জন্মনিয়ন্ত্রণ

পিরগভ ডাক্তার সম্মেলনে (১৯১৩) গর্ভপাতের প্রশ্নের উপর, মানে কৃত্রিম উপায়ে ভ্রণহত্যার বিষয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখা গিয়েছিল এবং এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বক্তা লুচকুচ অনেক ঘটনার উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, সমসাময়িক তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলিতে কত ব্যাপকভাবে গর্ভপাত করানো চলেছে।

নিউ ইয়র্কে মাত্র এক বৎসরেই আশি হাজারটি গর্ভপাত করানো হয়েছে এবং ফরাসী দেশে প্রতি মাসে ছত্রিশ হাজারটি গর্ভপাত করানো হয়। পিটার্সবার্গে পাঁচ বৎসরে গর্ভপাতের শতকরা হার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হয়েছে।

পিরগভ ডাক্তার সম্মেলন এই মর্মে প্রস্তাব পাশ করেছে যে, গর্ভপাতের জন্য কোনো মায়ের বিরুদ্ধে কখনই ফৌজদারী মোকদ্দমা করা চলবে না, আর ডাক্তারদের বেলায় কেবলমাত্র তাদের ‘অর্থলোভী’ উদ্দেশ্য থাকলে তাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করা যাবে।

আলোচনার সময় অধিকাংশ বক্তাই গর্ভপাত করাকে বে-আইনী করার পক্ষে বলেছেন। স্বভাবতই তাঁরা নিও ম্যালথাসবাদ (জন্মনিয়ন্ত্রণ) এবং তার সামাজিক দিক নিয়েও আলোচনা করেছেন। রুশকায়া শ্লোভো পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায় যে, মিঃ ভিগডরাচিক বলেছেন যে, জন্মনিরোধের উপায়গুলিকে সানন্দে গ্রহণ করতে হবে। আর মিঃ এ্যাসটারখান যখন ঘোষণা করলেন: ‘সন্তানের জন্মদানের জন্য মায়েদের বোঝাবার মানে দাঁড়াবে এই যে, সন্তানরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাঁতাকলে পিষে যাবে  আর ভবিষ্যতে জীবনের পথ অন্বেষণে গিয়ে আত্মহত্যার দিকেই পরিচালিত হবে। তখন প্রভূত প্রশংসাসূচক ধ্বনি শোনা গিয়েছিল!

এই রিপোর্ট যদি সত্যি হয় যে, মিঃ এ্যাসটারখান তাঁর বক্তৃতার সময় প্রভূত প্রশংসা পেয়েছিলেন তাহলে আমি বিস্মিত হব না। শ্রোতারা ছিল মধ্য ও পেটি বুর্জোয়া, আর তাদের মনস্তত্ত্ব পেটিবুর্জোয়া সুলভ। তাদের কাছ থেকে বিরক্তিকর উদারনীতিবাদ ছাড়া আর কিই বা আশা করা যায় ?

শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে অবশ্য মিঃ এ্যাসটারখানের উক্ত বক্তব্যে করুণ ‘সামাজিক নিও ম্যালথাসবাদ’ যে কতদুর প্রতিক্রিয়াশীল তা এর চেয়ে স্পষ্ট করে প্রকাশ করা শক্ত।

যাঁতাকলে পিষে যাবার জন্যই সন্তানের জন্মদান…….. শুধু কি এই জন্যই সন্তান হয় ? আর এ জন্যই নয় কেন যে, তারা যাতে আমাদের চেয়ে আরও ভালভাবে, আরও ভাল কমরেডদের মতো সচেতনভাবে, আরও সুনির্দিষ্ট পন্থায়, আমাদের সময়কার কদর্য ও ধ্বংসকারী জীবনধারণের অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে ?

আরো পড়ুন:  সংস্কারবাদ শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণিসংগ্রাম, বিপ্লব ও ক্ষমতাকে অস্বীকার করে

এখানেই কৃষক, কারিগর, বুদ্ধিজীবী সংক্ষেপে, মধ্যবিত্ত ও সর্বহারার মনস্তত্ত্বের মধ্যে প্রভেদ। পেটিবুর্জোয়া দেখছে ও অনুভব করছে যে, সে মৃত্যুর পথে চলেছে, জীবন তাঁর কাছে আরও কঠিন হয়ে উঠছে, অস্তিত্বের লড়াই সবচেয়ে বেশি ক্রুর হয়ে উঠছে, এবং তার ও তার পরিবারের অবস্থা আরও সমাধানের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং পেটিবুর্জোয়া তার প্রতিবাদ করছে। কিন্তু সে কি ভাবে প্রতিবাদ করে?

সে এমনই একটি শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিবাদ করে যে, যে-শ্রেণী ক্ষয়িষ্ণু, যার পুনরুত্থানের পথ নেই, যে তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ একটি পরাজিত ও কাপুরুষ শ্রেণী। পেটিবুর্জোয়ার বক্তব্য হলো ‘আমাদের এত কষ্ট, এত দুঃখ এবং কঠিন পরিশ্রম, আমাদের দারিদ্র্য ও অবমাননা সন্তান যদি কিছু কম হতো’।

সচেতন শ্রমিকের চিন্তাধারা এর চেয়ে এত তফাত যে, তার পরিমাপ হয় না। যতই আন্তরিক ও খাঁটি হোক না কেন এই ধরনের হা-হুতাশ দ্বারা সে কখনই নিজের বিবেককে আচ্ছন্ন হতে দেবে না। আমরা শ্রমিকেরা এবং স্বল্পবিত্তদের বিরাট অংশ অসহ্য নির্যাতন ও দুঃখের মধ্যে জীবন কাটাই। আমাদের পূর্ব পুরুষদের সময়ের চেয়ে আমাদের সময়ে জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর। কিন্তু একদিক থেকে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের চেয়ে বেশি ভাগ্যবান। কেমন করে সংগ্রাম করতে হয় আমরা তা শিখেছি এবং আরও দ্রুত শিখছি।

আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরাও যেমন একা একা লড়াই করেছেন আর বুর্জোয়াদের প্রবঞ্চনামূলক ধ্বনি নিয়ে লড়াই করেছেন আমরা সেইভাবে লড়াই করি না। আমরা করি আমাদের নিজেদের ধ্বনি নিয়ে আমাদের নিজেদের শ্রেণী আওয়াজ নিয়ে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের থেকে অনেক ভাল লড়াই করি। আমাদের সন্তান-সন্ততিরা আরও ভাল লড়াই করবে এবং তাদের জয় হবে।

শ্রমিক শ্রেণী মরণোন্মুখ নয়। সে বাড়ছে, দৃঢ় হচ্ছে, পরিণত হচ্ছে, একতাবদ্ধ হচেছ, সে শিখছে এবং সংগ্রামে ধাতস্থ হচ্ছে। আমরা দাসপ্রথা সম্বন্ধে, পুঁজিবাদ সম্বন্ধে ও ক্ষুদ্র শিল্প সম্বন্ধে নিরাশাবাদী কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমরা প্রচন্ড রকমের আশাবাদী। আমরা ইতিমধ্যেই নতুন সৌধের ভিত্তি স্থাপনা করছি এবং আমাদের সন্তান-সন্ততিরা এর গঠনকার্য সম্পূর্ণ করবে।

আরো পড়ুন:  ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বলতে কি বুঝায়

সেই কারণেই— এবং একমাত্র সেই কারণেই— আমরা নিও ম্যালথাসবাদের আপসহীন শত্রু— যা কিনা পেটিবুর্জোয়া দম্পতির পক্ষে প্রযোজ্য। তারা নির্দয় ও আত্মশ্লাঘী—ভয়ে ভয়ে আওড়ায়—  ‘আমরা শুধু কোনোমতে কাটিয়ে যাই। আর আমাদের সন্তানদের কথা বরং আমাদের সন্তান না হওয়াই ভাল’। এর অর্থ হলো এই ধরনের আলোচনা দ্বারা কোনোমতেই একথা বোঝায় না যে যে সমস্ত আইনের দ্বারা ভ্রুণহত্যা করলে মানুষকে নিগৃহীত করা হয় বা জন্মনিরোধমূলক ডাক্তারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যে সব আইন আছে সেগুলি বিনা শর্তে প্রত্যাহার করবার দাবি জানাতে আমাদের কোনো বাধা আছে, ইত্যাদি এই ধরনের আইনগুলি সোজা কথায় শাসকশ্রেণীর শঠতা। এই আইনগুলির দ্বারা ধনতন্ত্রের দ্বারা ধনতন্ত্রের অনিষ্টগুলি দূরীভূত হয় না—সেগুলিকে শুধু নির্যাতিত জনগণের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর ও নিষ্ঠুর ব্যাধিতে পরিণত করে।

ডাক্তারী প্রচারকার্যের স্বাধীনতা এবং স্ত্রী ও পুরুষ নাগরিকদের প্রাথমিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করা এক জিনিস। নিও ম্যালথাসবাদের শিক্ষা হলো সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। সমসাময়িক সমাজের সবচেয়ে অগ্রগামী এবং শক্তিশালী শ্রেণী, যে শ্রেণী মহান সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত তাদের উপর এই প্রতিক্রিয়াশীল কাপুরুষোচিত মতবাদ চাপিয়ে দেবার চেষ্টার বিরুদ্ধে সচেতন শ্রমিকরা সর্বদাই ক্ষমাহীন সংগ্রাম করবে।[১]

লেনিন : দি ওয়ার্কিং ক্লাশ অ্যান্ড নিও ম্যালথাসিয়ানইজম প্রাভদা, ২৯শে জুন, ১৯১৩।

টিকা:

১. লেনিনের এই প্রবন্ধটি কনক মুখোপাধ্যায় (সেপ্টেম্বর ২০০৬) নারী মুক্তির প্রশ্নে, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১০৬-১০৮ থেকে নেওয়া হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!