৪. প্রধান দ্বন্দ্ব এবং দ্বন্দ্বের প্রধান দিক
দ্বন্দ্বের বিশিষ্টতা সম্পর্কে আরও দুটি বিষয় আছে, যা বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, যথা, প্রধান দ্বন্দ্ব এবং দ্বন্দ্বের প্রধান দিক।
একটি জটিল বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় অনেক দ্বন্দ্ব আছে, এবং এগুলোর মধ্যে একটি স্বভাবতই প্রধান দ্বন্দ্ব যার অস্তিত্ব ও বিকাশ অন্যান্য দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব ও বিকাশকে নির্ধারিত বা প্রভাবিত করে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, ধনতান্ত্রিক সমাজে দ্বন্দ্বরত দুই শক্তি, সর্বহারা শ্রেণি এবং বুর্জোয়া শ্রেণি প্রধান দ্বন্দ্ব গঠন করে। অন্যান্য দ্বন্দ্ব, যেমন, অবশিষ্ট সামন্ত শ্রেনি ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যকার দ্বন্দ্ব, কৃষক পাতি বুর্জোয়া ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সর্বহারা ও কৃষক পাতি বুর্জোয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অ-একচেটিয়া পুঁজিপতি ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও বুর্জোয়া ফ্যাসিবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সবই নির্ধারিত বা প্রভাবিত হয় ঐ প্রধান দ্বন্দ্ব দ্বারা।
চীনের মত আধা-ঔপনিবেশিক দেশে, প্রধান দ্বন্দ্ব এবং অপ্রধান দ্বন্দ্বগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক একটা জটিল চিত্র উপস্থিত করে।
এরূপ একটা দেশের বিরুদ্ধে যখন সাম্রাজ্যবাদ আক্রমণ শুরু করে, কিছুসংখ্যক বিশ্বাসঘাতক ছাড়া ঐ দেশের সকল বিভিন্ন শ্রেণি সাময়িকভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা জাতীয় যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। এ সময়ে, সাম্রাজ্যবাদ ও ঐ দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হয়, আর দেশের ভিতরে বিভিন্ন শ্রেণির দ্বন্দ্বসমূহ (সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ব্যাপক জনসাধারণের মধ্যকার যে দ্বন্দ্বটি প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল সেটি সহ) সাময়িকভাবে অপ্রধান ও অধীনস্থ স্থানে অবনত হয়। চীনে এই অবস্থা ঘটেছিল ১৮৪০ সালের আফিম যুদ্ধে, ১৮৯৪ সালের চীন-জাপান যুদ্ধে ও ১৯০০ সালের ইহোথুয়ান যুদ্ধে; এবং বর্তমান চীন-জাপান যুদ্ধে এই অবস্থা চলছে।
কিন্তু অন্য এক পরিস্থিতিতে দ্বন্দ্বগুলো অবস্থান পরিবর্তন করে। যখন সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত নম্র উপায়ে, অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপায়ে নির্যাতন চালিয়ে যায়, তখন আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলোর শাসকশ্রেণিগুলো সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং উভয়পক্ষ মিলিতভাবে ব্যাপক জনসাধারণকে নির্যাতনের জন্য একটা মৈত্রী গঠন করে। এরকম সময়ে, জনগণ প্রায়ই সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তশ্রেণিগুলোর মৈত্রীর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের আশ্রয় নেয়, আর সাম্রাজ্যবাদ জনগণকে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে প্রতিক্রিয়াপন্থীদের সাহায্য করার জন্য প্রায়ই প্রত্যক্ষ কার্যকলাপের পরিবর্তে পরোক্ষ পন্থাগুলো কাজে লাগায়, এবং এইভাবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলো বিশেষ তীব্র হয়ে ওঠে। এটাই ঘটেছিল চীনে ১৯১১ সালের বিপ্লবী যুদ্ধে, ১৯২৪-২৭ সালের বিপ্লবী যুদ্ধে এবং ১৯২৭ সাল থেকে দশ বছরব্যাপী ভূমি-বিপ্লবী যুদ্ধে। আধা-ঔপনিবেশিক দেশে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধগুলো, দৃষ্টান্তস্বরূপ, চীনে সমরনায়কদের মধ্যে যুদ্ধগুলোও এই শ্রেণিভুক্ত।
যখন একটা বিপ্লবী গৃহযুদ্ধ এতদূর বিকাশ লাভ করে যে, সাম্রাজ্যবাদ ও তার পা-চাটা কুকুর দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ে, তখন সাম্রাজ্যবাদ প্রায়ই তার শাসন বজায় রাখার জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করে; সাম্রাজ্যবাদ হয় ভিতর থেকে বিপ্লবী ফ্রন্টকে বিভক্ত করার চেষ্টা করে, নতুবা দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সরাসরি সাহায্য করার জন্য সশস্ত্র সৈন্যদল প্রেরণ করে। এরকম সময়ে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা খোলাখুলিভাবে এক সঙ্গে দাঁড়ায় এক প্রান্তে, আর ব্যাপক জনসাধারণ দাঁড়ায় অন্য প্রান্তে এবং এইভাবে প্রধান দ্বন্দ্বটি গঠন করে যে দ্বন্দ্ব অন্যান্য দ্বন্দ্বের বিকাশকে নির্ধারিত বা প্রভাবিত করে। অক্টোবর বিপ্লবের পরে, বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ কর্তৃক রুশ প্রতিক্রিয়াপন্থীদেরকে প্রদত্ত সাহায্য সশস্ত্র হস্তক্ষেপের একটা নজির। ১৯২৭ সালে চিয়াং কাইশেকের বিশ্বাসঘাতকতা বিপ্লবী ফ্রন্টকে বিভক্ত করার একটা নজির।
কিন্তু যাই ঘটুক না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, একটা প্রক্রিয়ার বিকাশের প্রত্যেক স্তরে প্রধান দ্বন্দ্ব মাত্র একটাই, যা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে।
অতএব দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রক্রিয়াতে যদি অনেক দ্বন্দ্ব থাকে তাহলে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটি হবে প্রধান দ্বন্দ্ব, যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে, আর অন্যগুলো দখল করবে গৌণ ও অধস্তন স্থান। তাই, দুই বা দুইয়ের বেশি দ্বন্দ্ববিশিষ্ট কোনো জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা করতে গেলে, আমাদের অবশ্যই সেগুলোর মধ্যে প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে বের করার জন্য সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। একবার এই প্রধান দ্বন্দ্বকে হৃদয়ঙ্গম করা গেলে সব সমস্যারই সহজে সমাধান করা যায়। ধনতান্ত্রিক সমাজ পর্যালোচনার মাধ্যমে মার্কস আমাদেরকে এই পদ্ধতি শিখিয়েছেন। লেনিন ও স্তালিনও একইভাবে আমাদেরকে এই পদ্ধতি শিখিয়েছেন তাঁদের সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের সাধারণ সংকটের পর্যালোচনায় এবং সোভিয়েত অর্থনীতির পর্যালোচনায়। হাজার হাজার পণ্ডিত ব্যক্তি ও বাস্তব ক্ষেত্রের কর্মী রয়েছেন যাঁরা এই পদ্ধতি বোঝেন না, এবং তার ফলে ঘন কুয়াশায় দিশেহারা হয়ে তাঁরা সমস্যার মর্মটিই ধরতে পারেন না এবং স্বভাবতই দ্বন্দ্বগুলো সমাধানের পথও খুঁজে পান না।
পূর্বেই বলেছি, কোনো একটা প্রক্রিয়ার সমস্ত দ্বন্দ্বকে সমানভাবে দেখা চলবে না, প্রধান ও গৌণের মধ্যে পার্থক্য করতে হবেই এবং প্রধানটিকে ধরবার জন্য বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু যে কোনো নির্দিষ্ট দ্বন্দ্বে, প্রধান হোক বা গৌণ হোক, দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দিককে কি আমরা সমান বলে মনে করতে পারি? পুনরায়, না। যে কোনো দ্বন্দ্বে প্রতিদ্বন্দ্বী দিকগুলোর বিকাশ অসমান। কখনও কখনও তাদের মধ্যে ভারসাম্য দেখা যায় বটে, কিন্তু তা সাময়িক ও আপেক্ষিক মাত্র, অসমতাই মৌলিক। দুটি দ্বন্দ্বমান দিকের মধ্যে একটি দিক অবশ্যই প্রধান, অপরটি গৌণ। যেটি প্রধান, সেটিই দ্বন্দ্বের মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। বস্তুর প্রকৃতি প্রধানত নির্ধারিত হয় দ্বন্দ্বের প্রধান দিকের দ্বারা, যে দিকটি কর্তৃত্বের স্থান লাভ করেছে।
কিন্তু এই অবস্থাটা স্থাণু নয়; দ্বন্দ্বের প্রধান ও অপ্রধান দিকগুলো একে অপরে রূপান্তরিত হয় এবং তদনুসারে বস্তুর প্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়। কোনো একটি দ্বন্দ্বের বিকাশের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বা একটি নির্দিষ্ট স্তরে প্রধান দিক ক এবং অপ্রধান দিক খ; অন্য একটি স্তরে বা অন্য একটি প্রক্রিয়ায় ভূমিকাগুলো পাল্টে যায়। এই পরিবর্তন নির্ধারিত হয় একটি বস্তুর বিকাশের পথে দ্বন্দ্বের প্রত্যেক দিকের অপর দিকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তার শক্তির বৃদ্ধি বা হ্রাসের পরিমাণ দ্বারা।
আমরা প্রায়ই “নতুন কর্তৃক পুরাতনের স্থান দখল”-এর কথা বলে থাকি। নতুন কর্তৃক পুরাতনের স্থান দখল বিশ্বের সর্বজনীন ও চিরকালীন অলংঘনীয় নিয়ম। বস্তুর নিজ প্রকৃতি ও বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকারের দ্রুত-অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে একটা বস্তুর অপর একটা বস্তুতে রূপান্তর—এটাই নতুন কর্তৃক পুরাতনের স্থান দখলের প্রক্রিয়া। প্রত্যেক বস্তুতে নতুন ও পুরাতন দিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে যা ধারাবাহিকভাবে বহু আঁকবাঁকবিশিষ্ট সংগ্রামের জন্ম দেয়। এই সংগ্রমের ফলে নতুন দিকটি গৌণ থেকে মুখ্যতে পরিবর্তিত হয় এবং প্রাধান্য লাভ করে; আর পুরাতন দিকটি মুখ্য থেকে গৌণে পরিবর্তিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে লয় প্রাপ্ত হয়। এবং যে মুহূর্তে নতুন দিকটি পুরাতন দিকটির উপর প্রাধান্য লাভ করে, পুরাতন বস্তু গুণগতভাবে নতুন বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। এইভাবে দেখতে পাওয়া যায় যে, বস্তুর প্রকৃতি প্রধানত নির্ধারিত হয় দ্বন্দ্বের প্রধান দিকের দ্বারা, যে দিকটি কর্তৃত্বের স্থান লাভ করেছে। যে প্রধান দিকটি কর্তৃত্বের স্থান লাভ করেছে সেটি যখন রূপান্তরিত হয়, বস্তুর প্রকৃতিই তদনুসারে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক যুগে অধীনস্থ শক্তি হিসেবে ধনতন্ত্রের যে অবস্থান ছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজে তা পরিবর্তিত হয়েছে প্রাধান্যের শক্তিতে, এবং সমাজের প্রকৃতি তদনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে সামন্ততান্ত্রিক থেকে ধনতান্ত্রিকে। নতুন, ধনতান্ত্রিক যুগে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো তাদের পূর্বের প্রাধান্যের অবস্থান থেকে অধীনস্থ অবস্থানে। পরিবর্তিত হয়ে ক্রমান্বয়ে লোপ পেয়ে যায়। যেমন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সে এ রকমটিই ঘটেছিল। উৎপাদনশক্তির বিকাশের সাথে, বুর্জোয়া শ্রেণি প্রগতিশীল ভূমিকাযুক্ত এক নতুন শ্রেণি থেকে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকাযুক্ত এক পুরাতন শ্রেণিতে পরিবর্তিত হয়, এবং এই শ্রেণি শেষ পর্যন্ত সর্বহারা শ্রেণি কর্তৃক উৎখাত হয় আর ব্যক্তিগত উৎপাদনের উপকরণসমূহ থেকে বঞ্চিত ও ক্ষমতাচ্যুত শ্রেণিতে পরিণত হয়, এবং এই শ্রেণিরও ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তি ঘটে। সর্বহারা শ্রেণি হচ্ছে একটা নতুন শক্তি যা বুর্জোয়া শ্রেণির চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি এবং যা বুর্জোয়া শ্রেণির শাসনে বুর্জোয়া শ্রেণিরই সাথে যুগপৎ বৃদ্ধি পেতে থাকে; সর্বহারা শ্রেণি প্রারম্ভে বুর্জোয়া শ্রেণির অধীন হলেও ক্রমান্বয়ে শক্তি অর্জন করে একটি স্বাধীন ও ইতিহাসে মুখ্য ভূমিকাযুক্ত শ্রেণিতে পরিণত হয় এবং শেষে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে শাসক শ্রেণিতে পরিণত হয়। তখন সমাজের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং পুরাতন ধনতান্ত্রিক সমাজ নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিমধ্যে এই পথ গ্রহণ করেছে, যে পথ অন্য সকল দেশ অবশ্যম্ভাবীরূপে গ্রহণ করবে।
চীনের কথাই ধরা যাক। যে দ্বন্দ্বের ফলে চীনা আধা-উপনিবেশ, সেই দ্বন্দ্বে সাম্রাজ্যবাদ প্রধান অবস্থান দখল করে আছে ও চীনা জনগণকে পীড়ন করে চলেছে, আর চীন স্বাধীন দেশ থেকে আধা-উপনিবেশে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু অবশ্যম্ভাবীরূপে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে, উভয় পক্ষের মধ্যে সংগ্রামে, চীনা জনগণের যে শক্তি সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অবশ্যম্ভাবীরূপে চীনকে আধা-উপনিবেশ থেকে একটা স্বাধীন দেশে পরিবর্তন করবে, পক্ষান্তরে সাম্রাজ্যবাদ উৎখাত হবে এবং পুরাতন চীন অবশ্যম্ভাবীরূপে নতুন চীনে রূপান্তরিত হবে।
পুরাতন চীনের নতুন চীনে রূপান্তরের সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের অভ্যন্তরে পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো এবং নতুন জনগণের শক্তিগুলোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন। পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক জমিদার শ্রেণি উৎখাত হবে, শাসক থেকে শাসিতে পরিণত হবে এবং এই শ্রেণি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হবে। সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে জনগণ শাসিত থেকে শাসকে পরিণত হবে। অবিলম্বে, চীনের সমাজের প্রকৃতি পরিবর্তিত হবে এবং পুরাতন আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরিত হবে।
এরকম পারস্পরিক রূপান্তরের দৃষ্টান্ত আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় খুঁজে পাওয়া যায়। চীনকে প্রায় তিন শ বছর শাসনকারী ছিং রাজবংশ ১৯১১ সালের বিপ্লবে উৎখাত হয়েছিল; এবং সান ইয়াৎসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী থোং-মেংহুই (মৈত্রী সমিতি) কিছু সময়ের জন্য বিজয়ী হয়েছিল। ১৯২৪-২৭ সালের বিপ্লবী যুদ্ধে, দক্ষিণে কমিউনিস্ট-কুওমিনতাঙ মৈত্রীর বিপ্লবী শক্তিগুলো দুর্বল থেকে শক্তিশালীতে পরিবর্তিত হয়েছিল এবং উত্তরাভিযানে বিজয় অর্জন করেছিল; আর একদা সর্বশক্তিমান উত্তরাঞ্চলীয় সমরনায়করা উৎখাত হয়েছিল। ১৯২৭ সালে কুওমিনতাঙ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর আক্রমণে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত জনগণের শক্তি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল; কিন্তু নিজেদের পার্টির মধ্যে সুবিধাবাদ নির্মূল করার সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী ঘাঁটি এলাকাগুলোতে কৃষকেরা শাসিত থেকে শাসকে রূপান্তরিত হয়েছে, আর জমিদারদের ঘটেছে ঠিক বিপরীত রূপান্তর। বিশ্বে সর্বদাই এরকম ঘটছে, নতুন হটিয়ে দিচ্ছে পুরাতনকে, নতুন কর্তৃক পুরাতনের স্থান দখল করা হচ্ছে, পুরাতনকে মুছে দিয়ে নতুনের পথ তৈরি হচ্ছে এবং নতুনের উদ্ভব ঘটছে পুরাতনের মধ্য থেকে।
বিপ্লবী সংগ্রামে কোনো কোনো সময়ে অনুকূল অবস্থার তুলনায় প্রতিকূল অবস্থাই বেশি জোরদার হয়ে ওঠে; এই সময়ে প্রতিকূল অবস্থা হচ্ছে দ্বন্দ্বের প্রধান দিক, অনুকূল অবস্থা হচ্ছে গৌণ দিক। কিন্তু বিপ্লবীদের প্রয়াসের মাধ্যমে প্রতিকূল অবস্থাকে ধাপে ধাপে অতিক্রম করা সম্ভব, নতুন অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করাও সম্ভব; এমনি করে প্রতিকূল অবস্থার স্থলে অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ১৯২৭ সালে চীন বিপ্লবের ব্যর্থতার পরে এবং চীনের লাল বাহিনীর লং মার্চের সময়ে এটাই ঘটেছিল। বর্তমান চীন-জাপান যুদ্ধে, চীন পুনরায় একটা প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু আমরা এটা পরিবর্তন করতে পারি এবং চীন ও জাপানের মধ্যকার অবস্থা মূলগতভাবে রূপান্তরিত করতে পারি। বিপরীতভাবে, অনুকূল অবস্থা প্রতিকূলে পরিবর্তিত হতে পারে যদি বিপ্লবীরা ভুল করে। এইভাবে ১৯২৪-২৭ সালের বিপ্লবের বিজয় পরাজয়ে পরিণত হয়। ১৯২৭ সালের পর দক্ষিণের প্রদেশগুলোতে যে বিপ্লবী ঘাঁটি এলাকাগুলো গড়ে উঠেছিল সবই ১৯৩৪ সালের মধ্যে পরাজয় বরণ করে।
আমরা যখন পর্যালোচনায় প্রবৃত্ত হই, অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে উত্তরণের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটে। মার্কসবাদ পর্যালোচনার একেবারে শুরুতে, মার্কসবাদ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা বা সামান্য পরিচয়ের সঙ্গে মার্কসবাদের জ্ঞানের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কিন্তু কঠোর অধ্যয়নের ফলে অজ্ঞতাকে জ্ঞানে, সামান্য পরিচয়কে প্রভূত জ্ঞানে এবং মার্কসবাদ প্রয়োগে অন্ধত্বকে প্রয়োগ-নিপুণতায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।
কেউ কেউ মনে করেন, কোনো কোনো দ্বন্দ্বের বেলায় এই নিয়ম খাটে না। যেমন, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্বে উৎপাদন শক্তি হচ্ছে প্রধান দিক; তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যকার দ্বন্দ্বে অনুশীলন হচ্ছে প্রধান দিক; অর্থনৈতিক ভিত্তি ও ওপরকাঠামোর মধ্যকার দ্বন্দ্বে অর্থনৈতিক ভিত্তি হচ্ছে প্রধান দিক; এবং তাদের পারস্পরিক অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় না। এটা যান্ত্রিক বস্তুবাদী ধারণা, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ধারণা নয়। সত্য বটে, উৎপাদনশক্তি, অনুশীলন ও অর্থনৈতিক ভিত্তি সাধারণত মুখ্য ও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে; যে এটা অস্বীকার করে সে বস্তুবাদী নয়। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে যে, নির্দিষ্ট অবস্থায় উৎপাদন সম্পর্ক, তত্ত্ব ও ওপরকাঠামোও পর্যায়ক্রমে মুখ্য ও নির্ণায়ক ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করে। যখন উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ছাড়া উৎপাদন শক্তির বিকাশ লাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন মুখ্য ও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। লেনিন যখন বলেছেন, “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না”[১৫] , তখন বিপ্লবী তত্ত্বের সৃষ্টি ও প্রচার মুখ্য ও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। যখন একটা কাজ (যা-ই হোক না কেন) করা দরকার হয়ে পড়ে, অথচ কোনো নির্দেশক পথ, পদ্ধতি, পরিকল্পনা বা কর্মনীতি থাকে না, তখন মুখ্য ও নির্ণায়ক বিষয় হচ্ছে একটা নির্দেশক পথ, পদ্ধতি, পরিকল্পনা বা কর্মনীতি স্থির করা। যখন ওপরকাঠামো (রাজনীতি ও সংস্কৃতি প্রভৃতি) অর্থনৈতিক ভিত্তির বিকাশে বাধা দেয়, তখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার সাধনই মুখ্য ও নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আমরা কি তা বলে বস্তুবাদের বিরোধিতা করছি? না। এর কারণ, আমরা স্বীকার করি যে, ইতিহাসের সাধারণ বিকাশে বস্তুগত জিনিস মানসিকতাকে নির্ধারণ করে, সামাজিক সত্তা সামাজিক চেতনাকে নির্ধারণ করে। এই কথা স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বস্তুগত জিনিসের উপর মানসিকতার প্রতিক্রিয়া, সামাজিক সত্তার উপর সামাজিক চেতনার প্রতিক্রিয়া, এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর ওপরকাঠামোর প্রতিক্রিয়াকেও স্বীকার করি—বস্তুত একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। এটা বস্তুবাদকে লংঘন করে না, পক্ষান্তরে যান্ত্রিক বস্তুবাদকে পরিহার করে এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরে।
দ্বন্দ্বের বিশিষ্টতা পর্যালোচনায়, যদি না আমরা এই দুই প্রকারের অবস্থাকে—একটা প্রক্রিয়ার প্রধান ও অপ্রধান দ্বন্দ্ব এবং একটা দ্বন্দ্বের প্রধান ও অপ্রধান দিককে—পরীক্ষা করি, অর্থাৎ যদি না আমরা এই দুই প্রকারের স্বতন্ত্র চরিত্রকে পরীক্ষা করি, তাহলে আমরা বিমূর্ততার মধ্যে ডুবে যাব, দ্বন্দ্বকে মূর্তভাবে বুঝতে পারব না এবং তার ফলে দ্বন্দ্বের সমাধানের সঠিক পদ্ধতি বের করতে পারব না। দ্বন্দ্বের এই দুই প্রকারের অবস্থার স্বতন্ত্র চরিত্র বা বিশিষ্টতা দ্বন্দ্বের মধ্যকার শক্তিগুলোর অসমতাই প্রকাশ করে। পৃথিবীতে কোনো কিছুই অনাপেক্ষিক রূপে সমভাবে বিকাশ লাভ করে না; আমাদের অবশ্যই সমবিকাশের তত্ত্ব বা ভারসাম্যের তত্ত্বের বিরোধিতা করতে হবে। উপরন্তু, দ্বন্দ্বের এই মূর্ত রূপগুলো এবং বিকাশের প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্বের প্রধান ও অপ্রধান দিকগুলোর পরিবর্তনই পুরাতনকে সরিয়ে যে নতুন আসছে তার শক্তিকে প্রকাশ করে। দ্বন্দ্বগুলোতে অসমতার বিভিন্ন অবস্থার, প্রধান ও অপ্রধান দ্বন্দ্বের এবং দ্বন্দ্বের প্রধান ও অপ্রধান দিকের পর্যালোচনা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যার সাহায্যে বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যাপারে তার রণনীতিগত ও রণকৌশলগত কর্মনীতিগুলো নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করতে পারে। সকল কমিউনিস্টকে এ-ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে।
মাও সেতুং বা মাও সে তুং বা মাও জেদং (ইংরেজি: Mao Tse-Tung; ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯৩ – ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ খ্রি.) মার্কসবাদী বিপ্লবী তাত্ত্বিক, সাম্যবাদী রাজনৈতিক নেতা, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। জাপানি দখলদার শক্তি এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার কুওমিনটাং নেতা চিয়াং কাইশেকের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লবের জন্য চীনের অগণিত এবং অনুন্নত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৌশলী হিসেবে মাও সেতুং এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণাদায়ক উপকথায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অনেক জটিল কথাকে জনগণের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। জনগণের সেবায় মানবেতিহাসের সমস্ত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।