কিণ্ডারগার্টেনে সকালের প্রথম ক্লাসটা চীনা ভাষার। ক্ষুদে ছাত্র চৌ শিয়াওরুং আজ আবার দেরী করে এসেছে। করুণ মুখ দেখলে মনে হয় কিছুক্ষণ আগে সে চোখের পানি মুছেছে।
শিক্ষিকা চেং ইয়ুয়েছিন কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ আবার কেনো তোমার দেরী হল?’
চৌ শিয়াওরুং এর দিকে ক্লাসের ৪১ জোড়া চোখ উৎসুক হয়ে রইল।
চৌ শিয়াওরুং নিচু গলায় বলল, ‘আসার সময়ে দেখি ওষুধের দোকানের কাছে খুব ছোট্ট একটা চড়াই পাখি নিচে পড়ে আছে, গাছের উপর থেকে চড়াই পাখিদের বাসাও নিচে পড়ে আছে। ক্লাসে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ‘নিশ্চয়ই অমুক ছেলে বাসাটা গাছ থেকে ফেলে দিয়েছে।’ ‘বেড়ালের কীর্তিও হতে পারে।’
শিক্ষিকা চেং ইয়ুয়েছিন ইশারায় সবাইকে চুপ করিয়ে চৌ শিয়াওরুংকে বললেন, ‘তুমি গিয়ে বসো। আচ্ছা, তুমি একটা ছোট্ট চড়াই দেখেছিলে। কিন্তু তোমার দেরী হল কেন?
চৌ শিয়াওরুং বলল, ‘ছোট চড়াইটা বসে বসে খুব চ্যাঁচাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল একটা নার্সারির ছোট বাচ্চা পথ হারিয়ে ফেলে কাঁদছে।’
ক্লাসের একটি ছেলে বলে উঠল, ‘তুমি ছোট চড়াইটাকে তুলে নাও নি কেন?
শিক্ষিকা চেং ইয়ুছিন নিষেধের দৃষ্টিতে ছেলেটির কথা বলা থামিয়ে চৌ শিয়াওরুকে ঘাড় হেলিয়ে ইশারা করলেন সে যেন বলে যেতে থাকে।
চৌ শিরাওরুং বলে চলল, ‘আমি ছোট চড়াইটার কাছে যাচ্ছিলাম। সেই সময়ে দুটো বড় চড়াই এসে ছোট চড়াইটার পাশে বসে ডাকতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম ওরা ছোট চড়াইয়ের মা বাবা। ছেলেকে উদ্ধার করতে এসেছে।’
ক্লাসের আর একটি ছেলে দুই হাত তুলে গুলতি ছোঁড়ার ভঙ্গী করল ; আশে পাশের ছেলেরা রাগ রাগ চোখে ছেলেটির দিকে তাকাল।
চৌ শিরাওরুং বলে চলল, ‘আমি ছোট চড়াইটাকে দেখছিলাম। চড়াইটার মা বাবা কিন্তু ওকে উদ্ধার করতে পারছিল না। ছোট চড়াইটা নিজে উড়তে পারে না। ওর মা বাবাও ওকে তুলে নিয়ে যেতে পারছিল না। আমি খুব চিন্তা করছিলাম কী করা যায়, কিন্তু কোনো উপায় আমার মাথায় আসছিল না।
৪১ জোড়া চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। ছোট চড়াইটার কী গতি হতে পারে! কী উপায়ে!
‘আমি যখন খুব ভাবছিলাম তখন দেখি একটা বেড়াল একেবারে কাছে এসে পড়েছে।’
একটু আগে যে ছেলেটি গুলতি ছোঁড়ার ভঙ্গী করেছিল, এবার সে তার পেনসিল বাক্সটা তুলে ছুড়ে মারার ভঙ্গী করে বলে উঠল ‘মারো’।
ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের আর শিক্ষিকার দৃষ্টি কয়েক মুহুর্ত ছেলেটির উপর আটকে রইল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না।
‘আমি আমার বইয়ের ব্যাগ উঁচু করে ধরে বেড়ালটার দিকে তেড়ে গেলাম, বেড়ালটা তখন দৌড়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু বড় চড়াই দুটো আমার মাথার উপর দিয়ে খুব ওড়াওড়ি করতে লাগল, ওরা ভাবল ব্যাগ দিয়ে আমি বুঝি ছোট চড়াইটাকেই মারব’ ক্লাস চঞ্চল হয়ে উঠল।
‘আমি তখন ছোট চড়াইটার পাশে দাঁড়িয়ে ওকে বললাম, ভয় কোরো না ছোট চড়াই, আমি গণ মুক্তি ফৌজের একজন সৈনিক,আমি তোমাকে রক্ষা করতে এসেছি। যদি বেড়াল তোমার উপর। হামলা চালাতে আসে তাহলে আমি তাকে এই ব্যাগ দিয়ে মারব।’
গুলতিবাজ ছেলেটি বলে উঠল, ‘বেড়ালকে লাথিও মারা যেতে পারে।’
চৌ শিয়াওরুং বলে চলল, ‘আমার কাছাকাছি কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে পড়ে এইসব দেখছিল আর আমাদের মাথার উপর দিয়ে। বড় চড়াই দুটো শুধুই উড়ছিল আর ডাকছিল। আমি ছোট চড়াইটাকে দেখিয়ে বেড়ালটার কথা লোকদের বললাম। একজন চাচা খুব লম্বা। আমি তাকে বললাম, ‘চাচা, চড়াইদের বাসাটা দেখুন ভেঙ্গে গেছে। বাসাটা ঠিক করে এই ছোট চড়াইটাকে বসিয়ে বাসাটা গাছের উপর তুলে দেবেন ?’
‘আমাকে কাঁদতে দেখে সেই চাচা বললেন, ঠিক আছে, তুমি ইস্কুলে চলে যাও। আমি বাসাটি মেরামত করে ছোট চড়াইটাকে বাসাশুদ্ধ গাছে চড়িয়ে দেব! তোমার ইস্কুলে যেতে দেরী হলে শিক্ষিকা তোমাকে বকবেন। আমি বললাম, আমি সত্যি কথা বললে শিক্ষিকা আমাকে বকবেন না। এর আগের বার আমাকে বকেন নি। একটা লোক রাস্তার পাশে বাঁদর খেলা দেখাচ্ছিল আর বাঁদরটাকে ইচ্ছে মতো মারছিল। খেলা শেষ হওয়ার পর সবাই চলে গেলে আমি বাঁদরওয়ালাকে বলেছিলাম, মানুষের মতো বুদ্ধি বাঁদরের নেই। কিন্তু আপনি তো মানুষ, আপনার ব্যবহার তো মানুষের মতো হওয়া উচিত! বাঁদরওয়ালা তার হাতের ঘণ্টাটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে বলেছিল, দ্যাখো বাচ্চা, আমি ওর মনিব, ওর মালিক। তুমি আমাদের ব্যাপারে নাক গলিবে না, ইস্কুলে চলে যাও। সেদিন ইস্কুলে পৌঁছতে আমার দেরী হয়েছিল। আমি শিক্ষককে দেরীর কারণ বলতে গিয়ে সবকিছুই বলেছিলাম। শিক্ষক আমাকে বকেন নি। হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। আমার কথা শুনে সেই লম্বা চাচা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ছোট চড়াইটাকে খুব সাবধানে হাতের উপর তুলে নিলেন, আমাকে বললেন, তুমি কিছু ভেবো না, ইস্কুলে যাও, আমি এদের বাসাটা এখুনি ঠিকঠাক করে দিচ্ছি। তাঁর এই কথা শুনে আমি ইস্কুলে এসেছি।… এইসবের জন্যেই দেরী হয়ে গেছে …’
চৌ শিয়ওরুং চুপ করার পর অন্য সবাইও কয়েক মুহূর্ত চুপ হয়ে রইল। তারপর শিক্ষিকা চেং ইয়ুয়েছিন হেসে ছাত্রছাত্রীদের বললেন, ‘আজ আমরা সবাই ‘যেমন খুশি’ ক্লাসের সময়ে ঐ চড়াই পাখিদের বাসা দেখতে যাব।
ক্লাসের সবাই উৎসাহে চঞ্চল হয়ে উঠল। শিক্ষিকা চেং ইয়ুয়েছিন এবার একটি প্রশ্ন করলেন:
ঐ ট্যাঙ্গা চাচা চড়াই পাখিদের বাসাটা ঠিকঠাক করে দিয়ে চড়াইছানাকে সেই বাসায় বসিয়ে বাসাটা গাছে তুলে দিচ্ছেন। তিনি যে সময় খরচ করে এই পরিশ্রমটুকু করছেন তোমরা বলতে পার কেন?
গুলতিবাজ ছেলেটিই প্রথমে হাত তুলল।
সে বলল, কারণ, সেই বাঁদরওয়ালার মতো ঐ ট্যাঙ্গা চাচা তো চড়াইদের মালিক নন।
বি. দ্র: * এই গল্পটি ”ভালোবাসার গোড়ার পাঠ” নামে ছোট গল্পের বই থেকে নেওয়া।
* ”ভালোবাসার গোড়ার পাঠ” লেখায় প্রধান চিত্রটি The Crossley ID Guide: Britain and Ireland বই থেকে নেয়া। লেখার ভেতরে ব্যবহৃত অংকিত চিত্রটি Léon Bazille Perrault (1832–1908) – এর L’éducation du pierrot নামের পেইন্টিং।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।