বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে আমাদের প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের আদর্শকে সফলভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেকোনো ধরনের মত, পথ ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারে। যেকোনো গোষ্ঠী বা দল প্রচলিত বিধির আওতায় নির্ধারিত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে যে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ২০০৮ অনুযায়ী সকল রাজনৈতিক দলকে বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে অথবা যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে জোট গঠন করতে পারে। তবে বাংলাদেশের সকল শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে করে যে, বর্তমানে বিরাজমান এত অধিকসংখ্যক রাজনৈতিক দল কোন দেশের জন্য ভালো রাজনীতির লক্ষণ হতে পারে না।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সমস্যাবলী মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে এ দলগুলো বিভিন্ন রকম। যেমন− রক্ষণশীল, উদারনৈতিক, প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি। এদেশে অনেক রাজনৈতিক দল আছে যারা কোনো পরিবর্তন চায় না। ধনিক শ্রেণির নিয়ে সেসব দলগুলো গঠিত। তারা পুরোমাত্রায় রক্ষণশীল। এই দলগুলোর সমর্থকগণ রক্ষণশীল। আবার কতগুলো দল আছে যারা বর্তমান সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়তে চায়। এই দলের সমর্থকগণ প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত। এখানে আরও কতকগুলো দল আছে যারা তত্ত্বে প্রগতিশীল কিন্তু বাস্তবে প্রগতিকে প্রতিরোধ করতে চায় এবং বিশেষ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে সমস্ত সমস্যার মূল সমাধান বলে বিশ্বাস করে। এরূপ দলের সমর্থকগণ প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া দল ভেঙ্গে নতুন দল গঠন করা, এক দল থেকে অন্য দলে যোগদান করা, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলে যোগদান করার প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশে দল ব্যবস্থা নেতাকেন্দ্রিক। নেতার অনুপস্থিতিতে দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। স্তরে স্তরে সুযোগ্য নেতার অভাব এবং বিকল্প নেতার আবির্ভাব এখানে প্রকট। এদেশে দলীয় ব্যবস্থা শতধা বিভক্ত। ফলে সব দলই এখানে নেতৃত্বের শীর্ষে অবস্থান করতে চায়।
বাংলাদেশে দল ব্যবস্থা শহরকেন্দ্রিক। খুব কমসংখ ̈ক দল আছে যাদের সংগঠন পল্লী অঞ্চলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তাছাড়া মূল্যবোধ বিবর্জিত কিছু কিছু রাজনৈতিক দল দেখা যায়। শঠতা, প্রতারণা, গলাবাজি, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এসব রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহনশীলতার পরিচয় দেয়, শুভ মানসিকতা গড়ে তুলে জনমতের প্রাধান্য দেয়, অস্ত্রের হুমকি ওধ্বংসাত্মক প্রবণতা না দেখিয়ে মানুষ ও মাটির সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ কর্মসূচি ও আদর্শ গ্রহণ করে, তাহলে রাজনৈতিক দল সমাজ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রাজনৈতিক দলের সফলতার জন্য রাষ্ট্রের সরকারি কর্মচারী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণকে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হবে। সরকারকে নমনীয় হতে হবে। রাজনৈতিক দলকে বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সর্বপ্রকার সুযোগসুবিধা প্রদান করা উচিত। সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভাব গড়ে উঠে তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল সফলতা অর্জন করতে পারে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।