বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল যেখানকার মানুষের জীবনধারা হচ্ছে কৃষিভিত্তিক সামন্তীয় যন্ত্রণার রূপ। হাওড় অঞ্চলে মাছ ধরা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেই মাছ ধরতে যাচ্ছে হয়ত কয়েকজন কিশোর। সকালে তারা মাছ ধরতে যায়, সারাদিনের মাছ প্রাপ্তি তাঁদের রাতের খাবারে মাছ-ভাত আসে। সেই মাছ বিকেলে বাজারেও যেতে পারে। জনাদশেক কিশোর-কিশোরি একত্রে মাছ ধরে; দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে থাকে তাঁদের সাথে কিছু বয়স্ক পুরুষও থাকতে পারে যারা পানি সেচে মাছকে ধরার উপযোগী করে তোলে এরকম বেশ কয়েকজন মিলে একত্রে মাছ ধরার দৃশ্য।
আর হাওরে রয়েছে সামন্তপ্রভুর শোষণ। সামন্তপ্রভুরা নানা রকমের তোলা, ট্যাক্স আর সুদের জালে তাদেরকে আটকে রাখে। ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিয়ে তবে বাজারে পৌঁছা যায়। বাজারে যা কিছুই কৃষক বেঁচে তার জন্য দিতে হয় বখরা। সামান্য শ্রম না দিয়েও একজন হাটমালিক লুটে নেয় কৃষকের সম্পদ। ঘাটের চাঁদাবাজির জন্যে তোলা থাকে সামন্তপ্রভুর ঘর।
এছাড়াও বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের আছে গরুর বাথান। একটু ধনী কৃষকেরা শতাধিক গরুর মালিকও হতে পারেন। সেই গরুকে নিয়েই কোনো রাখালের জীবন ঘুরতে পারে প্রতিদিন। এরকমই এক রাখালের সাথে দুই কিশোরি দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে তাকালো ক্যামেরার দিকে। বাথান বাথান করেন রাখালরে রাখাল, বাথান কইরছেন ঘর গানও আসে এই গরুর বাথান থেকেই।
বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের বাথানের সাথে জড়িয়ে থাকে আরেক জীবন, যারা গরুর গোবর থেকে তৈরি করে রান্নার জ্বালানি। শত শত বছর ধরে কৃষক গরুর গোবর দিয়েই জ্বালানি তৈরি করেছেন। সেই গোবর সংগ্রাহক চারটি কিশোরী ঘুঁটে কুড়িয়ে ঘরে ফিরছেন। কিশোরীদের লেখাপড়া বিলুপ্ত হয়ে যায় ঘুঁটের ভেতরে।
ছাতকের পাশে প্রবাহিত সুরমা নদী দিয়ে আসে মেঘালয়ের পাথর। সেই পাথর পৌঁছে যায় ট্রাকে করে সারাদেশে। এই পাথর কেনাবেচার ব্যবসা করে কত মহাজন কোটি টাকার মালিক বনে যায়; কত ব্যবসায়ীর ঘরে টাইলস আর আধুনিক প্রযুক্তির অট্টালিকা উঠতে থাকে। কিন্তু নারী আর পুরুষ শ্রমিকের জীবন অপুষ্টির যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে থাকে। নারী শ্রমিকদের পাথর বহন ও ট্রলারে পাথর উত্তোলন সে এলাকার নিত্যদিনের দৃশ্য।
ট্রাকে করে যে পাথর সারা দেশে চলে যায় সেই ট্রাকচালকদের জীবনে কোনো বিনোদন নেই। নেই অন্য কোনো সাধ-আহলাদ। শুধু আছে জীবনের চারদিকে ধুলোর আস্তরণ, যে আস্তরণের নিচে চাপা পড়ে আছে জন্ম পরম্পরায় কান্না আর হাসির এক মায়াবি অন্ধকার। ট্যালকম পাউডার হাইওয়েতে পাউডার উড়িয়ে চলে ট্রাক।
মেঘালয় থেকে সাদা রঙের মাটি আসে যাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে চুনাপাথর তৈরি করা হয়। সেই চুনাপাথর নির্মাতাদের জীবন সাদাই থাকে; কিন্তু চুনাপাথর ব্যবসায়ীদের জীবন টাকার রঙে রঙিন হয়ে যায়। কিন্তু আগুনের রঙে রাঙানো শ্রমিকের জীবনে কোনো রঙ থাকে না। তাঁদের দিন থাকে না, রাত থাকে না, আহার-বিশ্রাম বলে কিছু থাকে না। শ্রম দিতে দিতে ক্লান্ত একদিন তারা এ-জীবন ছেড়ে অন্য জীবনের পানে চলে যায়, কিন্তু চুনাপাথরের জীবন থেকে মুক্তি মেলে না।
মেঘালয় থেকে আকাশে ঝুলন্ত এক ধরনের লোহার ট্রেতে করেও আসে পাথর। সেজন্য ছাতকে ঝুলন্ত তারের মাধ্যমে এক বিশেষ পথ তৈরি করা হয়েছে। সেই পথে আসে টাকা আর পাথর আর পুঁজিবাদের যন্ত্রণায় মরতে থাকা প্রকৃতির কান্না। আর সেই কান্নার পাশেই পাথর ব্যবসায়ীদের জীবন যখন টাকার নিচে শুয়ে থেকে স্বপ্ন দেখে তখন কোনো এক ভিখারিনীর চোখের সামনে থাকে শুধু বেঁচে থাকার জন্য কুড়িয়ে বেড়ানো যন্ত্রণা।
সেই ভিখারিনী চোখ বড় বড় করে কোনোদিন সমাজ ও সভ্যতাকে ধমক দিতে পারে না। চেত্না দল ও ঘোষক দলের বীরত্বে যখন পাষণ্ড মধ্যবিত্তরা খেলতে থাকে ক্ষমতার লড়াই তখন পশুদের দিকে তাকিয়ে তাকে পুঁজির দাস বলে আমরা আমাদের মানবিকতাকে অনবরত কলঙ্কিত করে চলি। ভিখারিণীই সভ্যতাকে জঞ্জাল হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
বি. দ্র. অনুপ সাদি ও বিজন সম্মানিত গত ২০১৩ সালের ২৯, ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ছাতক-কোম্পানিগঞ্জ ভ্রমণ করেন। সেই ভ্রমণের খন্ডচিত্র ধরা থাকলো এই লেখায়।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।