সিংড়া জাতীয় উদ্যান দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত প্রাচীন পত্রঝরা বন

সিংড়া জাতীয় উদ্যান অবস্থিত দিনাজপুর জেলা শহর থেকে সড়ক পথে প্রায় ৪০ কিঃমিঃ উত্তরে বীরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে। বীরগঞ্জ শহর থেকে এর দুরত্ব প্রায় ৫ কিঃমিঃ। দিনাজপুর জেলা সদর থেকে বীরগঞ্জের দিকে বাসে চড়ে যাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দেখতে বা পিকনিক করার জন্য এই উদ্যানে আসে।  দর্শকদের আকর্ষন করার জন্য বন বিভাগের উদ্যোগে কিছু খড়ের একচালা ঘর, বাচ্ছাদের খেলার পার্ক এবং বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য কিছু দোকান করা হয়েছে।

সিংড়া বনকে ১৮৮৫ সালে অধিভুক্ত করা হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে বন বিভাগের অধীনে নিয়ে গিয়ে একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালের ১০ই অক্টোবর এটিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। সিংড়া মৌজার নামানুসারে এই সংরক্ষিত বনের নামকরণ করা হয় সিংড়া জাতীয় উদ্যান। এটি সিংড়া শালবন নামে স্থানীয়দের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত।

এক সময় এই বনে অবাধ বিচরন ছিলো হনুমান, বানর, বনমোরগ, মেছোবাঘ, শূকর, হরিণ, বনগরু, নীল গাইসহ বিভিন্ন বন্য জীবজন্তুর। এইসব পরানির অভায়রন্য ছিল এই গহীন অরন্য সিংড়া জাতীয় উদ্যান। সুন্দর নির্মল নিরিবিলি পরিবেশ ও সবুজ গাছপালায় মোহনীয় প্রকৃতির নয়ন জুড়ানো উদ্যান সিংড়া ফরেস্ট। এই বনের যে সৌন্দর্য তা সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। বনের ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে গাছপালা বৃদ্ধির স্বাধীনতা পেলে প্রকৃতি কতো সুন্দর আর ভয়ংকর হতে পারে।

এ বনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলে নর্ত নদী। যা বনের রূপকে আরও আকর্ষনীয়, মনোরম করে তুলেছে। নদীটিকে দেখে যদিও মরা খালের মতো মনে হয় তারপরও বনের মাঝে এটির কিছুটা প্রবাহ আছে। বর্ষায় এই নদীতে স্রোত থাকে। বনের ভেতরে নদীর যতদূর বিস্তৃতি আছে সেই অংশে নদী দূষণ কম। নদীর উপর দিয়ে একটি সেতু তৈরী করে বনের মূল অংশের সাথে বনভোজনের এলাকার যোগাযোগ সহজ করেছে ও এর ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে। নদী পার হলেই কিছু ভ্যানগাড়ি দেখা যায়। এরমাধ্যমে পর্যটকদের বনের ভেতর কিছু স্থান ও সাঁওতাল পাড়াগুলো ঘুরে বেড়িয়ে দেখতে পারে। যাদের একদিনে পুরো বনকে খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে তারা কিছু টাকা দিয়ে ঘণ্টা বা দিন হিসেবে চালকসহ ভ্যান নিয়ে নিতে পারেন। ভ্যান থামিয়ে থামিয়ে ছবি তুলে হেঁটে বেড়িয়ে বনের মনোরম পরিবেশ দেখতে পারেন। যারা কম সময় নিয়ে বেড়াতে তাদের জন্যেও একই ব্যবস্থা। আবার যার ইচ্ছে নিজেই ভবঘুরের মতো হারিয়ে যেতে পারেন বনের গহীনে।

আরো পড়ুন:  পাথরকাটা নদী বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার একটি নদী

নদীর দু’পাড় ঘেঁসে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বাহারী গাছ। শাল বনের ভিতরের আছে আগর ও বাঁশ, বেত বাগান যা সকলের নিকট দর্শনীয়ও বটে। বনের গভীরে চলতে চলতে চোখে পড়বে সেই প্রাচীন পত্রঝরা সিংড়ার শাল গাছ। তবে শাল ছাড়াও এখানে আছে জারুল, শিমুল, মিনজিরি, তরুল, শিলকড়ই, সেগুন, গামার, গুটিজাম, হরতকি, আকাশমনি, ঘোড়ানিম, হলুদ সোনালু, বয়রা, আমলকি. এবং বিভিন্ন ধরনের নাম না জানা উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম গাছ রয়েছে। এ ছাড়া খরগোশ, শেয়াল, সাপ, বেজি এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও পতঙ্গ দেখা যাবে। বনের ভেতরে মাঝে মাঝে বানর ধরা ফাঁদ চোখে পড়বে। আর দেখা যাবে পিঁপড়ের অসাধারণ ঢিপ।

এই বনে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ, পানি ও পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেই সিংড়া ফরেস্ট হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় এক পর্যটন কেন্দ্র। তবে বনের ভেতরে যদি কৃত্রিমতা বেশি করে পর্যটকে আকর্ষন করা হয় তাহলে বন তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবে।

সিংড়া বনের নর্ত নদীর এক পাশে পিকনিকের জন্য নানা আয়োজন করা আছে। নদী পার হয়েই বনের তারপরেই সাঁওতাল পাড়া, বাজার। সিংড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর নর্ত নদী পার হলেই আঁকাবাঁকা পথ নিয়ে যাবে সাঁওতাল পাড়া সিংড়াতে। সেখানে নানা নকশা আঁকা বাড়িগুলো অবাক করে দিবে শিশুর চোখের মতো। সাঁওতালরা তাঁদের বাড়ির মাটির দেওয়াল রং করার জন্য সাধারণত এক ধরণের লাল মাটি ব্যবহার করে। লাল কালো রং দিয়ে হাতের ছোঁয়ায় বাড়িকে সাজায়। প্রত্যেক বাড়িতেই গাছ আছে, ছায়া আছে, কষ্ট আছে। কিন্তু তাঁদের দেওয়ালে দুঃখের চিহ্ন নেই।

বর্তমানে এই গহীন অরন্যে ধীরে ধীরে লোকের বসতি গড়ে উঠতে থাকে। গাছ চুরি হতে থাকে, এসব সংরক্ষন অভাবে গাছপালা কমে যাচ্ছে, পশু পাখি অনেক কমে গিয়েছে। যদিও এখন এই জাতীয় উদ্যানের উন্নয়নে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই বনের মনোরম প্রাকৃতিক দেখতে প্রতিদিন দেড়’শ থেকে দু’শ জন আসে।  শীতকালে পর্যটক বেড়ে যায়। পর্যটক আকর্ষন করার চেয়ে প্রাচীন পত্রঝরা এই বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পশু পাখির অভায়রন্য করার দিকে কতৃপক্ষের মনোযোগ প্রযোজন।

আরো পড়ুন:  তেতুলিয়া নদী বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dolon Prova

Leave a Comment

error: Content is protected !!