শিবদাস ঘোষ (১৯২৩—৫ আগস্ট, ১৯৭৬) বিশ শতকের বাংলার বামপন্থী সংশোধনবাদী ধারার রাজনৈতিক নেতা এবং সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সহজ ব্যাখ্যা টিকা ভাষ্য বিশ্লেষণ প্রদানের কারণে তিনি তার সংগঠন ও কর্মীদের বাইরেও বেশ কিছু মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর পরিচিতি অর্জনকে একটু বিশ্লেষণ করলেই কিন্তু তার সীমাবদ্ধতাও যথেষ্ট চোখে পড়ে। তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই মতবাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকৃতি সাধন করেছেন যা সংশোধনবাদ হিসেবে বিবেচিত। এই প্রবন্ধে আমরা তার সংশোধনবাদী ব্যাখ্যার কতিপয় সূত্র প্রদানের চেষ্টা করব।
শিবদাস ঘোষ দ্বন্দ্বতত্ত্বের এংগেলসীয় ব্যাখ্যা পর্যন্ত বুঝতেন। স্তালিনের দেয়া দ্বন্দ্বের চারটি নিয়ম ও তার ব্যাখ্যার কারণ সম্পর্কে মতামত প্রদান করেননি। মাও সেতুং কেবল একটি নিয়মই বলতেন—সেটার কথা শিবদাস ঘোষ ‘চিনের কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেস’-এর আলোচনায় আনলেও সেটিকে ‘basic law of dialectics’ হিসেবে মানতেন না।[১] কিন্তু বাস্তবতা কী আলাদা নয়? একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
মাও সেতুং সারা জীবন একটা নিয়ম বলতেন, সেটি হলো ‘বিপরীতের একত্ব ও সংগ্রাম’। মাও সেতুং অন্যান্য নিয়মগুলো মানতেন না, তবে তিনি মনে করতেন যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিয়মগুলো দ্বারা কোনো কোনো ঘটনাকে মাঝে মধ্যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। মাও সেতুং ১৯৬৫ সনে হ্যাংচৌ-এ ভাষণে বলেন যে, “আমার মতে একটি মাত্র মূল নিয়ম আছে এবং তা হচ্ছে দ্বন্দ্বের নিয়ম। গুণ ও পরিমাণ, ইতিবাচক ও নেতিবাচক, বাহ্যিক চেহারা ও সারমর্ম, সারবস্তু ও রূপ, প্রয়োজনীয়তা ও স্বাধীনতা, সম্ভাবনা ও বাস্তবতা….. সবই হচ্ছে বিপরীতের একত্বের দৃষ্টান্ত।”[২] লেনিন যখন বলেন ‘প্রকৃত অর্থে দ্বন্দ্ববাদ হচ্ছে বস্তুর একেবারে সারাংশে দ্বন্দ্বের পর্যালোচনা’ তখন সেক্ষেত্রে দ্বন্দ্বটিই যে প্রধান সে কথাটিই ফুটে উঠে।[৩]
বাংলাদেশ ভারতে বেশ কিছু বামপন্থি সংগঠন নিজেদের মনোলিথিক পার্টি বা মনোলিথিক সিস্টেমের অনুসারি দাবি করে থাকে। এই বিষয়টি নিয়ে একটু দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন ছিল। কেননা উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি নিজেদেরকে মনোলিথিক সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত হিসেবে ঘোষণা করে। আমরা শুধু এটুকুই বলে আপাতত ক্ষান্ত দেই যে, এক প্রস্তরীভূত বা Monolithic বলে কিছু থাকতে পারে না; তাই Monolithic পার্টি বলেও কিছু হতে পারে না। কোনো বস্তু বিকশিত হয় তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। যদি দ্বন্দ্ববিহীন এক প্রস্তরীভূত কিছু হয়, তবে তো বস্তুর বিকাশ বন্ধ হয়ে যাবার কথা!![৪] স্তালিন মাও সেতুং পার্টির ধারণাকে বিকশিত করে পার্টির ভেতরে ‘দুই লাইনের সংগ্রাম’ পর্যন্ত উন্নত করেছেন। যারা পার্টিকে মনোলিথিক বা এক প্রস্তরীভূত বলে মনে করেন তারাও পার্টির অভ্যন্তরে মতাদর্শিক সংগ্রাম পর্যন্ত মানেন, এবং স্তালিন ও মাও সেতুংকে অভিযুক্ত করেন লেনিনবাদকে বিকৃত করার জন্য। যারা পার্টিকে মনোলিথিক বলেন তারা সেটিকে লেনিনিয় মডেল বলেন। কিন্তু সমস্যা হলো লেনিন কোন পরিপ্রেক্ষিতে পার্টিকে মনোলিথিক বলেছেন এবং সেটি লেনিন রচনাবলীর কোথায় রয়েছে তা কিন্তু তারা কখনোই দেখাতে পারেনি। এভাবে শিবদাস ঘোষ নিজেকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করেছেন।
বস্তুর দ্বন্দ্ব ও বিকাশ সংক্রান্ত ভুল বিশ্লেষণ দিয়েই শিবদাস ঘোষ ক্ষান্ত হন নি, তিনি একটি বস্তুকে নির্ভেজাল ও সঠিক হিসেবেও ঘোষণা দিয়ে লেনিনবাদ বিরোধী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। শিবদাস ঘোষের একটি পুস্তিকার নাম কেন এসইউসিআই ভারতের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদি দল দেখায় এসইউসিআই সংগঠনটিই সহি “পার্টি”[৫] যা বস্তুবাদবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। লেনিন উল্লেখ করেছেন যে, “বিশুদ্ধ প্রপঞ্চ বলতে কিছুই নেই, এবং থাকতেও পারে না, না প্রকৃতিতে না সমাজে — মার্কসবাদী ডায়ালেকটিকস আমাদেরকে এটাই শেখায়।”[৬]
সমাজবাস্তবতা বিবেচনা করে কমিউনিস্ট আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল ঠিক করা শিবদাস ঘোষের দ্বারা সম্ভব হয়নি। ভারতকে কীভাবে তারা পরিচালনা করবেন তার কোনো রূপরেখা ও কর্মসূচি পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রলাতারিয় বিপ্লবী কর্মসূচি প্রণয়ন ও জনগণের মাঝে প্রচার করা তার সংগঠনের দ্বারা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে শিবদাস ঘোষ পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেন। লেনিনবাদী বলশেভিক ধরনের পার্টি গঠন, পার্টি লাইন এবং গণলাইন সম্পর্কে তিনি কোনো দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেননি। যদিও তিনি ‘চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ পুস্তিকায় মাও সেতুং-এর সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতিটি দিয়েছেন, “একটি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে উৎখাত করতে হলে সর্বপ্রথমে দরকার হচ্ছে জনমত সৃষ্টি করা, মতাদর্শগত ক্ষেত্রে কাজ করা। এটা বিপ্লবী শ্রেণি ও প্রতিবিপ্লবী শ্রেণি উভয়ের জন্যই সত্য।”[৭] এই উদ্ধৃতি দিলেও সেই অনুযায়ী কাজ না করে বুলিগাবীশ এক গপ মারা বাকোয়াজ ব্যক্তিতে নিজেকে রূপান্তরিত করেছেন।
“আন্দোলনটাই সব, চূড়ান্ত লক্ষ্য কিছুই নয়” — বের্নস্তাইনের এই উক্তিটিকে লেনিন সংশোধনবাদের এক চমতকার সংজ্ঞারূপে উল্লেখ করেছিলেন।[৮] শিবদাস ঘোষের ভেতরেও আন্দোলনমুখি প্রবণতার আধিক্য দেখা যায়। তার প্রবন্ধগুলিতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘আন্দোলন, গণআন্দোলন, বাম-আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, আন্দোলন-সংগ্রাম’ প্রভৃতি। অন্যদিকে এসব শব্দের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তিনি মার্কসবাদের মৌলিক সত্য যথা ‘সমাজতন্ত্র, শ্রেণিসংগ্রাম, দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, সর্বহারার একনায়কত্ব, উদ্বৃত্ত-মূল্য তত্ত্ব, সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ’ ইত্যাদির উপরে গুরুত্বারোপ করেননি। ফলে তাঁর এই আন্দোলনগুলো এক অর্থনীতিবাদি-সংস্কারবাদি আন্দোলনে রূপ নেয়। মার্কসবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল, প্রলেতারিয় বিপ্লব এবং সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্ব কায়েম করা। এক্ষেত্রে শিবদাস ঘোষের সারা জীবনের কর্মকাণ্ডকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তিনি শ্রেণিসংগ্রামকে আঁকড়ে ধরে সর্বহারার একনায়কত্ব পর্যন্ত লড়াই চালাতে পারেননি। তার সমস্ত আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের গাড্ডায় পতিত হয়েছে। আর কে না জানে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনকেই যদি কমিউনিস্টরা মূল লক্ষ্য করে আর শ্রেণীসংগ্রামের বিষয় এড়িয়ে চলে তবে তা সংশোধনবাদ হতে বাধ্য। শিবদাস ঘোষের চার খণ্ডের রচনাবলী খুঁজেও সংশোধনবাদের সংজ্ঞা পাওয়া যায়নি। যদিও তিনি ‘সংশোধনবাদের মূল কারণ’ হিসেবে ‘আদর্শগত অবনমন, পশ্চাৎপদতা, চেতনার নিম্নমান’কে[৯] দায়ী করেছেন। অন্যত্র দায়ী করছেন ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভুল পরিকল্পনা’কে[১০] যা আসলে ভ্রান্ত কথা। সমাজের পুঁজিবাদি অর্থনীতি থেকে জাত অ-সর্বহারা চিন্তা এবং সাম্রাজ্যবাদের চাপ ও প্ররোচনা থেকেই পার্টিতে সংশোধনবাদ প্রবেশ করে।[১১]
শিবদাস ঘোষ সংশোধনবাদকে ঝেটিয়ে বিদায় করার রাস্তা বাতলে দিয়েছেন সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধন করার মাধ্যমে; যেন সংস্কৃতি এক অর্থনীতি-নিরপেক্ষ কোনো বিমূর্ত ব্যাপার। তিনি সংস্কৃতির উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতির চেয়েও বেশি। ভাবখানা এমন যেন অর্থনীতি ভিত্তি নয়, সংস্কৃতিই সমাজের ভিত্তি। তাছাড়া বাসদের সমস্ত লোকের কাছেই শিবদাসের একটি বাণী মুখস্ত থাকে; বাণীখানা হলো, ‘সকল বড় আদর্শের মর্মবস্তু তার উঁচু সাংস্কৃতিক মানের মধ্যেই নিহিত’। এই কথাটি বারবার প্রচার করে বাসদের নেতারা মূলত সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে শ্রেণিসংগ্রামের উর্ধ্বে তুলে ধরতে চেয়েছেন। অথচ লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এর বিপরীত। যেমন এ সম্বন্ধে লেনিনের একটি উদ্ধৃতিতে দেখি, “সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য যদি সংস্কৃতির একটা নির্দিষ্ট মাত্রা দরকার হয়, তাহলে সেই নির্দিষ্ট মাত্রাটির পূর্বশর্তটি প্রথমে বিপ্লবি উপায়ে অর্জন দিয়ে শুরু করা দরকার…..।”[১২] এরপরে লেনিন নেপোলিয়নের সেই কথার উদ্ধৃতিটি দিয়েছেন যেখানে নেপোলিয়ন বলেছিলেন ‘প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইটায় নামা দরকার, তারপর দেখা যাবে’ এবং লেনিন নিজেও লিখেছেন, “আমরাও প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইটায় নেমেছিলাম ১৯১৭ সালের অক্টোবরে….”।১৩] এইখানে লেনিন বিপ্লবী উপায়, গুরুত্বপূর্ণ লড়াই বলতে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব ও ক্ষমতা দখলকেই এবং রাশিয়ার ক্ষেত্রে জমিদার বিতাড়ন ও রুশ পুঁজিপতিদের বিতাড়নকেই[১৪] বোঝাচ্ছেন।
দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অংশবিশেষ হচ্ছে বিজ্ঞান। দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের হাজার হাজার সত্যকে প্রকাশ করেছে। প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানকে দর্শন বা Philosophy-এর মাধ্যমে সংশ্লেষিত করেছে। এইভাবেই মার্কসবাদী দর্শনের কেন্দ্রিয় বিষয় হয়েছে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ফলে যখন শিবদাস ঘোষ বলেন ‘মার্কসবাদই একমাত্র দর্শন যে বিজ্ঞানের মর্যাদা দাবি করতে পারে’[১৫] অথবা ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদও একটা বিজ্ঞান’[১৬] তখন কথাটি ভুলভাবে উপস্থিত হয়। কথাটি শুনে মনে হয় যেন মার্কসবাদের, দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের একটি সনদপত্র প্রয়োজন যে তারাও একেকটা বিজ্ঞান। যেমনভাবে বিভিন্ন ভাববাদী লোকজন তাদের গ্রন্থগুলোকেও বিজ্ঞান বলে চালাতে চায়।
সাম্যবাদ প্রলেতারিয়েতের মুক্তির পদ্ধতি সংক্রান্ত মতবাদ।[১৭] প্রলেতারিয়েত নিজেকে মুক্ত না করে মানবজাতিকে মুক্ত করতে পারে না। অর্থাৎ মানুষের মুক্তি প্রলেতারিয়েতের মুক্তির অধীন। অথচ শিবদাস ঘোষ বলেছেন যে, মার্কসবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ‘প্রচলিত অর্থে শ্রমিকশ্রেণির দর্শন বলতে আমার আপত্তি আছে’। ‘আর একথাও তো সত্য যে, ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি ও মানবমুক্তির অর্থ আজ এক এবং অভিন্ন হয়ে গেছে, মার্কসবাদ সেই কারণেই মানবমুক্তিরও দর্শন’।[১৮] এই ধরনের কথা বলে শিবদাস ঘোষ, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনকে বুর্জোয়া মানবতাবাদের পাঁকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। মানবপ্রকৃতি আর শ্রেণিবিভক্ত সমাজের মানবপ্রকৃতি যে আলাদা বস্তু তা শিবদাস বাবুর নজরে ধরা পড়েনি। অথচ এক্ষেত্রে মাও সেতুং বলেছেন, “শ্রেণি সমাজে, প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির সদস্য হিসেবে বাস করে, তাই ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রত্যেক প্রকারের চিন্তাধারার উপর শ্রেণির ছাপ থাকে।”[১৯] মাও সেতুং আরো বলেছেন, “শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণি-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানব-প্রকৃতি রয়েছে, শ্রেণি-ঊর্ধ্ব কোনো মানব-প্রকৃতি নেই। আমরা সর্বহারাশ্রেণির ও ব্যাপক জনসাধারণের মানব প্রকৃতির-ধারক।”[২০] ফলে শিবদাস ঘোষ যখন মানবমুক্তির দর্শন বলেন তখন শ্রেণি-ঊর্ধ্ব বিমূর্ত-মানব মুক্তির কথাই বলেন যা সুস্পষ্টরূপেই বিশ্লেষণবিহীন ভাববাদী কথা।
এছাড়াও শিবদাস ঘোষের তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মূল্যায়ন, জাতিয়তাবাদ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতা, সমাজতন্ত্র ও উত্তরণকালিন পর্যায়, মার্কসবাদের তিনটি উৎস ও তিনটি অঙ্গ, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু কথা থেকেই গেল যেগুলো কোনো এক সময় বিশ্লেষণ করা যাবে।
শিবদাস ঘোষের যে কিছু সদর্থক দিকও রয়েছে তা হচ্ছে তার সংগঠনটি মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও পুস্তিকা প্রকাশ করে, জনগণের ভেতরে মার্কসবাদ ও গণতন্ত্রের, দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের কিছু শব্দকে পরিচিত করেছে, ছোটখাট গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, জনগণের সমস্যায় ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে মাঝে মধ্যে নেতৃত্বও দিয়েছে। ঐক্য প্রসঙ্গে শিবদাস ঘোষ খেয়াল করেছেন যে ঐক্যে প্রাধান্যকারী শক্তিকে দেখতে হবে, দ্বন্দ্বের প্রধান দিক খেয়াল করতে হবে। যেমন তিনি লিখেছিলেন, “দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদিরা ঐক্যের প্রশ্নটিকে যেভাবে বোঝে, তা হচ্ছে, সমস্ত ঐক্যের মধ্যে একটা প্রাধান্যকারি বা নেতৃত্বকারি (dominant) ভূমিকা থাকে। ….. এটি একটি বাস্তব ও মৌলিক প্রশ্ন।”[২১] এই বাক্যটি মূলত একটি বাস্তবতাকে তুলে ধরছে। যে কোনো ঐক্যে প্রধান নেতৃত্বকারি শক্তিটি নির্ধারণ করে আন্দোলন ব্যর্থ হবে নাকি সফল হবে। প্রাধান্যকারি দলটি সংশোধনবাদি বা সুবিধাবাদি হলে আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এখানে যে উদ্ধৃতিটা দেয়া হয়েছে সেটা নানান ধরণের বামপন্থি পার্টিগুলোর ঐক্যের ব্যাপারে বলা। বাংলাদেশ ও ভারতে নানা সময়ে বামপন্থি দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য হয়েছে তাতে প্রাধান্যকারী ভূমিকায় কোন দলটি থাকবে সেটি নির্ধারণে উপরোক্ত কথাটি মনে রাখলে ঐক্য প্রক্রিয়াটি বুঝতে সুবিধা হয়। উপরের মন্তব্যটি এই কারণে বলা হয়েছে যে যদি নেতৃত্বকারী বা প্রাধান্যকারী দলটি সংশোধনবাদি হয় তবে ঐক্যটি শেষ পর্যন্ত সংশোধনবাদে গিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এককথায় তিনি মূলত একজন মার্কসবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারি এবং সহজ কথায় বলতে গেলে একজন মার্কসবাদের টীকা ভাষ্যকার। তিনি স্তালিন পরবর্তিকালিন মার্কসবাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসমূহ বুঝতে গিয়ে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন।
তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
১. দেখুন, শিবদাস ঘোষ; নির্বাচিত রচনাবলী; প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩৬৩।
২. মাও সেতুং, ১৯৬৫, হ্যাংচৌ সম্মেলনে ভাষণ, সভাপতি মাও সেতুঙের উদ্ধৃতি ও শেষ জীবনের উদ্ধৃতি, ঐশী পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৬৬। এই বিষয়ে বিস্তারিত পড়ুন অনুপ সাদির প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ২৬-৩২,
৩. লেনিনের ইংরেজি বাক্যটি এইরকম; ‘Dialectics in the proper sense is the study of contradiction in the very essence of objects’ ___Lenin, V I, Conspectus of Hegel’s Book: ‘Lectures on the History of Philosophy’, coll. wks., vol.38, pp. 253-254.
৪. মনোলিথিক পার্টি সংক্রান্ত আলোচনার জন্য পড়ুন, অনুপ সাদি, “কমিউনিস্টদের পার্টি বিষয়ক ধারণায় দুই লাইনের সংগ্রাম নাকি মনোলিথিক পার্টি?”
৫. শিবদাস ঘোষের একটি পুস্তিকার নাম কেন এসইউসিআই ভারতের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদি দল।
৬. V I Lenin [ Article : The Collapse of Second IInternational, Chapter : 6, Collected Works Published from Progress Publishers, Vol 21, Page 236.
৭. মাও সেতুং; ৮ম কেন্দ্রিয় কমিটির ১০ম প্লেনারি অধিবেশনে, নবম পার্টি কংগ্রেসের দলিলে উদ্ধৃত (১৯৬২)
৮. ভি আই লেনিন, মার্কসবাদ ও শোধনবাদ, মার্চ ১৯০৮, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১ পৃষ্ঠা ৯৩।
৯. শিবদাস ঘোষ; নির্বাচিত রচনাবলী; প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা ২৭৫।
১০. শিবদাস ঘোষ; নির্বাচিত রচনাবলী; প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩২৬।
১১. সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর প্রতিনিধিদের বৈঠকের ঘোষণা, নভেম্বর ১৯৫৭, মস্কো; দেখুন, লেনিনবাদ দীর্ঘজীবী হোক, ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স, ঢাকা, এপ্রিল ১৯৯২, পৃষ্ঠা ১২-১৩।
১২. ভি. আই. লেনিন; আমাদের বিপ্লবের কথা, (ন. সুখানভের নোট প্রসঙ্গে), ১৬-১৭ জানুয়ারি, ১৯২৩; মোটা হরফ আমার।
১৩. ভি. আই. লেনিন; পূর্বোক্ত।
১৪. ভি. আই. লেনিন; পূর্বোক্ত।
১৫. শিবদাস ঘোষ; নির্বাচিত রচনাবলী; চতুর্থ খণ্ড; পৃষ্ঠা ৮৯।
১৬. শিবদাস ঘোষ; নির্বাচিত রচনাবলী; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩২।
১৭ ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিজমের নীতিমালা, অক্টোবর নভেম্বর, ১৮৪৭, ১ নং প্রশ্নের উত্তর।
১৮. শিবদাস ঘোষ; নির্বাচিত রচনাবলী; চতুর্থ খণ্ড; পৃষ্ঠা ৯৩।
১৯. মাও সেতুং; অনুশীলন সম্পর্কে (জুলাই ১৯৩৭)
২০. মাও সেতুং; সাহিত্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে ইয়েনানের আলোচনা সভায় প্রদত্ত ভাষণ।
২১. শিবদাস ঘোষ; রাশিয়ায় সংশোধনবাদের বিকাশ ও পুঁজিবাদের বিপদ প্রসঙ্গে; শিবদাস ঘোষ রচনাবলী; প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা, ৩২৯।
রচনাকাল এপ্রিল ২, ২০১৩
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।