নারীর ভোটাধিকারের উপর প্রস্তাবটিও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। শুধু আধা-বুর্জোয়া ফেবিয়ান সোসাইটির একজন ইংরাজ মহিলা নারীদের সকলের ভোটাধিকারের পরিবর্তে কেবলমাত্র সম্পত্তি সম্পন্ন নারীদের ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রামের পক্ষে বললেন। কিন্তু ঐ কংগ্রেস সে প্রস্তাব একেবারেই নাকচ করে দিল এবং ঘোষণা করল যে, নারী শ্রমিকদের এই ভোটাধিকারের জন্য প্রচার করতে হবে তবে নারীরা অধিকারের জন্য বুর্জোয়া সমর্থকদের সঙ্গে নয়, সর্বহারা শ্রেণির পার্টির সঙ্গে প্রচার করবে। এই কংগ্রেসে বলা হলো যে নারীর ভোটাধিকারের জন্য প্রচারের সময় সমাজতন্ত্রের নীতি ও নারী-পুরুষের সমান অধিকারের নীতিকে তুলে ধরতে হবে-কোনো সুবিধার জন্যই যেন সে নীতিকে বিকৃত করা না হয়।
এ বিষয়ে কমিশনের মধ্যে একটা বেশ মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। অষ্ট্রিয়ানরা (ভিক্টর অ্যাডলার এ্যাডলহেড পপ) পুরুষের সার্বজনীন ভোটাধিকারের জন্য তাদের সংগ্রামের নীতির পক্ষে বললেন। তাঁরা মনে করলেন যে শুধু পুরুষদের সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জন করার পক্ষে প্রচার করাই ভাল। তার সঙ্গে আবার নারীদের ভোটাধিকারের দাবিটা সামনে না নিয়ে এলেই সুবিধা হবে। জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা বিশেষ করে ক্লারা জেটকিন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন আর অষ্ট্রিয়ানরা তাদের মতের পক্ষে প্রচার চালাতে লাগল। জেটকিন সংবাদপত্রে ঘোষণা করে দিলেন যে নারীর ভোটাধিকারের দাবিকে কোনোমতেই অবহেলা করা যাবে না। তিনি বললেন যে অষ্ট্রিয়ানরা সুবিধাবাদের কাছে নীতিকে বিসর্জন দিয়েছে, তাদের প্রচারের গন্ডি সংকীর্ণ করে ফেলছে। তারা যদি নারীদের ভোটাধিকারের উপরও সমান জোর দিত তবে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হতো। কমিশনের মধ্যে আরও একজন সোস্যাল-ডেমোক্র্যাট জার্মান নারী জেটকিনকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছিলেন, তাঁর নাম জিয়েট। অলডারের সংশোধনী পরোক্ষভাবে অষ্ট্রিয়ানদের নীতিই সমর্থন করছিল। সংশোধনটি ১২ থেকে ৯ ভোটে হেরে যায় (এই সংশোধনীতে ভোটাধিকারের সংগ্রামে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের দাবির কথাটা না বলে, বলা হলো যে ভোটাধিকারের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, যাতে সমস্ত নাগরিকই তার সুযোগ পায়)। ঐ কমিশন ও কংগ্রেসের মতামত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে (ঐ কংগ্রেস অধিবেশনের সময়ই স্টাটগার্টে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়) উক্ত জিয়েটের বক্তৃতা থেকে সবচেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি বলেনঃ “নীতিগতভাবে আমরা যা ঠিক করি, তা আমাদের দাবি করতেই হবে। তবে যখন আমাদের শক্তি কম, তখন যতটা পাওয়া সম্ভব আমরা ততটাই মেনে নেই। সোস্যাল ডেমোক্র্যাসি সব সময়ই এই নীতি মেনে চলে। আমাদের দাবি যত নরম হবে, সরকারও তত কম দিতে চাইবে………”। অষ্ট্রিয়ান ও জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাট মহিলাদের এই বিতর্কের মধ্যে দিয়েই পাঠকরা বুঝতে পারবেন যে শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদীরা একটা সঙ্গত বিপ্লবী নীতি থেকে সামান্যতম বিচ্যুতিকেও কিছুতেই রেহাই দেয় না।
সেপ্টেম্বর ১৯০৭, সোস্যালিস্ট কংগ্রেস
টিকা:
১. লেনিনের এই প্রবন্ধটি কনক মুখোপাধ্যায় (সেপ্টেম্বর ২০০৬), নারী মুক্তির প্রশ্নে, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪ থেকে নেওয়া হয়েছে।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।