যুদ্ধ ও যুদ্ধ তৎপরতার ধরন হচ্ছে মানবেতিহাসে সংঘটিত হরেক রকমের যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড

যুদ্ধ (ইংরেজি: War) ও যুদ্ধ তৎপরতা (ইংরেজি: Warfare) হচ্ছে সাধারণভাবে যুদ্ধ বা যুদ্ধগুলোর বিভিন্ন ধরণের সাধারণ ক্রিয়াকলাপ এবং বৈশিষ্ট্য। সেই অর্থে যুদ্ধের ধরন আছে বহু রকমের। স্নায়ুযুদ্ধ, উপনিবেশিক যুদ্ধ, সমুত্থান, সীমান্ত যুদ্ধ, ফল্ট লাইন যুদ্ধ, আগ্রাসন, বদলি যুদ্ধ, ব্যাপ্তি যুদ্ধ, ধর্মীয় যুদ্ধ, অঘোষিত যুদ্ধ, সমগ্র যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, পারমাণবিক যুদ্ধ ইত্যাদি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ।

যুদ্ধ তৎপরতার ধরনের ভেতরে রয়েছে সামঞ্জস্যহীন যুদ্ধ তৎপরতা, অভিযাত্রী যুদ্ধ তৎপরতা, রক্ষণাত্মক যুদ্ধ তৎপরতা, আক্রমণাত্মক যুদ্ধ তৎপরতা, প্রচলিত যুদ্ধ তৎপরতা, অর্থনৈতিক যুদ্ধ তৎপরতা, অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা, যৌথ যুদ্ধ তৎপরতা, রণকৌশলী যুদ্ধ তৎপরতা, নেটওয়ার্ক কেন্দ্রিক যুদ্ধ তৎপরতা, রাজনৈতিক যুদ্ধ তৎপরতা, সন্ত্রাসবাদ, অপ্রচলিত যুদ্ধ তৎপরতা, স্থল যুদ্ধ তৎপরতা, পর্বত যুদ্ধ তৎপরতা, পরিখা যুদ্ধ তৎপরতা, টানেলের যুদ্ধ তৎপরতা, শহুরে যুদ্ধ তৎপরতা, নৌযুদ্ধ তৎপরতা, আকাশ যুদ্ধ তৎপরতা প্রভৃতি। যুগ ভিত্তিক যুদ্ধ তৎপরতার ভেতরে আছে প্রাগৈতিহাসিক যুদ্ধ তৎপরতা, প্রাচীন যুদ্ধ তৎপরতা, সামন্তযুগীয় যুদ্ধ তৎপরতা, শিল্পবৈপ্লবিক যুদ্ধ তৎপরতা প্রভৃতি।

বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ

স্নায়ু যুদ্ধ

স্নায়ু যুদ্ধ (ইংরেজি: Cold War) হলো প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘর্ষ ছাড়াই একটি তীব্র আন্তর্জাতিক রেষারেষি, তবে এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী হুমকিসহ উচ্চ স্তরের সামরিক প্রস্তুতি, ব্যয় এবং অস্ত্রের উন্নয়ন বিরাজমান থাকে। স্নায়ু যুদ্ধ পরোক্ষ উপায়ে যেমন অর্থনৈতিক যুদ্ধতৎপরতা, রাজনৈতিক যুদ্ধতৎপরতা, গোপন শক্তিপ্রয়োগ, গুপ্তচরবৃত্তি, জালিকা (ইংরেজি: Cyber) যুদ্ধতৎপরতা বা বিকল্প (ইংরেজি: Proxy) যুদ্ধের মাধ্যমে সক্রিয় সংঘর্ষে জড়িত হতে পারে।

মূল নিবন্ধ স্নায়ু যুদ্ধ

উপনিবেশিক যুদ্ধ, (ইংরেজি: Colonial war) কতিপয় প্রসঙ্গে একে ছোট যুদ্ধ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, হচ্ছে উপনিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে বিদেশী অঞ্চলগুলির সম্পদ দখলের স্বার্থে উক্ত অঞ্চলগুলির নিষ্পত্তির জন্য উদ্ভূত বিভিন্ন সংঘর্ষ। এই শব্দটি বিশেষত আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত উনিশ শতকের যুদ্ধবিগ্রহকে বোঝায়।

সমুত্থান (ইংরেজি: Insurgency) হলো কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ যখন বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা যুদ্ধবাজ (আইনী যোদ্ধা) হিসাবে স্বীকৃত হয় না। একটি সমুত্থানী লড়াই প্রতি-সমুত্থানী যুদ্ধতৎপরতার মাধ্যমে চালানো হয়, এবং জনগণকে রক্ষার উদ্দেশ্যেও এই সমুত্থান চালানো হয়। অনেক সময় ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সমুত্থানকারীদের দাবী বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং প্রচারের দ্বারাও সমুত্থানের বিরোধিতা করা যেতে পারে। ধারণা হিসাবে, সমুত্থানের প্রকৃতি অস্পষ্ট।

আরো পড়ুন:  স্পেনের গৃহযুদ্ধ বামপন্থী পপুলার ফ্রন্টের সংগে দক্ষিণপন্থী বর্বর ফ্যাসিবাদীদের গৃহযুদ্ধ

সমুত্থান হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনে ব্যবহৃত শব্দ যার অর্থ হচ্ছে আইনসম্মতভাবে গঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান। সঠিক অর্থে এটিকে বিপ্লব কিংবা গৃহযুদ্ধ অথবা যুধ্যমান অবস্থা বলা যায় না। এই ধরনের বিদ্রোহের কোনো আইনসংগত সত্তা নেই, যেটা যুদ্ধের ক্ষেত্রে থাকে। সমুত্থানকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার যেমন জবর দখলকারী বা বিদেশাগত নয়, তেমনি সমুত্থানকারীরাও দেশেরই অধিবাসী। নিষ্পত্তির জন্য আলাপ আলোচনা চালাবার সময় সমুত্থিত সরকার আন্তর্জাতিক সত্তা লাভ করে।[১]

সমগ্র যুদ্ধ (ইংরেজি: Total war) হচ্ছে এমন যুদ্ধতৎপরতা যেখানে বৈধ সামরিক উদ্দেশ্যে যে কোনও ধরনের এবং সমস্ত বেসামরিক-সংশ্লিষ্ট সম্পদসমূহ এবং অবকাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করে, যুদ্ধ করবার জন্য সমাজের সমস্ত সম্পদকে সমাবেশিত করে এবং যুদ্ধহীন অবস্থার প্রয়োজনের তুলনায় যুদ্ধতৎপরতাকে অগ্রাধিকার দেয়। ফলে সমগ্র যুদ্ধ হচ্ছে এমন যুদ্ধতৎপরতা যা সম্পূর্ণরূপে আইনানুগ সামরিক লক্ষ্যমাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকে না এবং এর ফলে প্রচুর বেসামরিক বা অন্যান্য যুদ্ধসম্পৃক্তদের যন্ত্রণা ও হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।

বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এবং জাতীয়তাবাদের প্রভাবে আজকাল একটি দেশের সমস্ত মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে যুদ্ধের সাথে জড়িত থাকে। সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে বর্তমানে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। যুদ্ধের সময় দেশের সমস্ত জনবল ও অর্থবল যুদ্ধের কাজেই নিয়ােজিত হয় এবং এই ধরনের যুদ্ধ সমগ্র যুদ্ধ নামে পরিচিত।[২]

পারমাণবিক যুদ্ধ: পারমাণবিক যুদ্ধ তৎপরতা বা পরমাণু যুদ্ধ (মাঝে মাঝে: আণবিক যুদ্ধ বা তাপবিদ্যুৎ যুদ্ধ) হচ্ছে এমন একটি সামরিক সংঘাত বা রাজনৈতিক কৌশল যেখানে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি করতে ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক অস্ত্র হলো গণবিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র; প্রচলিত যুদ্ধের বিপরীতে, পারমাণবিক যুদ্ধ তৎপরতা অনেক স্বল্প সময়ে ধ্বংস সাধন করতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী বিকিরণমূলক ক্ষতি হতে পারে |

বিশ্বযুদ্ধ

একটি বিশ্বযুদ্ধ (ইংরেজি: World war) হচ্ছে একটি বৃহত্তর পরিসরের যুদ্ধ যা পুরো বিশ্বকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। একাধিক মহাদেশ, একাধিক দেশসমূহ বা মাত্র দুটি দেশব্যাপী বিস্তৃত অঞ্চলে সাধারণত বিশ্বযুদ্ধসমূহ ঘটে থাকে। স্নায়ু যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশ্বব্যাপী সংঘর্ষকে আত্মগতভাবে “বিশ্বযুদ্ধ” হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে।

আরো পড়ুন:  সমরবাদ এমন বিশ্বাস যাতে রাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা বজায় থাকে

মূল নিবন্ধ: বিশ্বযুদ্ধ

প্রচলিত যুদ্ধ তৎপরতা (ইংরেজি: Conventional warfare) যুদ্ধকে রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করে যেখানে পারমাণবিক, জৈবিক বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয় না বা এসবের সীমিত নিয়োজন দেখা যায়।

অপ্রচলিত যুদ্ধ তৎপরতা (ইংরেজি: Unconventional warfare) হলো সরকার বা একটি দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে পরিচালিত বিদ্রোহ বা প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন। প্রচলিত যুদ্ধে যেখানে আক্রমণ এবং রণকৌশলের মাধ্যমে সরাসরি প্রতিপক্ষের সামরিক ক্ষমতা হ্রাস করতে ব্যবহৃত হয়, অপ্রচলিত যুদ্ধে একটি বদলি শক্তির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বিজয় অর্জনের প্রয়াস চালানো হয়।

আগ্রাসন বা অন্যায় আক্রমণ বা আগ্রাসী যুদ্ধ তৎপরতা (ইংরেজি: Aggression) হচ্ছে অপর ব্যক্তি, গােষ্ঠী কিংবা দেশকে প্রত্যক্ষ আচরণে, কথায় অথবা মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে আঘাত, উৎখাত কিংবা অবমাননার উদ্দেশ্যে কোনও ব্যক্তি, গােষ্ঠী, অথবা দেশের আক্রমণসূচক ব্যবহার। শব্দটির সমার্থক প্রত্যয় হলো হিংসা, সংঘর্ষ ও যুদ্ধ। বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনুশীলন ও গবেষণার ক্ষেত্র।

মূল নিবন্ধ: আগ্রাসন

তথ্যসূত্র

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২০৯।
২. গৌরীপদ ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ডিসেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!