ফারাক্কা বাঁধ এবং বাংলাদেশের পানি সম্পদের ওপর এই বাঁধের প্রভাব

ফারাক্কা বাঁধ (ইংরেজি: Farakka Barrage) হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও বাংলাদেশের জনগণকে ভূমিদাসত্ব এবং শহুরে শ্রমদাসত্বে বন্দি করে রাখার গুজরাটি-মাড়োয়ারী শিল্পপতিদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। ভারতে বাঁধ নির্মাণের বহুমুখী তোড়জোড়ের ফলে পরিবেশের উপর উপনিবেশবাদ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে ভারতীয় বর্বর শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা। বাংলার পার্শ্ববর্তী বাঙালিসহ অন্যান্য জাতির জনগণ মাছ পছন্দ করে। তাই উত্তর ভারত ও বোম্বাইয়ের শিল্পপতিরা এই মাছ বিলুপ্ত করে দেবার জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের নদীগুলোর উপর শত শত ড্যাম ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চাপিয়ে দিয়েছে।

পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান নদী। গঙ্গোত্রী হিমবাহ গঙ্গা নদীর উৎস স্থল। এটি ভারতের উপর দিয়ে প্রায় ১,৬০০ কি. মি. প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে এ নদী পদ্মা নামে পরিচিত। ভারত তার পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় ধুলিয়ানা নামক স্থানে গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অদূরে এ বাঁধ অবস্থিত। দু’দেশের সরকারবৃন্দ ১৯৭৫-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত (১৯৮৫ সাল বাদে) বিভিন্ন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে, বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে ৪৫-৩৮ হাজার কিউসেক পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করে।

ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব

গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গার পানি হুগলী নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করায় পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলোতে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এতে গঙ্গা-কপোতাক্ষ পরিকল্পনা অচল হবার উপক্রম হচ্ছে। শীতকালে পদ্মা নদীর পানি মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ায় ভেড়ামারার নিকট পদ্মা হতে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পানিসেচ সম্ভব হয় না। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নৌ-চলাচালে প্রতিবন্ধকতা, মৎস্য সম্পদের বিনাশসহ পৃথিবীর বৃহত্তম স্রোতজ বনভূমি সুন্দরবনের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ বা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সর্বোপরি বাংলাদেশের অর্থনীতির অপুরনীয় ক্ষতি করছে। যেমন, উত্তরাঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ১০-১২ মিটার নিচে নেমে যাওয়ায় প্রায় ১৬টি জেলায় অগভীর নলকূপসমূহে সেচের পানির অভাব দেখা দিয়েছে। হস্তচালিত হাজার হাজার নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ায় খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে। উপরন্ত নলকূপের পানিতে বিষাক্ত আর্সেনিকও পাওয়া যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রার বিশেষ তারতম্য ঘটছে। মরু অঞ্চলের মত দিনে প্রচন্ড গরম আবার রাতে শীতের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

আরো পড়ুন:  টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশ, আসাম ও মেঘালয়ের জনগণের জন্য মরণফাঁদ

ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে উভয় দেশকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছাড়াও কিছু জুরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যেমন (১) উজান স্রোতে ফারাক্কার ন্যায় বাঁধ নির্মাণ করে পানি সংরক্ষণ ও স্লুইস গেট দিয়ে পরিমিত পানির ব্যবস্থা করা, (২) কৃত্রিম জলাশয় নির্মাণ করা এবং (৩) খাল খনন ও পুনঃখনন কার্যক্রমকে জোরালো করা। তবে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি যাতে ভারত ও বাংলাদেশ সমভাবে ব্যবহার করতে পারে, এর জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদী এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

বাংলাদেশের তিনদিকে প্রায় ৩০টি মিনি ফারাক্কা

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা প্রায় ১৭০টি। এদের মধ্যে কেবল একটি বাদে সব কটির উৎস ভারতে। এসব অভিন্ন নদীর অনেকগুলোর উজানে বাঁধ ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত পানি সরিয়ে নিচ্ছে। 

ভারত পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার উজানে মহানন্দা নদীতে দুটি বাঁধ নির্মাণ করেছে । এর একটি নির্মাণ করা হয়েছে তেতুলিয়া বাজার থেকে ২ কিলোমিটার দূরে! অপরটি তেতুলিয়া বাজার থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বাংলাবান্ধার কাছে খোদাইমারী স্থানে। মহানন্দায় বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটিতে নদী ক্ষীণধারায় বয়ে চলেছে । শুকনো মৌসুমে এই বাঁধের সাহায্যে পানি টেনে নেয়ায় মহানন্দা তীরবর্তী বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে ক্ষতিকর প্রক্রিয়া। বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ।

ভারত তিস্তা-মহানন্দার সংযোগ খালের সংযোগস্থল বিহারের ফুলবাড়িয়ায় একটি এবং পশ্চিমবঙ্গের হাপতিয়াগঞ্জে অপর একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। পঞ্চগড় জেলার সদর থানার ভিতরগড় সীমান্ত ফাঁড়ির বিপরীতে তালমা নদীতেও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। 

ভারত জলপাইগুড়ি জেলার মেকলিগঞ্জ থানা কাশিয়াবাড়ীতে বাঙ্গু নদীর ওপর একটি রেগুলেটর, বালুর ঘাটের ঝিনাইপোজ নামক স্থানে ঘুকশি নদীতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। ঘুকশি নদী পশ্চিমবঙ্গের বালুর ঘাটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার ভিতর দিয়ে মথুরাপুরে এসে ছোট যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। ঘুকশি নদীতে বাঁধ দেয়ায় ছোট যমুনার পানিপ্রবাহ কমে গেছে । 

আরো পড়ুন:  বাঙলার নদীরা কেন মরে যায়?

এছাড়া ভারত উত্তর প্রদেশের কানপুরে গঙ্গার ওপর একটি বাঁধ নির্মাণ করছে। এতে ব্যয় হবে ৯৪৪ কোটি টাকা। এই বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সোচ্চার। ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের বুকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কানপুর গঙ্গা বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের বুকে সে হাহাকার ডেকে আনবে। পত্রিকাটি আরও বলেছে, বাংলাদেশের নীতির প্রতি পশ্চিমবঙ্গের সমর্থন জানাবার সময় এসেছে। কারণ পানির অভাবে কলকাতা বন্দর মৃতপ্রায়। কানপুর বাঁধ প্রতিরোধ করার জন্য পত্রিকাটি পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ও সরকারকে তাগিদ দিয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের মূল বিরোধ এই পানি সমস্যা। 

ভারত গঙ্গার একেবারে উজানেও একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। গঙ্গা পার্বত্য এলাকা থেকে সমতলভূমিতে অবতরণের স্থান উত্তর প্রদেশের হরিদ্বারে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বোল্ডার দিয়ে তৈরি এই বাঁধের দৈর্ঘ্য ৩৩৬ মিটার। বাঁধে কপাট রয়েছে ২২টি। গঙ্গার প্রস্থ এখানে কম। কিন্তু অত্যন্ত খরস্রোতা। ভীমগাদা সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ এবং শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি ধনরী নদীতে প্রবাহিত করে নদীটির প্রবাহ বৃদ্ধি করা এই বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্য। 

এছাড়া ভারত অন্যান্য নদীর শাখা-প্রশাখায় নানা রকম ব্যবস্থার মাধ্যমে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এসব নদীগুলো হচ্ছে গোমতী, মনু, করতোয়া, কোদালিয়া, খোয়াই, সিলোনিয়া, ইছামতি, ইসালিছড়া, জিনজিরাম, পুলসরি, আঁধারমানিক ছড়া, ছাগলনাইয়াছড়া, কমলাছড়া, রাজেশপুর তেতনাছড়া, উজিরপুরছড়া, মাতাইছড়া, কাচুয়াছড়া, গইরাছড়া, মহামায়াছড়া, গজারিয়াছড়া, মাবেস নদীছড়া, চন্দনাছড়া, মধুছড়া, ইচাছড়া, বৈরবসঙ্গলী নদী ও চুড়িয়া।[১]

তথ্যসূত্র:

১. আবদুস সাত্তার, “কতিপয় মিনি ফারাক্কা” বেনজীন খান সম্পাদিত, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ: বাংলাদেশের বিপর্যয়, কথাপ্রকাশ ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা ২১৭-২১৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!