গণতন্ত্র শুধু একটি শব্দ বা ধারণা বা পুস্তকের বুলি নয়, এই শব্দটি শুধু কল্পনায় বা ভাবনায় থাকার ব্যাপারও নয়, গণতন্ত্রকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হয়। বহু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গণতন্ত্রের চর্চা গণতন্ত্রকে বাস্তব ভিত্তি দেয় এবং গণতন্ত্র মানুষের জীবনে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। মানুষ রাষ্ট্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকভাবে যেসব আদর্শকে চর্চা করে সাফল্য পায় সেই আদর্শই সঠিকরূপে প্রমাণিত হয় এবং এ চর্চা বা অনুশীলন ক্রমাগত চালালে আদর্শটি বিকশিত হয়।
গণতন্ত্র একটি বিকাশশীল আদর্শ এবং গণতন্ত্রকে বাঙালির জীবনে বিকশিত করতে হলে গণতন্ত্রের আরও অধিক গণভিত্তি প্রয়োজন। অন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ও সেখানকার মানুষের অভিজ্ঞতাকে আমরা যেমন গ্রহণ করব তেমনি আমরা আমাদের প্রগতিশীল ঐতিহ্যের সাথে আমাদের গণতন্ত্রকে নবায়ন করে নেব। এ দেশের অনেক মানুষ গণতন্ত্র বলতে কেবল ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার গঠনকে বিবেচনা করে থাকেন। কিন্তু গণতন্ত্র কেবল ভোটাভুটি নয়, গণতন্ত্রে আছে আরো অনেক কিছু। এ প্রসঙ্গে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন,
গণতন্ত্রের জন্য ভোটাভুটি লাগবে অবশ্যই, কিন্তু তার সঙ্গে কর্মসূচি ও কর্মনীতিও অপরিহার্য। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক উন্নতির কর্মসূচি। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন কর্মসূচি। বাস্তবায়নের জন্য কর্মসূচি। কর্মসূচি ও পরিকল্পনা ছাড়া গণতন্ত্র সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের আদর্শকে এমনভাবে রূপ দিতে হবে, বিকশিত করতে হবে, সহজবোধ্যরূপে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে যাতে গণতন্ত্রকে লোকে একইসঙ্গে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের আদর্শরূপে গ্রহণ করতে পারে। গণতন্ত্রের প্রতি আধো আধো আনুগত্য আর ব্যক্তিতান্ত্রিক দুর্নীতিপ্রবণ মন নিয়ে কস্মিনকালেও গণতন্ত্র হবে না।[১]
বাঙালির জীবনে গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মসূচি দরকার। কর্মসূচি বলতে বুঝতে হবে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও আদর্শ, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও সমাজের উন্নতি ঘটাবে, জনগণের জীবনমানের উন্নতি করবে, তাদের সামগ্রিক পরিবেশ ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে রাষ্ট্র ও জনগণকে এগিয়ে নেবে, কৃষি শিল্পের উন্নতি ঘটাবে, জনগণের উন্নত ন্যায়-নীতিবোধ গড়ে তুলবে। অর্থাৎ কর্মসূচি বলতে জনগণ, রাষ্ট্র, সমাজ, পার্টি, কর্মী, পরিবেশ ইত্যাদিকে নিয়ে সামগ্রিক কর্মসূচিকে বুঝতে হবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব কর্মসূচির মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে মতবাদিক ও কর্মসূচিগত আদর্শভিত্তিক বিতর্ক করবে এবং বিতর্কের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে। জনগণ যে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে সঠিক মনে করবে এবং যে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে সাড়া দেবে সেই দলের পতাকাতলে সমবেত হবে এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে সেই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করবে। এভাবেই রাজনৈতিক দলগুলো অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের কর্মসূচির যথার্থতা যাচাই করবে এবং সময়ের পরিবর্তনে কর্মসূচির নবায়ন করবে, কর্মসূচির পরিবর্তন করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কোনো কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপন করে না, ভোটের পূর্বে যে ইশতেহার প্রকাশ করে তা মূলত জনগণকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে সাময়িকভাবে ভোট লাভের জন্য; এ রকম প্রতারণামূলক স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি নয়; রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হবে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় ধরনের সমন্বিত দায়িত্বশীল, বাস্তববাদী, বাস্তবায়নযোগ্য এবং জনগণের শক্তিতে আস্থাশীল কর্মসূচি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে দরকার বৈপ্লবিক কর্মসূচি। এই কর্মসূচি হতে পারে নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি যার রূপ রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবেন। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি যে, এই নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে দেশে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত ও জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির যৌথ গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা। শ্রমিক, কৃষক মধ্যবিত্তসহ জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করা। সর্বহারা ও শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে তা হবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিশ্ব বিপ্লবের অংশ যার দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা দুনিয়ায় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের বিপ্লবী ক্ষমতার অধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ। দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচির সাথে স্বল্পমেয়াদী অনেকগুলো কর্মসূচি লাগবে যা রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবে।
গণতান্ত্রিক দলের কর্মসূচি হবে শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাকে, রক্ষণশীলতাকে পরাজিত করে, জনগণকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক স্বাধীন মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মহান উদ্দেশ্যে পরিচালিত।[২]
তথ্যসূত্র:
১. আবুল কাসেম ফজলুল হক, রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ, কথাপ্রকাশ ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৬৩।
২. নিবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] সম্পাদিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থের বাঙালির অগণতান্ত্রিকতা প্রবন্ধের অংশবিশেষ। এখানে কিছুটা সম্পাদনা ও সংযোজন করা হয়েছে। বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা বইটি বাংলাদেশে রকমারি ডট কম থেকে কিনুন এই লিংকে গিয়ে।
রচনাকাল জুন-জুলাই ২০১০, ২১ অক্টোবর, ২০১৭
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।