দর্শন বিষয়ক এই রচনাটি মাও সেতুং কর্তৃক তাঁর “অনুশীলন সম্পর্কে” রচনাটির পরে একই উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ঐ যুগে পার্টির অভ্যন্তরে বিদ্যমান মতান্ধতাবাদী চিন্তাধারার মারাত্মক ভুলগুলো শোধরানোর জন্য লিখিত হয়। এটি প্রথমে ইয়েনানে “জাপ-বিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক কলেজে” ভাষণরূপে প্রদত্ত হয়। “মাও সেতুং-এর নির্বাচিত রচনাবলী”-তে অন্তর্ভুক্ত করবার সময়ে লেখক রচনাটি আংশিকভাবে সংশোধন করেন।
বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্বের নিয়ম, অর্থাৎ বিপরীতের একত্বের নিয়ম হলো বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের সবচেয়ে মৌলিক নিয়ম। লেনিন বলেছেন: “প্রকৃত অর্থে দ্বন্দ্ববাদ হচ্ছে বস্তুর একেবারে মর্মে দ্বন্দ্বের পর্যালোচনা।”[১] লেনিন এই নিয়মকে প্রায়ই দ্বন্দ্ববাদের মর্ম বলতেন; তিনি এটাকে দ্বন্দ্ববাদের শাঁস বলেও অভিহিত করেছেন[২]। সুতরাং এই নিয়মটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে, আমরা বিভিন্ন প্রকারের প্রশ্ন, অনেক দার্শনিক সমস্যা আলোচনা না করে পারি না। আমরা যদি এসব সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কার হতে পারি, তাহলে আমরা বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদ সম্পর্কে একটা মৌলিক উপলব্ধিতে পৌঁছব। এই সমস্যাগুলো হচ্ছে: দুই বিশ্বদৃষ্টি; দ্বন্দ্বের সর্বজনীনতা; দ্বন্দ্বের বিশিষ্টতা; প্রধান দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বের প্রধান দিক; দ্বন্দ্বের দিকগুলোর অভিন্নতা ও সংগ্রাম; দ্বন্দ্বে বৈরিতার স্থান।
সোভিয়েত দার্শনিক মহলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেবোরিন সম্প্রদায়ের ভাববাদের যে সমালোচনা করা হয়েছে তা আমাদের মধ্যে গভীর ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করেছে। দেবোরিনের ভাববাদ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সুদূরপ্রসারী মন্দ প্রভাব বিস্তার করেছে, এবং একথা বলা চলে না যে, আমাদের পার্টির ভিতরে মতান্ধতাবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে ঐ সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং, দর্শন সম্বন্ধে আমাদের বর্তমান পর্যালোচনার মূল লক্ষ্য হবে মতান্ধতাবাদী চিন্তাধারার মূল উচ্ছেদ করা।
১. দুই বিশ্বদৃষ্টি
মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসে বিশ্ব বিকাশের নিয়ম সম্পর্কে চিরকালই দুটি ধারণা চলে এসেছে, আধিবিদ্যক ধারণা এবং দ্বন্দ্ববাদী ধারণা, যেগুলো দুটি পরস্পর বিরোধী বিশ্বদৃষ্টি সৃষ্টি করে। লেনিন বলেছেন:
“বিকাশের (বিবর্তনের) দুটি মূল (অথবা দুটি সম্ভাব্য? অথবা দুটি ঐতিহাসিকভাবে লক্ষণীয়?) ধারণা হচ্ছে: ১. হ্রাস ও বৃদ্ধি রূপে, পুনরাবৃত্তি রূপে বিকাশ; ২. বিপরীতের একত্ব রূপে বিকাশ (পরস্পর ব্যতিরেকী বিপরীতে একত্বের বিভাজন এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক)।”[৩]
এখানে লেনিন এই দুই পৃথক বিশ্বদৃষ্টির কথাই উল্লেখ করেছেন।
চীনে অধিবিদ্যার আরেক নাম স্যুয়ান-স্যুয়ে। চীনে হোক বা ইউরোপেই হোক, ইতিহাসের এক সুদীর্ঘকাল জুড়ে এই ধরনের চিন্তা—যা ভাববাদী বিশ্বদৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ—মানবিক চিন্তাধারায় প্রধান স্থান দখল করেছে। ইউরোপে প্রথমদিকে বুর্জোয়াদের বস্তুবাদও ছিল আধিবিদ্যক। ইউরোপের বহু দেশে সামাজিক অর্থনীতি যখন পুঁজিবাদের অত্যুন্নত স্তরে অগ্রসর হয়েছে, উৎপাদনশক্তি, শ্রেণিসংগ্রাম ও বিজ্ঞান সব কিছুই ইতিহাসে অভূতপূর্ব এক স্তরে বিকশিত হয়েছে এবং শিল্প-সর্বহারা শ্রেণি ঐতিহাসিক বিকাশের বৃহত্তম চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে কেবল তখনই বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের মার্কসবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির অভ্যুদয় ঘটেছে। এর পরে, প্রকাশ্য এবং নগ্ন প্রতিক্রিয়াশীল ভাববাদ ছাড়াও, বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে অমার্জিত বিবর্তনবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের বিরোধিতা করার জন্য।
আধিবিদ্যক বা অমার্জিত বিবর্তনবাদী বিশ্বদৃষ্টি বিশ্বকে বিচ্ছিন্ন, নিশ্চল ও একদেশদর্শীভাবে দেখে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের সকল বস্তুকে এবং তাদের রূপকে ও তাদের প্রজাতিকে মনে করে চিরস্থায়ীভাবে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অপরিবর্তনীয়। যে পরিবর্তন হয় তা কেবল পরিমাণের হাস বা বৃদ্ধি, অথবা স্থানের পরিবর্তন হতে পারে। অধিকন্তু, এরকম হ্রাস বা বৃদ্ধি অথবা স্থানের পরিবর্তনের কারণ বস্তুর ভিতরে নয়, বাইরে অবস্থিত, অর্থাৎ, এই কারণ বহিঃশক্তির তাড়না। আধিবিদ্যকদের মতে, বিশ্বে বিভিন্ন প্রকারের সকল বস্তু এবং তাদের সকল বৈশিষ্ট্য তাদের অস্তিত্বে আসার সময় থেকে একই অবস্থায় আছে। পরবর্তীকালের যেটুকু পরিবর্তন তা শুধু পরিমাণগত প্রসারণ বা সংকোচন। তাঁরা মনে করেন যে, চিরকাল ধরে একটা বস্তু কেবল একই প্রকারের বস্তু হিসেবে বারংবার নিজের পুনরাবৃত্তি করে যেতে পারে, কিন্তু কোনো স্বতন্ত্র বস্তুতে পরিবর্তিত হতে পারে না। আধিবিদ্যকদের মতে, ধনতান্ত্রিক শোষণ, ধনতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ধনতান্ত্রিক সমাজের ব্যক্তিবাদী মতাদর্শ এবং অনুরূপ সবকিছুই প্রাচীন দাস সমাজে বা এমন কি আদিম সমাজেও দেখতে পাওয়া যায়, এবং এগুলো চিরকাল অপরিবর্তিতভাবে বিদ্যমান থাকবে। তাঁরা সামাজিক বিকাশের কারণগুলো ভূগোল ও আবহাওয়ার মতো সমাজের বাহ্যিক উপাদানের ওপর আরোপ করে থাকেন। তাঁরা বস্তুর বাইরে ঐ বস্তুর বিকাশের কারণগুলোকে অতি সরলীকৃত পন্থায় খুঁজে থাকেন, এবং বস্তুর বিকাশ যে তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই ঘটে থাকে—এই বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের মতবাদটিকেই অস্বীকার করে থাকেন। ফলে তাঁরা বস্তুর গুণগত বিভিন্নতা, বা এক গুণের অন্য গুণে পরিবর্তনের মতো ব্যাপারকে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। ইউরোপে এই ধরনের চিন্তা ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে যান্ত্রিক বস্তুবাদ হিসেবে এবং উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের শুরুতে অমার্জিত বিবর্তনবাদ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। চীনে আধিবিদ্যক চিন্তাধারার অস্তিত্বের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এই উক্তিটির মধ্যে—“স্বর্গ যেমন বদলায় না, তাও-ও তেমনি বদলায় না”[৪] , এবং এই ধারণা দীর্ঘকাল যাবৎ ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক শাসক শ্রেণীগুলো কর্তৃক সমর্থিত হয়েছিল। গত একশ বছর ধরে ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত যান্ত্রিক বস্তুবাদ ও অমার্জিত বিবর্তনবাদ বুর্জোয়া শ্রেণি কর্তৃক সমর্থিত।
আধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টির বিপরীতে, বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের বিশ্বদৃষ্টি মনে করে যে, কোনো বস্তুর বিকাশকে বোঝার জন্য আমাদের ঐ বস্তুর অভ্যন্তরে এবং অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যে পর্যালোচনা করতে হবে; অন্য কথায়, বস্তুর বিকাশকে তার অভ্যন্তরীণ ও অপরিহার্য নিজস্ব গতিরূপেই দেখতে হবে, আর প্রত্যেক বস্তুই তার গতিধারায় চতুর্দিকের অন্যান্য বস্তুসমূহের সঙ্গে পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত এবং পরস্পরের ওপর ক্রিয়া করে। বস্তুর বিকাশ লাভের মৌলিক কারণ বাহ্যিক নয়, তা হলো অভ্যন্তরীণ; বস্তুর অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যেই তা নিহিত। প্রত্যেক বস্তুর ভিতরেই এই ধরনের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, সেজন্যই বস্তু গতিশীল ও বিকাশশীল। বস্তুর ভিতরকার এই ধরনের দ্বন্দ্বই হচ্ছে বস্তুর বিকাশ লাভের মৌলিক কারণ, অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে আন্তঃসংযোগ ও আন্তঃক্রিয়া হচ্ছে তার বিকাশ লাভের গৌণ কারণ। এইভাবে, বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদ কার্যকরভাবে আধিবিদ্যক যান্ত্রিক বস্তুবাদ ও অমার্জিত বিবর্তনবাদ কর্তৃক পেশকৃত বাহ্যিক কারণ বা বাহ্যিক চালিকাশক্তি সংক্রান্ত তত্ত্বের মোকাবিলা করে। এটা পরিষ্কার যে, নিছক বাহ্যিক কারণ থেকে শুধুমাত্র যান্ত্রিক গতিই সৃষ্টি হতে পারে, অর্থাৎ আকৃতিগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটতে পারে, কিন্তু কেন যে বস্তুসমূহ হাজারো দিক দিয়ে গুণগতভাবে পৃথক এবং কেনই বা এক বস্তু অন্য বস্তুতে পরিবর্তিত হয়ে যায় তা বাহ্যিক কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। বাস্তবিকপক্ষে, এমনকি বহিঃশক্তির তাড়নায় কোনো বস্তুর যান্ত্রিক গতি তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই উৎপন্ন হয়। গাছপালা ও জীবজন্তুর সরল বৃদ্ধি এবং পরিমাণগত বিকাশও প্রধানত তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলেই ঘটে। একইভাবে, সমাজের বিকাশ প্রধানত বাহ্যিক কারণে নয় অভ্যন্তরীণ কারণেই ঘটে। বহু দেশে প্রায় একই ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত অবস্থা বিদ্যমান, তথাপি বিকাশের দিক থেকে তাদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য ও অসমতা রয়েছে। অধিকন্তু, একটি দেশের ভূগোল ও জলবায়ু অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও ঐ একই দেশে সমাজের বিরাট পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিবর্তিত হয়েছে, এবং দ্বার রুদ্ধ করে বিশ্বে আত্মগোপন করে থাকা সামন্ততান্ত্রিক জাপান পরিবর্তিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী জাপানে, অথচ দেশ দুটির ভূগোল ও জলবায়ুর কোনোই পরিবর্তন হয়নি। দীর্ঘকালব্যাপী সামন্তব্যবস্থার অধীন চীনে গত এক শ বছরে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, এবং এখন স্বাধীন ও মুক্ত এক নতুন চীনের দিকে পরিবর্তিত হচ্ছে, তথাপি চীনের ভূগোল ও জলবায়ুর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সমগ্র পৃথিবী এবং তার প্রত্যেকটি অংশে ভূগোল ও জলবায়ুরও অবশ্যই পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে থাকে, কিন্তু সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনা করলে সেগুলো অকিঞ্চিৎকর; ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত পরিবর্তন লক্ষ লক্ষ বছরে আত্মপ্রকাশ করে, আর সামাজিক পরিবর্তন আত্মপ্রকাশ করে কয়েক হাজার, কয়েক শ বছরে অথবা কয়েক দশকে এবং এমনকি, বিপ্লবের সময়ে, কয়েক বছরে বা মাসে। বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদ অনুযায়ী, প্রকৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে প্রধানত প্রকৃতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিকাশের ফলে। সমাজের পরিবর্তন ঘটে প্রধানত সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিকাশের ফলে, অর্থাৎ উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, শ্রেণিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং নতুন ও পুরাতনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলে; এই দ্বন্দ্বগুলোর বিকাশই সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয় এবং পুরাতন সমাজের স্থানে নতুন সমাজ স্থাপনের প্রেরণা দেয়। বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদ কি বাহ্যিক কারণকে বাতিল করে? মোটেই না। বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের মতে বাহ্যিক কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের শর্ত, আর অভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের ভিত্তি; অভ্যন্তরীণ কারণের মাধ্যমে বাহ্যিক কারণ সক্রিয় হয়। যথাযথ তাপেই মুরগির ডিম মুরগির ছানায় পরিবর্তিত হয়, কিন্তু কোনো তাপই পাথরকে মুরগির ছানায় পরিবর্তন করতে পারে না, কারণ এ দুইয়ের ভিত্তি ভিন্ন। বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে অবিরাম আন্তঃক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলেছে। ধনতন্ত্রের যুগে, এবং বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের আন্তঃক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাত অত্যন্ত বেশি। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু রুশ ইতিহাসে নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের উপর এবং সমভাবে ও বিশেষ গভীরভাবে, চীনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের উপর এটা প্রভাব বিস্তার করেছে। ঐ পরিবর্তনগুলো, অবশ্য, চীনসহ ঐ দেশগুলোর বিকাশের অভ্যন্তরীণ নিয়মাবলীর মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধে একটি সৈন্যদল জয়ী হয় এবং অন্যটি পরাজিত হয়; জয় ও পরাজয় উভয়ই অভ্যন্তরীণ কারণ দ্বারা নির্ধারিত হয়। একটি যে জয়ী হলো, তার কারণ, হয় সে শক্তিশালী, না হয় তার পরিচালনা সুযোগ্য; আর যে পরাজিত হলো তার কারণ, হয় সে দুর্বল, না হয় তার পরিচালনা অযোগ্য; অভ্যন্তরীণ কারণের মধ্য দিয়েই বাহ্যিক কারণ কার্যকর হয়। ১৯২৭ সালে চীনের বড় বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে সর্বহারা শ্রেণির পরাজয় ঘটেছিল তৎকালে চীনা সর্বহারা শ্রেণির ভিতরে (চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে) বিদ্যমান সুবিধাবাদের মাধ্যমে। যখন আমরা এই সুবিধাবাদকে নির্মূল করলাম, চীন বিপ্লবের অগ্রগতি পুনরায় শুরু হলো। পরবর্তীকালে, শত্রুর হাতে চীন বিপ্লবের পুনরায় গুরুতর বিপর্যয় ঘটেছিল, কারণ আমাদের পার্টির মধ্যে হঠকারিতার উদ্ভব হয়েছিল। যখন আমরা এই হঠকারিতা নির্মূল করলাম, তখন আমাদের আদর্শ পুনরায় অগ্রসর হলো। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিপ্লবকে বিজয়ের দিকে পরিচালনা করতে হলে, একটি রাজনৈতিক পার্টিকে অবশ্যই তার রাজনৈতিক লাইনের নির্ভুলতা ও নিজস্ব সংগঠনের দৃঢ়তার ওপর নির্ভর করতে হবে।
দ্বন্দ্ববাদী বিশ্বদৃষ্টি চীনে এবং ইউরোপে প্রাচীনকালেই দেখা দেয়। কিন্তু প্রাচীন দ্বন্দ্ববাদের চরিত্র ছিল কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত এবং সাদাসিধা; তৎকালীন সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থায়, তখনও পর্যন্ত প্রাচীন দ্বন্দ্ববাদ একটা তত্ত্বগত প্রণালী গঠন করতে সক্ষম হয়নি, এজন্য এটা বিশ্বকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি, এবং পরে অধিবিদ্যা দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক হেগেল, যাঁর জীবনকাল ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত, দ্বন্দ্ববাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, কিন্তু তাঁর দ্বন্দ্ববাদ ছিল ভাববাদমূলক। সর্বহারা আন্দোলনের মহান নায়ক মার্কস ও এঙ্গেলস যখন মানবিক জ্ঞানের ইতিহাসের যথার্থ কীর্তিগুলোর সমন্বয় সাধন করে, বিশেষ করে সমালোচনাত্মক পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদের যুক্তিপূর্ণ উপাদানগুলো গ্রহণ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মহান তত্ত্ব সৃষ্টি করলেন, কেবল তখনি মানবিক জ্ঞানের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব মহাবিপ্লব সংঘটিত হলো। পরে লেনিন ও স্তালিন এই মহান তত্ত্বকে আরও বিকশিত করেন। চীনে এই তত্ত্ব বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের চিন্তাজগতে এক প্রচণ্ড পরিবর্তন ঘটে গেল।
এই দ্বন্দ্ববাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রধানত শিক্ষা দেয়, কেমন করে বিভিন্ন বস্তুতে দ্বন্দ্বের গতিকে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করতে হবে, এবং সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কেমন করে দ্বন্দ্বগুলোর সমাধানের উপায় বের করতে হবে। এজন্য বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্বের নিয়মকে মূর্তভাবে বোঝা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মাও সেতুং বা মাও সে তুং বা মাও জেদং (ইংরেজি: Mao Tse-Tung; ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯৩ – ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ খ্রি.) মার্কসবাদী বিপ্লবী তাত্ত্বিক, সাম্যবাদী রাজনৈতিক নেতা, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। জাপানি দখলদার শক্তি এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার কুওমিনটাং নেতা চিয়াং কাইশেকের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লবের জন্য চীনের অগণিত এবং অনুন্নত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৌশলী হিসেবে মাও সেতুং এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণাদায়ক উপকথায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অনেক জটিল কথাকে জনগণের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। জনগণের সেবায় মানবেতিহাসের সমস্ত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।