কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টি ছিলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক দল

কংগ্রেস সমাজবাদী দল বা কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টি (ইংরেজি: Congress Socialist Party বা CSP) ছিলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক দল। ১৯৩৪ সালে কংগ্রেস সদস্যদের দ্বারা এটি গঠিত হয়। যেসব কংগ্রেস সদস্য ব্রিটিশ দাস গণশত্রু মোহনদাস গান্ধীর রহস্যবাদ এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উপদলীয় মনোভাব অপছন্দ করতেন তারা সিএসপি গঠন করেছিলেন। সিএসপি সেই ধরনের বিকেন্দ্রীকৃত সমাজতন্ত্রের পক্ষ সমর্থন করেছিল, যেই সমাজতন্ত্র সমবায়, ট্রেড ইউনিয়ন, স্বাধীন কৃষক এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অর্থনৈতিক শক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করবে।

বিশ শতকের ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধে আইন অমান্য আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ায় কংগ্রেসের যুব কর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও হতাশা দেখা দেয়; তাঁরা সংগ্রামী পথে অগ্রসর হবার সংকল্প গ্রহণ করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাজতন্ত্রী গােষ্ঠী গড়ে উঠতে শুরু করে। পুনাতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে (১৯৩৩) একটি সমাজতন্ত্রী কর্মসূচি গৃহীত হয়। পাটনাতেও ইতিপূর্বে অনুরূপ এক সম্মেলন (১৯৩১) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময়ে নাসিক জেলে আইন অমান্য আন্দোলনে ধৃত কিছু যুবকর্মী একটি সমাজতন্ত্রী দল গঠনের এক খসড়া কর্মসূচি প্রস্তুত করেন (১৯৩৩)। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, অশােক মেহতা, অচ্যুৎ পট্টবর্ধন, ইউসুফ মেহেরালি, এম. আর. মাসানি, এন. জি, গােরে, এস, এম, যােশী, এম. এল, দাঁতওয়ালা প্রমুখ ব্যক্তি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জব্বলপুরে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ও আর. এস. রুইকরের কিছু সংখ্যক অনুগামীও একটি সমাজতন্ত্রী দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। মানবেন্দ্রনাথ তখন কারাগারে।

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে পাটনায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির এক অধিবেশনে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করে সংসদীয় কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতিপূর্বে ভগ্নপ্রায় স্বরাজ পার্টিকে পুনর্গঠিত করার প্রয়াস চলেছিল। সংগ্রাম বিমুখ এই প্রবণতাকে প্রতিরোধ করার জন্য উল্লিখিত অধিবেশনের পূর্বে পাটনায় সমাজতন্ত্রীরা আচার্য নরেন্দ্র দেবের সভাপতিত্বে এক সম্মেলনে মিলিত হন। সেখানে একটি নিখিল ভারত সমাজতন্ত্রী গােষ্ঠী গঠিত হয়। বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী গােষ্ঠীর সঙ্গে সংযােগ ও সমন্বয়ের জন্য একটি প্রস্তুতি সমিতি গঠিত হয়; তার সাধারণ সচিব হন জয়প্রকাশ। ওই বছরের অক্টোবর মাসের শেষদিকে বােম্বাইতে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে নিখিল ভারত কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয়।

আরো পড়ুন:  ভারত ছাড় আন্দোলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে স্বাধীনতার দাবিতে সৃষ্ট বামপন্থীদের আন্দোলন

বােম্বাই সম্মেলনেই পার্টির উদ্দেশ্য সংবলিত গঠনতন্ত্র এবং কর্মসূচি গৃহীত হয়। কংগ্রেসের ভিতরে থেকেই কার্যনিবাহ ছিল পার্টির বৈশিষ্ট্য। প্রথম সম্মেলনে গৃহীত মূল দুটি উদ্দেশ্য ছিল: ১. ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে অবস্থিত থেকে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং ২. দেশে একটি সমাজতন্ত্রী সমাজের প্রতিষ্ঠা। ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সাংবিধানিক বিষয়ে আপোসমূলক আলােচনা যথার্থ স্বাধীনতা অর্জনের পরিপন্থী বলে এই দল মনে করত। উল্লিখিত দ্বিতীয় লক্ষ্যের সমর্থনে ১৫ দফার এক কর্মসূচি গৃহীত হয়, যার মূলকথা ছিল উৎপাদনকারী জনগণের কাছে যাবতীয় ক্ষমতার হস্তান্তর, ভারী শিল্প-বাণিজ্যের রাষ্ট্রীয়করণ, যৌথ কৃষিব্যবস্থা ও সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদন ও বণ্টন, দেশীয় রাজ্য ও জমিদারি ব্যবস্থার অবসান, কাজের অধিকারকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দান, সর্বজনীন ভােটাধিকার, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ ইত্যাদি।

কংগ্রেসের ভিতরে থেকে তার আদর্শ ও কর্মসূচির রূপায়ণ ছাড়াও কংগ্রেসের বাইরে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনসমূহে যােগ দিয়ে সেগুলিকে শ্রেণিসংগ্রামের অনুকূলে শক্তিশালী করে তােলা ছিল দলের দ্বিমুখী কর্মধারা। দ্বিতীয় ধারার কর্মসূচির অন্যতম অঙ্গ ছিল যুব, নারী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তােলা।

পার্টি গঠনের গােড়ার দিকে মানবেন্দ্রনাথের অনুগামীদের অনেকেই সেটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে মানবেন্দ্রনাথ জেল থেকে মুক্তি পাবার পর তাঁরা দলত্যাগ করেন। অন্যদিকে ১৯৩৫ খ্রি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তার পূর্ব অনুসৃত উগ্র কর্মপন্থা বাতিল করে পপুলার ফ্রন্ট নীতি গ্রহণ করে। এযাবৎকাল ভারতীয় কমিউনিস্টরা সি এস পি দলের তীব্র সমালােচনা করতেন। অতঃপর ওই দলে প্রকাশ্যে যােগদানের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে সি এস পি থেকে কমিউনিস্টরা বহিষ্কৃত হন। অনান্য বাম নেতাদের মধ্যে জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র এই দলের সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত হননি। ১৯৩৫ খ্রি ভারত শাসন আইনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ ও মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে বিরােধিতাসূত্রে বামপন্থী জোটে বিভিন্ন দল ও নেতা সাময়িকভাবে যুক্ত হন।

আরো পড়ুন:  মোগল সাম্রাজ্যে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল ও রাজ্য বিস্তার

সি এস পি দলের আদর্শ ও কর্মসূচি যাই থেকে থাকুক না কেন, প্রতিষ্ঠানকাল থেকেই তার নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিচিত্র ও বহুমুখী মতাদর্শ দেখা যেত। কেউ ছিলেন ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র, কেউ বা কট্টর মার্কসবাদী, কেউ আবার নিখাদ গান্ধীবাদী কিংবা বৈদান্তিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। পার্টির মুখপত্র ‘কংগ্রেস সােসালিস্ট’ প্রথমে কলকাতা ও পরে বােম্বাই থেকে প্রকাশিত হত।

ত্রিপুরী কংগ্রেসের (১৯৩৯) প্রাক্কালে সি এস পি সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন করে, কিন্তু অধিবেশনে গােবিন্দ বল্লভ পন্থের প্রস্তাব উত্থাপনের সময়ে নিরপেক্ষ থাকে; এবং পরােক্ষে দক্ষিণপন্থীদের পক্ষ অবলম্বন করে। অনতিকাল পরে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত লেফট কলিডেশন কমিটি যখন কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু করে তখন সি এস পি কমিটি থেকে সরে আসে এবং বাম মাের্চা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় রামগড় কংগ্রেসের প্রাক্কালে সভাপতি পদের নির্বাচনে মানবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থী প্রার্থী মৌলানা আজাদকে সমর্থন করে। গান্ধীজির নেতৃত্বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে সংগ্রাম শুরু করাই ছিল সি এস পি দলের অভীষ্ট বস্তু। ভারত ছাড় আন্দোলনে দলের বিভিন্ন নেতা নেতৃত্বদান করেন। আন্দোলন নিষ্ফল হয়ে যাওয়ার পরে জয়প্রকাশ, নরেন্দ্র দেব প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পূর্ব পরিকল্পিত সুষ্ঠু কর্মসূচি না থাকাকেই ব্যর্থতার কারণ বলে অভিমত প্রকাশ করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে জেল থেকে মুক্তির পর দলের কোনও কোনও নেতা নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে গণপরিষদে যােগদানের প্রস্তাবের বিরােধিতা করে নতুন রূপে আবার ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তাব করেন। পার্টির কানপুর কনভেনশনে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৪৭) মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবসহ কংগ্রেসের অনুসৃত নীতিকে নিন্দা করা হয় এবং দলের নাম থেকে কংগ্রেস শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৪৮ খ্রি ফেব্রুয়ারি মাসে এ আই সি সি অধিবেশনে স্থির হয় যে স্বতন্ত্র মতাদর্শ ও গঠনতন্ত্র সংবলিত কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য অতঃপর কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে থাকতে পারবেন না। ওই বছরেই নাসিক সম্মেলনে পার্টির সদস্যদের বড় একটি অংশ গণপরিষদ এবং স্বাধীনতার মূলস্রোতে নিজেদের বিচ্ছিন্নতা উপলব্ধি করেন, ফলে সমগ্র দলের কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

আরো পড়ুন:  জাসদ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী গণবিরোধী দলের নাম

দ্রষ্টব্য: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৪-৬৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!