জাপানি দর্শন এশীয় বৌদ্ধধর্ম ও কনফুসিয়ানবাদ এবং শিন্টোর সমন্বিত রূপ

জাপানি দর্শন (ইংরেজি: Japanese philosophy) ঐতিহাসিকভাবে এশীয় বৌদ্ধধর্ম ও কনফুসিয়ানবাদ এবং স্বদেশীয় শিন্টো এই উভয় ধর্মগুলির সমন্বিত রূপ। জাপানে দার্শনিক চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে সামন্ততান্ত্রিক যুগে। জাপানি দর্শনের প্রথম উৎস ছিল প্রাচীন চীনের প্রধান দার্শনিক ধারাসমূহ, বিশেষ করে কনফুসিয়, বৌদ্ধ এবং পরবর্তীকালের নব কনফুসিয়বাদের চিন্তাধারা।

জাপানে কনফুসিয় ভাববাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে দার্শনিক ফুজউয়ারা (১৫৬১-১৬১৯ খ্রি.) এবং হায়াশি রাজান (১৫৮৩-১৬৫৭ খ্রি.) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের মতবাদ ‘সুসিগাকুহা’ নামে প্রচারিত ছিল। এই মতবাদ অনুযায়ী অস্তিত্বের চরম হচ্ছে ‘তাইকেকু’ বা ‘মুকেকু’। এই চরম অস্তিত্বই বিশ্বের নিয়ন্তা। অস্তিত্বের চরম যেমন ‘তাইকেকু’ তেমনি ভাবের মূল হচ্চে ‘রী’ অথবা ‘লী’। বস্তুর মূল ‘কী’ অথবা ‘চী’র সঙ্গে ‘তাইকেকু’ এবং ‘লী’র সংযোগে সৃষ্ট হয়েছে বিচিত্র প্রকৃতি এবং মনুষ্য জগৎ।

ইউরোপীয় দর্শনের বেকন, হবস, কপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন প্রমুখ চিন্তাবিদের অভিমতের সঙ্গে পরিচয়ের ভিত্তিতে জাপানে সামন্তবাদী চিন্তাধারার প্রতিবাদী হিসাবে বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটতে থাকে। এই নবতর বিকাশে যে সমস্ত জাপানি দার্শনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে কাইবেরা একিকেন(১৬৩০-১৭১৪ খ্রি.), মুরো কুয়োসা(১৬৫৮-১৭৩৪ খ্রি.), ইতো জিনসাই(১৬২৭-১৭০৫ খ্রি.), ইয়ামা গাতা শুমান(১৬৮৭-১৭৫২ খ্রি.) এদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

জাপানি সামন্তবাদের পরিণাম কাল হিসাবে সপ্তদশ শতকের শেষার্ধ এবং অষ্টাদশ শতকের সূচনাকে চিহ্নিত করা চলে। এই পর্বের প্রধান বস্তুবাদী দার্শনিক ছিলেন আন্দোশাকি। তিনি নব কনফূসিয়বাদের ‘সীমাহীন ভাব’ এর তত্ত্বকে পরিত্যাগ করে ‘বিরামহীন সৃজন ক্রিয়ার’ নীতি সমর্থন করেন। বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে আন্দোশোকির ব্যাখ্যায় দ্বান্ধিক তত্ত্বের আভাস পাওয়া যায়। তাঁর মতে বিশ্বের মূল হচ্ছে পাঁচটি মৌলিক এবং সীমাহীন বস্তুগত শক্তি। এই মূল শক্তিগুলি স্বয়ংক্রিয়। আন্দোশোকি ছিলেন সামন্ততন্ত্রের আপোষহীন প্রতিবাদী এবং জ্ঞানবিকাশের উদগাতা। মানুষে মানুষে অসাম্যতাকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সামাজিক বৈষম্য এবং বিরোধের মূল বলে ঘোষণা করেছিলেন। জমির যৌথ চাষকে তিনি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রধান উপায় বলে বর্ণনা করতেন।

আরো পড়ুন:  ইতিহাসের দর্শন হচ্ছে মানুষের আর্থনীতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিকাশের অন্তর্নিহিত আলোচনা

জাপানে আধুনিক ধনতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে : ১৮৬৭-১৮৬৮ সালে। এ বিপ্লব অসম্পূর্ণ থাকলেও ঊনবিংশ শতকের জাপানি দর্শনের বিকাশের ক্ষেত্রে এর প্রভূত প্রভাব ছিল। এই সময়ে জাপানি দর্শনে দুটি প্রতিধারার উদ্ভব ঘটে। এর একটিকে কারনো গাকূশা বা আমলাতন্ত্রের দর্শন ও বিজ্ঞান এবং অপরটিকে মিনকান গাকুশা বা জনসাধারণের দর্শন ও বিজ্ঞান বলা হত। আমলাতান্ত্রিক দর্শন যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশকে সমাজের উচ্চশ্রেণীর স্বার্থবহ করে রাখার চেষ্টা করেছে, জনসাধারণের দর্শন সেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানকে বৃহত্তর জনসমাজের স্বার্থ সাধন করার প্রয়াস পেয়েছে। এই দ্বিতীয় ধারার একজন প্রখ্যাত বস্তুবাদী দার্শনিকের নাম হচ্ছে নাকায়ে (১৮৪৭-১৯০১ খ্রি.)। প্রগতিশীল জাপানী বিজ্ঞান ও সামাজিক চিন্তাধারার বিকাশে এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য। বিশ শতকের অন্যান্য বস্তুবাদী এবং দ্বান্ধিক দার্শনিকের মধ্যে রয়েছেন তোসাকাজেন (১৯০০-১৯৪৫), কোয়াকামী হাজিমে(১৮৭৯-১৯৪৬) এবং নাগাতা হিরোশি (১৯০৪-১৯৪৭)।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৪৪-২৪৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!