলুদ পাতা
বাতাসে উড়লো যৌবনের ছেঁড়া কাগাজ, মন্ত্রীর পলিথিন আর
দূরে আন্তজেলা সড়কে বেয়াড়া গাড়ির হুইসেল,
পার্শ্ববর্তী বাড়ির হট্টগোল মিশে গেল মাইকের গর্জনে;
মোড়ের দোকানের টিভিতে চলছে
পাক-ভারত ক্রিকেটের নবধারা মুখরিত কার্যবিবরণী,
রাস্তার অন্যদিকে বেঞ্চে বসে বিড়ি খেল
পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক শেষ বয়সি হারানো সুর,
দ্রুত চারদিক দেখে নিলো, দাঁড়ালো,
একেকটি বাঁশের কতো টাকা দাম এই নিয়ে শেষ বোঝাপড়া,
কাউকে বাঁশ দেবে উপরে ও নিচে, বেশ বোঝা গেল,
এক চাটাই তৈরিকারি খেল দুপরের ভাত,
আকাশকে গালি দিলো: শালার গরম,
মোটরসাইকেলে চড়ে চলে গেল দুই পুলিশ, সভ্যতার সব পাপ গ্রহণ করতে,
আর এক কিশোর ঢোলের মতো বিশাল গামলা বাজিয়ে
সুর তুলছে বেহুদা বিব্রত গানের
আর আমি শুকনো পাতার উপরে টলোমলো হেঁটে চললাম,
সম্মুখে তোমার শতছিন্ন নড়বড়ে পোড়োবাড়ি
তোমার একঘেয়ে লড়াকু শহর।
আমার জীবন যেন ঘোরে
তোমার জীবন কেন্দ্র করে,
আমি যেন জড়িয়ে পড়ি
তোমার শহরের অলিতে গলিতে
হাজারো মেঘমর্মর যাপিত কর্মে।
কর্মফলে জাগবে তোমার সর্বপ্রিয় শহর। হে মহাজীবন!
২৪ মার্চ ২০০৪, কাস্টম মোড়, কুষ্টিয়া।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।