মহান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন কমিটি, ময়মনসিংহ আয়োজিত একটি আলোচনা সভা গত ২৫ নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল তিনটায় শহরের মুসলিম ইন্সিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা চারটায় শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠানটি। প্রিন্সিপাল আব্দুস শহীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শহীদ বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক স্মৃতি সংসদের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য বিজন সম্মানিত।
আয়োজক কমিটির পক্ষে স্বাগত বক্তব্যে বিজন সম্মানিত এই অনুষ্ঠান করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “অক্টোবর বিপ্লব নিয়ে গত একবছর ধরে বিভিন্ন আয়োজন চোখে পড়েছে, কয়েকটায় আলোচনা শোনার সুযোগ হয়েছে। তাদের আলোচনায় সংশোধনবাদী ধারার। তাদের আলোচনায় স্তালিন নিয়ে কোন কথা প্রায় শোনাই যায় নি, উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পূর্ব পর্যন্ত তারা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত মনে করে- আমরা তা মনে করি না। ক্রুশ্চেভ ব্রেজনেভের সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমরা আর সমাজতান্ত্রিক ধারা মনে করি না। আমরা এসব বলতে চাই, আলোচনা জরুরী মনে করি।”
আলোচনায় জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ খান বলেন, “আমরা দেখেছি সরকারের গুয়েবলসরা এই দেশে বিপ্লবের অথরটি বনে বসে আছে।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে আমাদের প্রকৃত বলশেভিক পার্টি গড়ে তুলতে হবে। কোনো দেশে কোনো অবস্থাতেই বলশেভিক ধরণের পার্টি ছাড়া বিপ্লব করা সম্ভব না।” মাসুদ খান তার বক্তৃতায় সংশোধনবাদী ভেকধরা সমাজতান্ত্রিকদের বিষয়ে সাবধান করেন। তিনি আরও বলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রী নামে সমাজতন্ত্রের শত্রুরা অবস্থান নিয়েছে। টনি ব্লেয়ার বা এঞ্জেলা মারকেলরাও নিজেদের সমাজতন্ত্রী বলেন। তথাকথিত কমিউনিস্ট নাম নিয়েই কমিউনিজমের ক্ষতি করা সবচেয়ে সহজ।
সর্বশেষ বক্তা হিসেবে কথা বলেন মার্কসবাদী রবীন্দ্র গবেষক, দেশের অন্যতম প্রধান মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বুদ্ধিজীবি সৈয়দ আবুল কালাম। তিনি এক ভোটের ফাঁকা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা পাঁচ বছরে একবার ভোট নিয়ে লুটপাট হালাল করে নেন। এই দেশের বামপন্থিদেরও তাদের কথায় নাচতে দেখা যায়। তারা বলে, আমার ভোট আমি দেবো যাকে খুশি তাকে দেবো। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষকে একা করে দেয়া হয়, লাখ লাখ ভোটার একা হয়ে যান, যাকে খুশি ভোট দেন। আমরা লাখ লাখ একা একা মানুষ দেখি। এইভাবে চলতে পারে না।” সৈয়দ আবুল কালাম উল্লেখ করেন যে বিশ্বের এই ব্যবস্থা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এই প্রসঙ্গে তিনি ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের প্রসঙ্গ টানেন। সারা দুনিয়াতে বর্তমানে চলছে ধনিক শ্রেণীর একনায়তন্ত্র, এই ধনিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র হটিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব কায়েমের সময় দ্বারপ্রান্তে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সমস্ত নিপীড়িত মানুষের কাছে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হচ্ছে সোভিয়েত বিপ্লব।
অনুষ্ঠানে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিভিন্ন দিকের উপর যথাযথ আলোচনা করা হয়। উক্ত শতবার্ষিকীর আলোচনা সভায় আরো আলোচনা করেন প্রাক্তন ছাত্রনেতা রতন সম্মানিত, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের জেলা সভাপতি শেখ আবেদ আলী, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আহবায়ক ও বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা তৌহিদুল ইসলাম। বক্তারা বলেন, যুগে যুগে ক্ষনজন্মা মহাপুরুষেরা গরীব ও দুঃখি মানুষের প্রতি মমত্ববোধ দেখিয়েছেন, তাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতনও ভোগ করেছেন। কিন্তু তাঁরা শোষিত ও নির্যাতিত মানুষ কে মুক্তির সঠিক পথ দেখাতে পারেননি। ১৯১৭ সনে মহান রুশ বিপ্লবের পর পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ তার মুক্তির সঠিক পথের সন্ধান পায়।
অনুষ্ঠানে নেতৃবৃন্দ বলেন, মুক্তি পেতে হলে মুক্তির প্রতিবন্ধকতা কি সেটা আগে উন্মোচিত করতে হবে। শোষক লুটেরা পুঁজিপতিদের পরাজিত করে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণহীণ ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র পৃথিবীর গণমানুষের মনে যে আশার সঞ্চার করেছিল, এর প্রতিবন্ধক হিসেবে দাড়ায় ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ চক্র। লেনিন-স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর এরা সমাজতন্ত্রের নামে মুক্তিকামী মানুষের সাথে ধোঁকাবাজী করে। সোভিয়েত রাশিয়াকে এরা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদে পরিনত করে। এই বিশ্বাসঘাতক ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভের অনুসারীরা সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের নামে মাঠ গরম করে বেড়াচ্ছে। রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী পালন করছে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এরা একদিকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল শাসকশ্রেণীর লেজুড়বৃত্তি করে, অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের কথা বলে, মুক্তির কথা বলে। বক্তারা বলেন, মার্কস-এঙ্গেলস সূচিত সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের পথে যে বিপ্লবী অভিযাত্রা শুরু হয়, সেই লড়াই এগিয়ে নিতে হলে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের দালাল শাসকশ্রেণীকে উচ্ছেদের সংগ্রামের পাশাপাশি ভূঁয়া সমাজতন্ত্রীদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণের পূর্বে তপন সাহা চৌধুরী একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, মার্কস লেনিন মাও সেতুংয়ের ধারার একটি পাঠচক্র নিয়মিত করা প্রয়োজন। তিনি ময়মনসিংহের আয়োজকদের কাছে এই পাঠচক্রটি সংগঠিত করতে অনুরোধ করেন।
এছাড়াও বামপন্থী বিভিন্ন পার্টির পক্ষে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা তপন সাহা চৌধুরী, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কাজী সালাউদ্দিন মুকুল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) ময়মনসিংহ জেলা সমন্বয়ক শেখর রায় প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আলোচনার পাশাপাশি ছিল বিপ্লবী কবিতা পাঠ। রাজনৈতিক ধারার কবিতা আবৃত্তি করেন মাওবাদী কবি আশিক আকবর, জনগণের কবি শামসুল ফয়েজ, প্রকৃতিবাদী কবি এহসান হাবীব এবং মানুষ ও জনপদের কবি সরকার আজিজ। আলোচনা সভাটির উপস্থাপনা ও পরিচালনা করেন নয়া-গণতান্ত্রিক গণমোর্চার নেতা আবু বকর সিদ্দিক রুমেল।
ভবিষ্যৎ সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রিন্সিপাল আব্দুস শহীদ আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য মহান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে ময়ননসিংহে গত ২ নভেম্বর সন্ধা ৬টায় প্রিন্সিপাল আব্দুস শহীদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় প্রিন্সিপাল আব্দুস শহীদকে আহবায়ক, আবুবকর সিদ্দিক রুমেলকে সদস্য সচিব করে একটি উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ সদস্যের উক্ত কমিটিতে ছিলেন বিজন সম্মানিত, প্রফেসর মাহমুদুল আমীন খান, শেখ আবেদ আলী, রতন সম্মানিত, ফরিদুল ইসলাম ফিরোজ, বদিউল আলম লিটন, শান্ত আলী, হাসান জামিল, যদু ঘোষ মিহির, গগন পন্ডিত, সুরঞ্জিত বারই প্রমুখ।